বাংলাদেশে সাংবাদিক হয়রানি, সিপিজের মুক্তি দাবি

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2015.04.03
BD-journalist সিপিজের রিপোর্টঃ বাংলাদেশে সাংবাদিকদের উপর পুলিশি নির্যাতন বেড়েছে। ছবিতে প্রবীন ফটো সাংবাদিক জহিরুল হকের গায়ে হাত তোলে পুলিশ। ১৬ এপ্রিল,২০০৬
এএফপি

পুলিশের নির্মম নির্যাতনের শিকার পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার স্থানীয় সাংবাদিক মিজানুর রহমান পুলিশের রোষানলে পড়ে ও সরকারি দলের নেতাদের প্রভাবের কারণে জেল খাটছেন। গুরুতর অসুস্থ হলেও তাঁকে জামিন দিচ্ছে না আদালত।

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা নিউইয়র্ক ভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংগঠন কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্ট (সিপিজে) মিজানুরকে গ্রেপ্তার ও পুলিশি নির্যাতনের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে ২ এপ্রিল এক বিবৃতিতে তাঁকে মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।

‘বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছে। সাংবাদিক মিজানুর রহমানের গ্রেপ্তার ও পুলিশ হেফাজতে তাঁকে নির্যাতনের অভিযোগ এ উদ্বেগকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে,” জানান সিপিজের এশিয়া প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর বব ডায়াজ।

বিবৃতিতে তিনি বলেন, “আমরা কর্তৃপক্ষের প্রতি মিজানুরের ওপর থেকে অভিযোগগুলো প্রত্যাহার, তাঁর মুক্তি ও তাঁকে শারীরিকভাবে নির্যাতনের অভিযোগের ব্যাপারে পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তের আহ্বান জানাই।”

গত ১৭ মার্চ বাউফলের কালাইয়ার ল্যাংরা মুন্সির পোল এলাকায় কথা-কাটাকাটি ও হাতাহাতির ঘটনায় কালাইয়া নৌ পুলিশ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক (এসআই) মো. হালিম খানকে দিয়ে সাংবাদিক মিজানুরের বিরুদ্ধে মারধর ও সরকারি কাজে বাঁধাদানের অভিযোগে সাজানো মামলা করে পুলিশ। রাতেই গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে রাতভর নির্যাতন করে পরদিন আদালতের মাধ্যমে তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়।

গত ২২ মার্চ জেলার দ্বিতীয় বিচারিক হাকিম এ এস এম তারিক শামসের আদালতে মিজানুরের জামিন আবেদনের ওপর শুনানি হয়। তবে আদালত জামিন নামঞ্জুর করেন।পরে তাঁর চিকিৎসার আবেদন করা হলে জেল সুপারকে কারাবিধি অনুযায়ী সুচিকিৎসার আদেশ দেন।

পটুয়াখালীর সিভিল সার্জনের কার্যালয় মিজান গুরুতর অসুস্থ এবং তার শরীরের বিভিন্নস্থানে ক্ষতের কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদন দিলেও আদালত এরপরও জামিন দেয়নি। বরং মিজানের বিরুদ্ধে আরও একটি মামলা হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের একজন নেতার করা চাঁদাবাজির ‘মিথ্যা মামলায়’ ২ এপ্রিল ওই মামলায়ও জামিন নামঞ্জুর করা হয়।

“চাঁদাবাজির অভিযোগে করা মামলাটি একটি ‘মিথ্যা মামলা। গত ২৪ মে ‘বাউফলে স্থানীয় সরকার সহায়তা প্রকল্প কাগজে আছে, বাস্তবে নেই’ শিরোনামে প্রথম আলোয় মিজানুরের লেখা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে চাঁদাবাজি ও ছিনতাইয়ের অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে ২৬ মে পটুয়াখালী দ্রুত বিচার আদালতে ওই মামলাটি হয়েছে,” বেনারকে জানান মিজানুরের আইনজীবী লুৎফর রহমান।

এ প্রসঙ্গে সিপিজের বিবৃতিতে বলা হয়, গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী দুর্নীতি ও স্থানীয় কর্মকর্তাদের ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ নিয়ে মিজানুর প্রতিবেদন করায় প্রতিশোধ নিতে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

মিজানুরকে মুক্তি দিতে ও পুলিশ হেফাজতে তাঁর ওপর নির্যাতন চালানোর অভিযোগ তদন্ত করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সিপিজে।

“চাঁদাবাজির মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির একমাত্র উদ্দেশ্য গণমাধ্যমকে ভীতসন্ত্রস্ত করা। আমরা অবিলম্বে মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে দায়ের করা মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার এবং অবিলম্বে তাঁর মুক্তির দাবি জানাচ্ছি,” বেনারকে জানান বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের একাংশের সভাপতি শওকত মাহমুদ।

সরকার বিরোধী বলে পরিচিত সাংবাদিকদের দুটি ইউনিয়ন গণমাধ্যম দলনের প্রতিবাদে ২৫ এপ্রিল ঢাকায় জাতীয় সাংবাদিক কনভেশন আয়োজনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

ইউনিয়ন দুটির পক্ষ থেকে দৈনিক আমার দেশ, দিগন্ত টিভি, ইসলামিক টিভিসহ বন্ধ মিডিয়া খুলে দেওয়া, আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, এনটিভির চেয়ারম্যান মোসাদ্দেক আলী, ইটিভির চেয়ারম্যান আবদুস সালাম, সাংবাদিক কনক সরওয়ারসহ কারাবন্দী সাংবাদিকদের মুক্তি এবং সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত বিভিন্ন মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়েছে।

কনভেনশন আয়োজনের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে বলা হয়, ক্ষমতাসীন সরকার ভিন্নমতের গণমাধ্যম দলনে একের পর এক গণমাধ্যম বন্ধ ও প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেই থামছে না, সাংবাদিকদের শীর্ষ সংগঠনের শীর্ষ নেতা শওকত মাহমুদের বিরুদ্ধে একের পর এক মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করছে।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়, ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামকে গ্রেপ্তারের হুমকি দেওয়া হয়েছে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে। রাজশাহীতে তিনজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে পুলিশের নাশকতার মামলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় শাসক দলের ছাত্র সংগঠনের হাতে সাংবাদিক নিগৃহীত হওয়া, নিউ এজ এর ঢাবি সংবাদদাতাকে পুলিশী নির্যাতন, ফেনী ও চুয়াডাঙ্গায় সাংবাদিকদের পিটিয়ে গুরুতর জখম করার মত সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো সাংবাদিক নেতাদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।
সাংবাদিক হত্যা ও নির্যাতনের সাম্প্রতিক তথ্য পরিসংখ্যান না থাকলেও বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে সাংবাদিক হয়রানি ও নির্যাতনের ঘটনা বেড়েই চলছে।

গণমাধ্যম উন্নয়ন সংস্থা ম্যাস-লাইন মিডিয়া সেন্টারের (এমএমসি) গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশে ২০১২ সালে ২১২টি সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনায় ৫১২ জন সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

এদের মধ্যে খুন হওয়া পাঁচ সাংবাদিক হলেন: মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার ও এটিএন বাংলার সিনিয়র রিপোর্টার মেহেরুন রুনি (সাগর–রুনী সাংবাদিক দম্পতি), যশোরের সাংবাদিক জামালউদ্দিন, নরসিংদী থেকে প্রকাশিত দৈনিক নরসিংদীর বাণী পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার তালহাদ আহম্মেদ কাবিদ ও হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ থেকে প্রকাশিত দৈনিক বিবিয়ানা পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার জুনাঈদ আহমদ।

২০১২ সালের এই পাঁচটি হত্যাকাণ্ডের একটিরও বিচার হয়নি।এমনকি দেশের অন্যতম আলোচিত সাগর–রুনি হত্যার তদন্ত সাড়ে তিন বছরেও শেষ করতে পারেনি র‍্যাব।

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) ২০১৪ সালে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনার কথা উল্লেখ করে সংস্থাটির বার্ষিক প্রতিবেদনে বলেছে, ওই বছর দুজন সাংবাদিক খুন হয়েছেন। এছাড়া, পুলিশি নির্যাতনে মৃত্যু হয় এক সাংবাদিকের।

সিপিজের বিবৃতিতে অভিযোগ করা হয়, বাংলাদেশে সাংবাদিকেরা সরকারিভাবে হয়রানির শিকার হওয়ার পাশাপাশি অন্যান্য মহল থেকেও সাংবাদিকেরা, বিশেষত ব্লগাররা হুমকির মুখে পড়ছেন।

গত প্রায় ১০ দিন ধরে সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন এবং আঞ্চলিক প্রেসক্লাবগুলো মিজানুরের মুক্তি চেয়ে বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করছে, বিবৃতি দিচ্ছে। একজন আহত সাংবাদিককে জামিন না দেওয়ায় এসব কর্মসূচী থেকে তীব্র নিন্দা জানানো হচ্ছে।             

সিপিজের বিবৃতি এবং সাংবাদিকদের কর্মসূচী চলার মধ্যে ২ এপ্রিল ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু মন্তব্য করেন, দেশের রাজনীতিবিদ ও গণমাধ্যমকর্মীদের মধ্যে সব সময়ই আইনের ঊর্ধ্বে থাকার প্রবণতা রয়েছে।

“সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা করলে বলা হয়, কণ্ঠরোধ করা হচ্ছে। মনে রাখতে হবে, আমরা সমালোচনা সহ্য করব, কিন্তু মিথ্যাচার, তথ্য বিকৃতি কিংবা উসকানি সহ্য করব না। আমরা আশা করি গণমাধ্যম শুধরে যাবে,” বললেন তথ্যমন্ত্রী। সাংবাদিকতা বিষয়ক একটি বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে তিনি একথা বলেন।

ওই অনুষ্ঠানে তথ্যমন্ত্রী আরো বলেন, অপসাংবাদিকতার মতো দুর্বলতা সত্ত্বেও গণমাধ্যম শক্তিশালী অবস্থায় রয়েছে। গণমাধ্যম প্রহরীর ভূমিকায় থাকার কারণে সরকার দুর্নীতি মোকাবিলায় সক্ষম হচ্ছে।


মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।