আনসারুল্লাহ’র এক নেতা গ্রেফতার, এবার আইএস’র আদলে জঙ্গি সংগঠন

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2015.06.01
BD-islamist পুলিশের হাতে আটকৃত আব্দুল্লাহ আল গালিব। ৩১ মে, ২০১৫
বেনার নিউজ

আইএস (ইসলামিক স্টেট) জঙ্গি সন্দেহে দুইজনকে গ্রেপ্তারের এক সপ্তাহের মাথায় এবার মধ্যপ্রাচ্যের ওই সংগঠনটির আদলে বাংলাদেশে নতুন জঙ্গি সংগঠন করার পরিকল্পনাকারী এক যুবককে আটকের দাবি করেছে গোয়েন্দারা।

শনিবার রাতে ঢাকায় জঙ্গি সন্দেহে সাবেক এক সেনা কর্মকর্তার ছেলেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। যিনি ‘জুনুদ আত-তাওহিদ ওআল খিলাফা’ নামে নতুন জঙ্গি সংগঠন খুলে সদস্য সংগ্রহ ও বাংলাদেশে ‘খিলাফত প্রতিষ্ঠার' পরিকল্পনা করছিলেন বলে গোয়েন্দাদের দাবি। আইএস জঙ্গিদের মতো খিলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা গ্রুপটির টার্গেটে ছিল।

আবদুল্লাহ আল গালিব নামের ২৫ বছর বয়সী ওই তরুণকে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সহ সমন্বয়ক বলে বেনারকে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ কমিশনার শেখ নাজমুল আলম।
তিনি আরো বলেন, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের দায়িত্বে আসার আগে গালিব হিজবুত তাহরীর ও জেএমবির সঙ্গেও সম্পৃক্ত ছিলেন।

রোববার গণমাধ্যমের সম্মুখে গালিবকে হাজির করে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, আইএসের আদলে বাংলাদেশের খিলাফত প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে সম্প্রতি তিনি ‘জুনুদ আত-তাওহিদ ওআল খিলাফা’ নামে সশস্ত্র জিহাদী সংগঠন খুলে কার্যক্রম শুরু করেন। ইতিমধ্যে ১০ থেকে ১৫ জন সদস্য সংগ্রহ করে সে প্রশিক্ষণ দেওয়াও শুরু করেছিলেন গালিব।

গালিবের বাসা থেকে উদ্ধার করা ‘জঙ্গি প্রশিক্ষণের’ একটি ভিডিও গণমাধ্যমকর্মীদের সম্মেলনে দেখানো হয়।
ওই ভিডিওতে দেখা যায় পেছনে কালো কাপড়ে সাদা হরফে কলেমা এবং বন্দুকের ছবির সামনে স্পোর্টস ট্রাউজার ও কালো গেঞ্জি পরা মুখ ঢাকা নয় তরুণ। যাদের হাতে হাতে পিস্তল বা রিভলবার লক্ষ্য করা যায়।

ভিডিওটির শুরুতে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আল কায়দা নেতা আনোয়ার আল-আওলাকির একটি বক্তব্য রয়েছে। পরে তা একজন বাংলায় অনুবাদ করে দু'পাশে দুই অস্ত্রধারীকে শপথ পড়াতে দেখা যায়। ওয়েবসাইটে এ ভিডিও ছাড়াও আইএস জঙ্গিদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ, 'জিহাদের জন্য' উদ্বুদ্ধকরণ এবং জিহাদের ৪২ মিনিটের বেশি ভিডিওচিত্র রয়েছে। 'আত তাহরিদ মিডিয়া' শব্দ তিনটি ইংরেজি হরফে লেখা থাকলেও এর নিচেই বাংলায় লেখা রয়েছে 'এবং মুমিনদেরকে কিতালের জন্য উৎসাহিত কর...।'

এরকম ভিডিও ‘জুনুদ আত-তাওহিদ ওআল খিলাফা’ এর ওয়েবসাইটেও রয়েছে। তারা ইরাক ও সিরিয়ার মতো ‘গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থাকে উৎখাতের মাধ্যমে আইএস নির্দেশিত খিলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য’ ইন্টারনেটে কর্মী সংগ্রহ করছিল বলে জানায় গোয়েন্দা পুলিশ।
পুলিশ বলছে, প্রাথমিকভাবে বিবেচনায় ভিডিওর ওই প্রশিক্ষণ বাংলাদেশেই বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে তাদের হাতের অস্ত্র আসল না নকল তা যাচাই বাছাই করে দেখতে হবে।

গালিব ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে আইএস এর প্রতিনিধি হিসেবে কর্মী সংগ্রহ, তাদের আশ্রয় ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতেন বলে জানান বলেন  নাজমুল আলম।

গালিবের বাবা মো. আবদুল্লাহ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজর। বারিধারা এলাকায় নিজ বাড়িতে বসবাস করেন তিনি।  বেনারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে তিনি অসুস্থ বলে পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়। এছাড়া গালিবের বিষয়েও কেউ কথা বলতে রাজি হননি।

গোয়েন্দারা জানান, গালিব আইএসের হয়ে যুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য একাধিকবার তুরস্কে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। এবং তার পাসপোর্টও জব্দ করা হয়েছে। ঢাকার একটি ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল থেকে পড়াশেুনা শেষ করে ব্যবসা করতেন গালিব।

পুলিশ আরো জানায়, “আল কায়েদার বিভিন্ন ভিডিও বার্তা আরবি থেকে বাংলায় অনুবাদ করত গালিব। এ ধরনের প্রায় ৫০টা সিডি তার বাসায় পাওয়া গেছে।

ওই বাসা থেকে দুটি পোর্টেবল হার্ডডিস্ক, চারটি হার্ডডিস্ক, কম্পিউটার সিপিইউ, সিডি, ৪৩টি জিহাদি বই, তিনটি ‘মইনুল ইসলামের মাসিক পত্রিকা’ এবং ‘মেইড ইন পাকিস্তান’ লেখা একটি টুপি পাওয়া গেছে বলেও উপ কমিশনার নাজমুল আলম জানান। গালিবের বিরুদ্ধে বনানী থানায় সন্ত্রাস দমন আইনে একটি মামলা হয়েছে।

এর আগে গত ২৪ মে রাজধানীর উত্তরা ও লালমাটিয়া এলাকা থেকে আমিনুল ইসলাম (৩৮) ও শাকিব বিন কামাল (৩০) নামে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

সম্প্রতি কিছুদিন পরপরই বাংলাদেশে ‘জঙ্গি’ আটক করছে পুলিশ। আবার বিভিন্ন নাশকতা ঘটিয়ে তারা নিজেরাও দায় স্বীকার করে নিচ্ছে। হঠাৎ এমন জঙ্গি উত্থানকে কঠোরভাবে দমনের দাবি জানিয়েছে নাগরিক সমাজ। তারা বলছেন, বিশ্বে বাংলাদেশ যখন নানা উন্নয়ন সূচকে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন এ ধরনের জঙ্গি তৎপরতার খবর কিছুটা হলেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাই শুধু সরকার বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নয় সামাজিকভাবেও সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর এ বিষয়ে বেনারকে বলেন, “সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু ‘জঙ্গি’ আটকের ঘটনা বেশ উদ্বেগজনক। তবে পাশাপাশি জঙ্গি দমনে সরকারের উদ্যোগও লক্ষ্য করা যাচ্ছে।”

তিনি বলেন, “শুধু সরকার নয় সামাজিক পরিবেশ ব্যবহার করে যাতে এসব জঙ্গিরা সুযোগ নিতে না পারে  সে বিষয়টিও নজরে আনতে হবে। সামাজিকভাবেও জঙ্গি তৎপরতা রোধে সকলকে কাজ করতে হবে। কারণ, বাংলাদেশ শিক্ষা, অর্থনীতি, নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ণ সহ নানা ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে। ঠিক সেসময় এমন ‘জঙ্গি তৎপরতা’ একটি হুমকি স্বরুপ। তবে সরকার তা দমনে সঠিক পদক্ষেপ নিচ্ছে বলে মনে করি।”

এদিকে বেশ কয়েকদিনের খবরে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণদের জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত থাকার খবরে দুশ্চিন্তার রেখা দেখা যাচ্ছে অভিভাবকমহলেও।

বেসরকারী নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া এক শিক্ষার্থীর বাবা হেলালুর রহমান বেনারকে বলেন, আগে  মাদ্রাসা ছাত্রদের এ ধরনের কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত ধরা হত। কিন্তু ইদানিং ‘জঙ্গি’ শব্দটির সঙ্গে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বা ইংরেজি মিডিয়ামে পড়াশুনা করা ছাত্রদের নামও উঠে আসছে। আমরা যারা অভিভাবক তারাই জানি এটা কতটা আতঙ্কের বিষয়। ছেলেমেয়েদেরকে নিয়ে সারাক্ষণই দুশ্চিন্তায় থাকি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করতে গিয়ে না জানি কোন সংগঠনের খপ্পড়ে পড়ে।

তিনি বলেন, কিছুদিন পর পর বিভিন্ন সংগঠন নিষিদ্ধ ঘোষণা করছে সরকার। সেখানেই থেমে থাকলে চলবে না এসব সংগঠনের কর্মীরা যাতে কোন ধরনের গোপন কর্মকান্ড চালিয়ে  কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ‘ব্রেইন ওয়াশ’ না করাতে পারে  সে বিষয়েও লক্ষ্য রাখার আহবান জানাচ্ছি।

তিনি বলেন, শহরে খেলাধুলা বা সাংস্কৃতিক চর্চার পর্যাপ্ত সুযোগ না থাকায় তরুণ সমাজ এমন আত্মঘাতি পথের দিকে চলে যায়। সেখান থেকে তাদেরকে ফেরাতে অভিভাবক, পরিবারের পাশাপাশি সমাজ এবং রাষ্ট্রকেও এগিয়ে আসতে হবে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।