জামায়াত নিষিদ্ধের পথে দলটির আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা
2015.11.24
আদালতের ভাষায় ‘ক্রিমিনাল দল’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া জামায়াতে ইসলামীর আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের চলমান দাবির মধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয় ওই দলটির নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশ দিয়েছে।
যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মো. মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের দিন গত রোববার অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরকে এ-সংক্রান্ত একটি চিঠি পাঠানো হয়।
এদিকে দুই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি কার্যকর করার পর সরকার এখন জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে। এ নিয়ে ১৪-দলীয় জোটের শরিক সংগঠন, সরকারি দলের নেতা এবং সরকার-সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই চাপ দিয়ে আসছেন।
২০১৩ সালে শাহবাগ আন্দোলন শুরুর পর গণজাগরণ মঞ্চের পক্ষ থেকে জামায়াত সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে চিহ্নিত করে সেগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি উঠে। বাণিজ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন, গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন খাতে জামায়াতের লগ্নি রয়েছে বলে মনে করা হয়।
যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবি করে আন্দোলনকারীরা বলে আসছেন, এর মাধ্যমে দলটি আর্থিকভাবে পুষ্ট হয়েছে।
আন্দোলনকারীদের কেউ কেউ এসব প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রীয় মালিকানায় আনার দাবি জানিয়েছেন। এসব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে তা মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে ব্যয়ের পরামর্শও এসেছে।
“জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে হবে, যুদ্ধাপরাধী ওই দলটির আর্থিক ভিত্তি নষ্ট করতে হবে,” বেনারকে জানান লেখক ও সাংবাদিক শাহরিয়ার কবীর, যিনি একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটির নির্বাহী সভাপতি।
তিনি জামায়াতের নেতা ও প্রতিষ্ঠানের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে তা দু:স্থ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিতরণ করার প্রস্তাব করেন।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের চিঠি
বাংলাদেশ ব্যাংককে দেওয়া অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপ সচিব মো. রিজওয়ানুল হুদার স্বাক্ষরিত চিঠির সঙ্গে দুই পাতার একটি বিবরণী ও ২১৬ পাতার একটি সংযোজনী পাঠানো হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে লেখা ওই চিঠিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ‘জামায়াত নিয়ন্ত্রিত’ সেবামূলক প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সংগঠনের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
“সরকার যখন নির্দেশ দিয়েছে আমরা (বাংলাদেশ ব্যাংক) অবশ্যই প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবে,” সাংবাদিকদের জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মো. রাজী হাসান।
“তবে চিঠি ও তার সঙ্গে যেসব তথ্য-উপাত্ত অর্থ মন্ত্রণালয় পাঠিয়েছে, প্রথমে সেগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কতটা করার সুযোগ আছে, সেগুলোও দেখতে হবে।”
তবে সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে স্পষ্ট বক্তব্য আসেনি। অর্থ মন্ত্রণালয় নির্দেশ দিলেও কী ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে, তা স্পষ্ট করেনি।
শাহবাগ আন্দোলনের মধ্যে যে প্রতিষ্ঠানগুলো জামায়াত সংশ্লিষ্ট বলে চিহ্নিত করা হয়েছে, তার মধ্যে অনেকগুলোর কর্মকর্তারাই ওই দলটির সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক সম্পৃক্ততার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
যেমন ইসলামী ব্যাংক, যাকে জামায়াত সংশ্লিষ্ট সবচেয়ে বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে ‘স্লোগান ৭১’ এর তালিকায়।
শাহবাগ আন্দোলনের মধ্য থেকে ইসলামী ব্যাংকের নাম আসার পর প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে জামায়াত সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করা হয়।
এ ছাড়া জামায়াতের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত বেশ কয়েকটি হাসপাতাল, রোগ নিরূপণ কেন্দ্র, ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করা হয়।
ব্যাংকের পাশাপাশি কয়েকটি বীমা প্রতিষ্ঠানকেও জামায়াতের বলে মনে করা হয়। বলা হয়, তাদের কয়েকটি সংবাদমাধ্যম, পরিবহন কোম্পানি এবং কয়েকটি আবাসন নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানও রয়েছে।
কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি সারা দেশে অসংখ্য কোচিং সেন্টার ও স্কুল-কলেজও জামায়াতের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত বলে চিহ্নিত।
জামায়াত নিষিদ্ধের প্রক্রিয়া চলছে
সরকারের একাধিক মন্ত্রী ও নেতার সঙ্গে কথা বলে আভাস পাওয়া গেছে, এত দিন নিষিদ্ধের বিষয়টি নিয়ে মাঠে-ময়দানে আলোচনা-পর্যালোচনা করে সরকার জামায়াতের শক্তি আঁচ করার চেষ্টা করেছে। দুই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির পর সরকার তাঁদের শক্তি সম্পর্কে ধারণা পেয়েছে।
জামায়াত নিষিদ্ধের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করে গত প্রায় ছয় মাস আগে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন সংশোধনের খসড়াটি আইন মন্ত্রণালয় থেকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক একাধিকবার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ও সাংবাদিকদের বলেছেন, খসড়া আইনটি অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভায় উঠবে।
“মন্ত্রিসভায় আইনটি অনুমোদনের জন্য উত্থাপন করা হবে,” বেনারকে জানান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। কবে তা হতে পারে, জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, “দেখেন, অপেক্ষা করেন।”
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্র জানায়, জামায়াত নিষিদ্ধ করার উদ্দেশ্যে খসড়াটি আইন মন্ত্রণালয় থেকে দীর্ঘদিন আগে ওই বিভাগে এসেছে। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের সবুজসংকেত পেলেই খসড়াটি মন্ত্রিসভার বৈঠকে উঠবে।
“আর দেরি না করে জামায়াত নিষিদ্ধ করাটা এখন রাজনীতিতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত,” বেনারকে জানান বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, যিনি ১৪-দলের শরিক ও ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি।
সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেকেই গত কয়েক দিনে খুব শিগগির জামায়াত নিষিদ্ধ করা হবে বরে বক্তৃতা-বিবৃতি দিচ্ছেন।
তবে সরকারের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে, জামায়াত নিষিদ্ধ করলে সামনে তিনটি সম্ভাবনা ও ঝুঁকি রয়েছে। একটি হচ্ছে, দলটি বিএনপির সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে।
অপরটি হচ্ছে, দলটির নেতা-কর্মীরা আত্মগোপনে গিয়ে সহিংস ঘটনা ঘটাতে পারে।
আর তৃতীয় মত হচ্ছে, জামায়াতের তরুণ নেতা-কর্মীরা বিশেষ করে স্বাধীনতা-পরবতী প্রজন্ম যুদ্ধাপরাধের কালিমা ধুয়েমুছে নতুনভাবে যাত্রা শুরু করতে পারে।
এই তিন ধরনের আলোচনার মধ্যেও সরকার ও সরকারঘেঁষা দল ও বিশিষ্টজনরা মনে করেন সব ঝুঁকির মধ্যেও জামায়াত নিষিদ্ধ করাই শ্রেয়।
“জামায়াত নিষিদ্ধ করতে সরকারের আর দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকা উচিত নয়। এ ছাড়া সরকার, রাজনীতি বা প্রশাসনে স্বাধীনতাবিরোধী কেউ ঘাপটি মেরে আছে কিনা, তাও খুঁজে দেখতে হবে,” বেনারকে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন।