নিবন্ধন বাতিলের পর জামায়াত নিষিদ্ধের বিল মন্ত্রী সভায়

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2015.06.02
BD-islamist বিদেশি চাপ এবং রাজনৈতিক স্বদিচ্ছার অভাবে যুদ্ধাপরাধের অপরাধে অভিযুক্ত দলটিকে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে না বলে অনেকে মনে করেন।
বেনার নিউজ

গত ছয়মাস আগে জামায়াত ও এর অঙ্গসংগঠনগুলো নিষিদ্ধের একটি প্রস্তাব আইন মন্ত্রণালয় থেকে মন্ত্রী পরিষদে বিভাগে পাঠানো হয়। এর আগে ও পরে বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানে এ কথাটি বলে আসছিলেন আইন মন্ত্রী আনিসুল হক।

তবে এবার আনুষ্ঠানিকভাবে সংসদে তিনি জানালেন, যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে আইন করে জামায়াত ও এর অঙ্গসংগঠনগুলো নিষিদ্ধের ব্যাপারে একটি বিল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে রয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অনুমোদন পেলে সেটি সংসদে উত্থাপন করা হবে।

সোমবার শুরু হওয়া সংসদ অধিবেশনে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে তরিকত ফেডারেশনের সংসদ সদস্য নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী এ বিষয়ে প্রশ্ন করেন।

এর আগে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের চেয়ে একটি মামলা করে তরিকত ফেডারেশন। সে বিষয়টি উল্লেখ করে নজিবুল বশর বলেন, দলটির নিবন্ধন বাতিল হচ্ছে, হবে বলে দীর্ঘদিন ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু কবে নাগাদ হবে- মন্ত্রীর কাছে জানতে চাই।”

“যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত জামায়াত নিষিদ্ধের ব্যাপারে আইনের সংশোধনী আনার কথা রয়েছে। এ-সংক্রান্ত একটি বিল মন্ত্রিপরিষদের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ অনুমোদন দিলে সংসদে আসবে। আর জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল চেয়ে করা মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য বাদীদের (তরিকত ফেডারেশন) দরখাস্ত করতে হবে।” জবাবে বলেন আইন মন্ত্রী।

এ বিষয়ে সরকারের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, জামায়াত নিষিদ্ধ হওয়ার বিষয়টি এখন নীতি নির্ধারনী পর্যায়ের প্রশ্ন। উপরের মহলের গ্রীন স্যিগনাল পেলেই পরবর্তি ধাপে পৌঁছুবে।

আর মন্ত্রী পরিষদ সচিব মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া বেনারকে বলেন, “এ বিষয়ে প্রস্তাব মন্ত্রী সভা বিভাগে এসেছে। সুবিধামত সময়ে তা মন্ত্রিসভায় উঠতে পারে।”

এদিকে জামায়াত বিষয়ে সরকারের পদক্ষেপের গতি খুব ‘ধীর’ বলছেন সংশ্লিষ্টরা। বিদেশি চাপ এবং রাজনৈতিক স্বদিচ্ছার অভাবে যুদ্ধাপরাধের অপরাধে অভিযুক্ত দলটিকে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে না বলে মনে করেন তারা।

এ বিষয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়ে আসছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। সংগঠনটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বেনারকে বলেন, ছয় বছর আগেই জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা উচিত ছিল সরকারের। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, জামায়াত নিষিদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তবায়নের ম্যান্ডেট দিয়েই জনগণ তাদেরকে দুই তৃতীয়াংশ আসন দিয়ে সরকারে এনেছিল।

অন্যদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সারা দেশে জামায়াতের ভোটার সংখ্যা প্রায় ৫/৬ ভাগ। দলটি বিভিন্ন সময়ে সংসদেও প্রতিনিধিত্ব করেছে। মন্ত্রিসভায়ও ছিল দলটি। সংখ্যায় অনেক না হলেও দলটির কিছু কর্মী বা সমর্থক আছেন যারা দলের প্রতি নিবেদিত প্রাণ।

এ নিষিদ্ধ করা হলে আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যেতে পারে দলটি। তখন এসব কর্মী সমর্থকদের নিয়ে আরো সন্ত্রাসী কর্মকান্ড বাড়াবে বলে আশঙ্কা বিশ্লেষকদের।  
এসব আশঙ্কাকে উড়িয়ে দিয়ে শাহরিয়ার কবির বলেন, “জামায়াত বরাবরই সহিংস। এখন যে সহিংসতা দেখাচ্ছে, আন্ডারগ্রাউন্ডে গিয়ে এর চেয়ে বেশি কিছু করতে পারবে না। সরকার আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের চাপে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করছে না বলে আমরা মনে করি।”

জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি তিনি তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষাসহ বিভিন্ন এনজিও বন্ধ কিংবা জাতীয়করণ করার পক্ষে মত দেন।

এ বিষয়ে শাহরিয়ার কবির বলেন, শুধু দল নিষিদ্ধ করলে সেটি অন্য নামে চলবে। লিবারেল ইসলামিক পার্টি নামে নতুন করে আত্মপ্রকাশের জন্য তারা কাগজপত্রও তৈরি করে রেখেছে। এখনো দেশের আলিয়া মাদ্রাসাগুলোতে জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা মওদুদীর মতাদর্শন পড়ানো হয়। এসব মাদ্রাগুলোতে প্রায় ৫০ লাখ শিক্ষার্থী আছে। তাদের মস্তিষ্ক ধোলাই চলছে। এসব বন্ধ করতে হবে।

“আমরা মনে করি ১৯৭৩ এর বিশেষ আইনেই যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াতের বিচার করা সম্ভব। কিন্তু আইনমন্ত্রী এবং সরকার যেহেতু আইন সংশোধনের পক্ষে, তাই আমরাও অধীর আগ্রহে দেখার অপেক্ষায় ছিলাম। তবে যেভাবেই হোক আমরা আশা করবো যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে খুব শীঘ্রই ট্রাইব্যুনালে জামায়াতের বিচার শুরু হবে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ন্যুরেমবার্গ ট্র্যায়ালে যেভাবে হিটলারের নাৎসী পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল, বাংলাদেশে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতও একই ভাবে জামায়াত ইসলামীকে নিষিদ্ধ ঘোষনা করবে।” বলেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে সোচ্চার কলামিস্ট ও সাংবাদিক সাব্বির খান।

তিনি বলেন, “ইতিমধ্যে অনেক সময় নষ্ট হয়েছে। এছাড়াও একাত্তরের গণহত্যা, মুক্তিযুদ্ধ, মৃতের সংখ্যা সহ অন্যান্য যেকোন বিষয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করা যাবে না এবং করলে তা আইনের চোখে অপরাধ বলে বিবেচিত হবে বলে আইন করার জন্য সরকারের প্রতি আহবান করছি। অর্থাৎ ইউরোপে হলোকাস্ট ডিনায়েলের বিরুদ্ধে প্রত্যেকটি দেশ যেভাবে আইন করেছে, বাংলাদেশেও তা করার জোর দাবি জানাচ্ছি।”

জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবি জোরদার হয় আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া কিছু রায়ে দলটির বিষয়ে পর্যবেক্ষণের পরে। ট্রাইব্যুনালের চারটি রায়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীকে পাকিস্তানি সেনাদের ‘সহযোগী বাহিনী’হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এসব রায়ের পর্যবেক্ষণে ট্রাইব্যুনাল মুক্তিযুদ্ধকালীন নৃশংসতার জন্য পাকিস্তানি সেনাদের পাশাপাশি জামায়াতকেও দায়ী করেন। এরপর থেকে জোরদার হয় জামায়াত নিষিদ্ধের দাবি।

এদিকে হাইকোর্টের আদেশের প্রায় দেড় বছর পর সংসদকে নির্বাচন কমিশন জানালো, জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে। জাতীয় সংসদ থেকে এক প্রশ্নোত্তর পর্বের জন্য জানতে চাওয়ার প্রেক্ষিতে সোমবার ব্যাখ্যাটি সংসদ সচিবালয়ে পাঠানো হয়েছে বলে নিশ্চিত করেন ইসি সচিব সিরাজুল ইসলাম।

এতে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০০৯ সালে বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের মহাসচিব মওলানা সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরীসহ ২৫ ব্যক্তি জামায়াতের নিবন্ধন নিয়ে এক রিট পিটিশন দায়ের করেন। কয়েক দফা শুনানির পর হাইকোর্ট ২০১৩ সালের ১ আগস্ট এক রায়ে, জামায়াতকে রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন দেওয়াকে আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত ও আইনগত অকার্যকর মর্মে ঘোষণা করায়, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী নামের রাজনৈতিক দলটির নিবন্ধন বাতিল হয়।

হাইকোর্টের এই রায়ের ফলে গত ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারেনি দলটি। তবে তারা হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছে।

এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন সচিব সিরাজুল ইসলাম বলেন, জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের জন্য কোনো গেজেট প্রকাশের দরকার নেই। অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া আদেশেই দলটির নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। তবে হাইকোর্টের দেওয়া ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছে জামায়াত। এতে তারা জয়ী হলে আবার নিবন্ধন দেওয়া হবে।

বর্তমান নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৪০টি।



মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।