আনসারউল্লাহর নামে চলছে হত্যাকাণ্ড, সাংগঠনিক কাঠামো নেই

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2015.05.22
BD-islamist ২০১৩ সালের ২৪ আগস্ট রাজধানী থেকে আট জঙ্গীকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন অস্ত্রের ব্যবহারবিধি সম্বলিত এই প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল পাওয়া যায় বলে জানায় ডিবি। ২৪ আগষ্ট ২০১৩
বেনার নিউজ

‘আনসারউল্লাহ বাংলা টিম’কে আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। তবে গত দুই বছর ধরে পুলিশ ও গোয়েন্দারা আনসারউল্লাহর তৎপরতা নিয়ে কাজ করলেও এখন পর্যন্ত এর সাংগঠনিক কাঠামো বা কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোনো তথ্য জানতে পারেনি।

ঢাকা মহানগর পুলিশ এখন পর্যন্ত এই সংগঠনের অন্তত ২০ জন নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তারের দাবি করলেও তারা সংগঠনের কোন পদধারী সেসব বিষয়ে জানাতে পারেনি।

এর আগে ২০০৫ সালে বিএনপি–জামায়াত জোট সরকারের সময়ে আরও ছয়টি সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এগুলো হলো-হরকাতুল জিহাদ আল ইসলাম, জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ(জেএমজেবি), জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামি বাংলাদেশ (হুজি বি), শাহাদাত আল হিকমাত ও হিযবুত তাহরির।

পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, জেএমবি বা হুজির মতো আনুষ্ঠানিক কোনো সাংগঠনিক কাঠামো নেই আনসারউল্লাহর। এটি একটি উগ্র ও ধর্মান্ধ গোষ্ঠী। এর সাংগঠনিক কাঠামো নেই। এদের মধ্যম পর্যায়ের নেতারা ছোট ছোট দলে ৪/৫ জন করে তরুণকে দীক্ষা দেন। এরপর তাদের দিয়ে খুনোখুনি করানো হয়।

ওই ছোট দলগুলোকে পুলিশ বলছে স্লিপার সেল। ওই দলের সদস্যরা তাদের নেতার পরিচয় সম্পর্কে কিছুই জানে না। ফলে তারা ধরা পড়লেও নেতারা ধরা পড়েন না।

২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তদন্তে সেই খুনের সঙ্গে আনসারউল্লাহর সদস্যদের সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। এরপর আরও অন্তত আধ ডজন খুনের অভিযোগ ওঠে আনসারউল্লাহর বিরুদ্ধে। এসব খুনের ঘটনায় কয়েকজন ধরা পড়লেও নেতারা ধরা পড়েননি।

গত ১২ মে সিলেটে ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশকে কুপিয়ে হত্যার অভিযোগ ওঠে সংগঠনটির বিরুদ্ধে। সর্বশেষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা, গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্রসহ ১০ জনকে প্রাণনাশের হুমকির অভিযোগও ওঠে সংগঠনটির বিরুদ্ধে। এর আগে গত ২১ এপ্রিল আশুলিয়ার কাঠগড়া বাজারে কমার্স ব্যাংকে ডাকাতির সঙ্গেও আনসারউল্লাহ জড়িত ছিল বলে দাবি করেছিল পুলিশ। ওই ডাকাতির ঘটনায় এখন পর্যন্ত এক ডাকাতসহ নয়জন নিহত হয়েছেন।

ইতিহাস জানা, বর্তমানের খবর নেই: ডিবির অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) সাইফুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “এখন পর্যন্ত আনসারউল্লাহর অন্তত ২০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী সশস্ত্র জিহাদের মাধ্যমে তারা শরিয়া ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চান। সে জন্য আল কায়েদার কাঠামো, নীতি এবং কার্যপদ্ধতি অনুসরণ করছেন।”

পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, আনসারউলল্লাহ বাংলা টিমের সাংগঠনিক কাঠামো বা ইমারার শীর্ষে রয়েছেন জসীম উদ্দিন রাহমানি। অপারেশনাল দায়িত্বে ইজাজ হোসেন নামে একজনের নাম শোনা যায়। ইজাজ বর্তমানে পাকিস্তানে রয়েছেন। ২০১৩ সালের আগস্ট মাসে জসীম উদ্দীন রাহমানি গ্রেপ্তারের পরে বিভিন্ন সময় তামিম আদনানী নামে এক ব্যক্তির নাম এসেছে। তিনি সংগঠনটিতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। তবে তিনিই যে এখন ইমারার শীর্ষ পদে আছেন, এটা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

এডিসি সাইফুল বলেন, মূলত চার ধাপে আনসারউল্লাহ বিকশিত হয়েছে। প্রথম ধাপ হচ্ছে দাওয়াহ। এই ধাপে তারা সশস্ত্র জিহাদে অংশ নেওয়ার জন্য মানুষকে আহ্বান জানায়। তারা মানুষকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে, ভুল বুঝিয়ে এই ধাপে কাজ করছে।

দ্বিতীয় ধাপে আছে ইদাদ। এ ধাপে তারা নিজেদের উগ্র আদর্শের অনুসারী প্রচুর আনসার বা সাহায্যকারী তৈরি করে। দীর্ঘ সময় নিয়ে এই ধাপ পাড়ি দিতে হয়। সাহায্যকারীদেরও রকমফের রয়েছে। কথিত জিহাদের সময়ে এই আনসারেরা আর্থিক ও সশস্ত্র সহায়তা দেবে বলে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়।

তৃতীয় ধাপে আছে রিবাত। এই পর্যায়ে সশস্ত্র জঙ্গি হামলার চালানো হয়। এরপর গোপন জায়গা থেকে বার্তা পাঠিয়ে হামলার দায় স্বীকার করা হয়।

শেষ পর্যায়ে হচ্ছে কতল। তাদের মতে ‘জিহাদ’ ব্যর্থ হলে নির্বিচার হত্যা বা কতল অনিবার্য।

আনসার উল্লাহর অপারেশনাল প্রধান ইজাজ হোসেন ২০০৮ সালে পাকিস্তানে পালিয়ে যান। এর আগে জামাআতুল মুসলিমিন নামে একটি সংগঠন করে এর আমির হন তিনি। জামাআতুল মুসলিমীন করার সময় তার সহযোগী ছিল জুন্নুন শিকদার, রেজওয়ান শরীফ, মইনউদ্দীন শরীফ, নাঈমুল হাসান, তেহেজীব করিম, রাজীব করিম, শেহজাদ তুরাজ, রেজাউর রাজ্জাকসহ আরও কয়েকজন।

জামাআতুল মুসলিমিনের আন্তর্জাতিক আমির হচ্ছেন জর্ডান বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক শেখ আবু ইসা আলী আররিফাই আল হাশেমী আল কোরাইশি আবু ইসা। তিনি ২০০২ সালে বাংলাদেশে আসেন। এরপর ব্রিটেনে ফিরে তিনি পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। এর ফলে বাংলাদেশে জামাআতুল মুসলিমিনের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। এখান থেকেই আনসারউল্লাহর উৎপত্তি বলে ধারণা করা হচ্ছে।

“চার–পাঁচজনের জনের ছোট ছোট দল বা স্লিপার সেল করে আক্রমণ পরিচালনা করে থাকে এরা। প্রচুর সদস্য বাড়িয়ে রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আঘাত হানার লক্ষ্য এদের,” বেনরাকে জানান ডিবির যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম।

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলেন, প্রথম দিকে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের দুটি মসজিদে জুম্মার নামাজে খুতবা দিতেন মাওলানা জসীমউদ্দীন রাহমানি। প্রতি জুমায় প্রচুর দর্শক-শ্রোতা হতো মসজিদে। এরপর তাঁর বক্তৃতার অডিও ছড়িয়ে দেওয়ার কার্যক্রম হাতে নেন তাঁর অনুসারীরা।

ফুরকান মিডিয়া নামে একটি ওয়েবসাইটে শুধু মাওলানা জসীমউদ্দীনের বক্তব্য আপলোড করা হতো। যারা ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারেন না, প্রত্যন্ত এলাকায় সেসব মানুষের জন্য মুঠোফোনের মেমোরি কার্ডে বক্তৃতাগুলো সংরক্ষণ করে পাঠিয়ে দেওয়া হতো। এভাবে তাঁর বিশাল ভক্ত-অনুসারী তৈরি হয়।

এদের মধ্যে কতজন সশস্ত্র বিপ্লবের দীক্ষা নিয়েছে তা এখনো জানা নেই পুলিশ ও ডিবির। এখন আসলে কে সংগঠন চালাচ্ছেন সে বিষয়েও কোনো ধারণা নেই তাঁদের। তামিম আদনানীর নেতৃত্বের কথা বলা হলেও তিনি কে, তাঁর বিস্তারিত পরিচয়ই এখন পর্যন্ত জানতে পারেনি গোয়েন্দারা।

“আমরা নিশ্চিত হয়েছি যে এটি  একটি উগ্র জঙ্গি সংগঠন। জাতীয় নিরাপত্তার জন্য এই সংগঠন হুমকি স্বরূপ। এসব নিয়েই সম্প্রতি পুলিশের পক্ষ থেকে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে,” বেনারকে জানান ঢাকা মহানগর পুলিশের জনসংযোগ বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার এসএম জাহাঙ্গীর আলম সরকার।

“পুলিশের প্রতিবেদন অনুযায়ী আনসারউল্লাহ লেখক, ব্লগার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদের হত্যায় জড়িত। ক্রমাগত হত্যার হুমকিও দিচ্ছে। সংগঠনটির বিরুদ্ধে বিভিন্ন ঘটনায় জড়িত থাকার প্রমাণও মিলেছে। সে অনুযায়ী এটিকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার,” বেনরাকে জানান স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।

তবে নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব.) মনিরুজ্জামান বেনারকে বলেন, “অনেকগুলো ঘটনায় জঙ্গিদের জড়িত থাকার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ মেলেনি, তবুও দাবি করা হচ্ছে জঙ্গিরা জড়িত।”

তাঁর মতে, জঙ্গিদের যে উত্থান হচ্ছে এতে সন্দেহ নেই। উত্থান পর্বটি পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। তবে জঙ্গি উত্থানের বিষয়টিকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের সম্ভাবনা রয়েছে। এখন এটিকে কেউ রাজনীতিক ভাবে ব্যবহার করছে কিনা সেটি খতিয়ে দেখার বিষয়।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।