সোনালী আঁশের সোনালী দিন ফিরিয়ে আনার চেষ্টা

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2015.12.18
BD-jute বগুড়ায় বিলের পানিতে পাটের আঁশ ছাড়াচ্ছেন চাষীরা।
বেনার নিউজ

সোনালী আঁশের সোনালী  দিন ফিরিয়ে  আনার চেষ্টা শুরু  করেছে  সরকার, যা পাটচাষী ও পাটকলগুলোর জন্য সুসংবাদ বলে মনে করা হচ্ছে।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন সরকারের অবহেলায় একে একে পাটকলগুলো যখন বন্ধ হয়েছে ও পাটচাষে কৃষকের  আগহ কমেছে তখন নতুন উদ্যোগ এই খাত সংশ্লিষ্টদের মধ্যে আশাবাদ তৈরী  করেছে।

সরকারের  নতুন সিদ্ধান্ত  হচ্ছে এখন থেকে যে কোনো পরিমাণ ধান, চাল, গম, ভুট্টা, সার ও চিনি-এই ছয়টি পণ্য  সংরক্ষণ ও পরিবহনে বাধ্যতামূলকভাবে পাটের ব্যাগ ব্যবহার করতে হবে।

এর আগে ৩ নভেম্বর পণ্যে পাটের মোড়কের ব্যবহার নিশ্চিত করতে এবং দেশের পাটকলগুলোর জন্য পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করতে  সব ধরনের কাঁচা পাট রপ্তানি নিষিদ্ধ করে সরকার।

বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের ওই আদেশে বলা হয়, “পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন-২০১০ এর সঠিক বাস্তবায়নের জন্য পাট অধ্যাদেশ ১৯৬২ এর ৪ ও ১৩ ধারা মোতাবেক যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সব ধরনের কাচাঁ পাট রপ্তানি বন্ধ রাখা হল ।”

গত বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি বাধ্যতামূলকভাবে পাটের ব্যাগ ব্যবহারের  নির্দেশনা দেয় সরকার। গত বৃহস্পতিবার  এই নির্দেশনা পালনে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় নতুন আদেশ জারি করেছে।

বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, আইনটির বাস্তবায়ন হলে দেশের পাটকলগুলোয় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার কাজের সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং পাটকলগুলো সারা বছর সচল থাকবে।


ভ্রাম্যমাণ আদালত

ইতিমধ্যে  পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন ২০১০ অনুযায়ী, গত ৩০ নভেম্বর থেকে সারা দেশে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছে সরকার। পাটকল রয়েছে এবং যেখানে পাটের বস্তা ব্যবহার হয় এমন ৩১টি জেলায় কাজ করবে এসব টিম।  

পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন (ম্যান্ডেটরি প্যাকেজিং অ্যাক্ট ২০১০)  অনুযায়ী পাটের মোড়ক ব্যবহার না করলে অনূর্ধ্ব এক বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে।

ওই ছয়টি পণ্য সংরক্ষণ ও পরিবহনে শতভাগ পাটের বস্তা ব্যবহার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত অভিযান চলবে বলে জানানো হয়।

ধান-চালে পাটের ব্যাগ ব্যবহার না করলে খাদ্য মন্ত্রণালয় চাতাল মিল মালিকদের লাইসেন্স এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আমদানি ও রপ্তানিকারকদের লাইসেন্স বাতিল করবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক নির্দেশনা জারি করেছে, ধান, চাল, গম, ভুট্টা, সার ও চিনি ব্যবসায়ীরা পাটের ব্যাগ ব্যবহার না করলে ব্যাংক ঋণ পাবেন না।

পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র পেতে প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে মুচলেকা দিয়ে বলতে হবে যে, তারা ডব্লিউপিপি ব্যাগ উৎপাদন ও সরবরাহ করবে না।

মন্ত্রণালয়ের হিসেবে, সার্বিকভাবে দেশে বছরে প্রায় ১০ কোটি মোড়কের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি পাটকলগুলো থেকে আসবে ৪ কোটি মোড়ক; বাকিটা বেসরকারি পাটকলগুলো থেকে আসবে।

সরকারি পাটকলগুলোর কাছে এক কোটি ৪ লাখ পাটের মোড়ক (বস্তা) রয়েছে। বাকি বস্তা উৎপাদনের জন্য স্থানীয় বাজারে পাটের সরবরাহ বাড়াতে রপ্তানিতে এই নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, বেনারকে  জানান বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের তথ্য কর্মকর্তা সৈকত চন্দ্র হালদার ।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশে ৭৫ লাখ বেল (এক বেলের ওজন ১৮২ কেজি) পাট উৎপাদিত হয়েছে, যা আগের বছরের ৬৫ হাজার বেল থেকে বেশি।


সুদিন ফিরে আসার সম্ভাবনা

তবে এবার পাটের ফলন কম হওয়ায় ৬৫ লাখ বেলের কাছাকাছি পাট উৎপাদিত হতে পারে বলে কৃষক ও ব্যবসায়ীদের ধারণা।

বাংলাদেশ থেকে কাঁচা পাটের পাশাপাশি পাট সুতা, বস্তা, চট ও পাটের তৈরি বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি হয়। কাঁচা পাট বেশির ভাগটাই যায় ভারত ও পাকিস্তানে।

২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে সোয়া নয় লাখ বেল কাঁচা পাট রপ্তানি হয়।

ছয় পণ্যে পাটজাত মোড়ক ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে দেশে পাটের হারানো সুদিন ফিরে আসবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

"ম্যান্ডেটরি প্যাকেজিং অ্যাক্ট বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে দেশে পাটের সুদিন ফিরে আসবে। সরকারি-বেসরকারি পাটকলগুলো সারা বছর কর্মমুখর থাকবে। বর্তমানে আমরা যে পরিমাণ পাট রপ্তানি করি, নতুন আইনটি বাস্তবায়ন হলে সে পরিমাণ পাটের বাজার দেশেই সৃষ্টি হবে,"  বেনারকে জানান বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম ।

তিনি বলেন, পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের আইন হলেও এটি কার্যকরে অন্য মন্ত্রণালয়গুলোরও সহায়তা প্রয়োজন।  এ নিয়ে আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক হয়েছে।

বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সূত্রমতে, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের জেলায় জেলায় ডিসিরা যে মাসিক সমন্বয় সভা করেন তাতে ম্যান্ডেটরি এজেন্ডা হচ্ছে ‘ম্যান্ডেটরি প্যাকেজিং অ্যাক্ট’ ফলোআপে রাখা। গত জেলা প্রশাসক সম্মেলনেও বিষয়টি ডিসিদের বলা হয়েছে। কেবিনেট ডিভিশন থেকে এ আইন বাস্তবায়নে সরকারের বিভিন্ন দফতরকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

মির্জা আজম বলেন, কেউ এ আইন মানার বিরোধিতা করছে না। পাটের ব্যাগ ব্যবহারের মধ্যে দেশপ্রেম রয়েছে, দেশাত্ববোধ রয়েছে। এটা পরিবেশবান্ধব।

এদিকে বন্ধ পাটকলগুলো  চালু হওয়ায় পাটকল শ্রমিকদের মুখে হাসি ফুটেছে। পাটকলগুলো নতুন করে সচল হয়েছে। কিছু পাটকল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেক শ্রমিক বেকার হয়ে বাড়ি চলে গিয়েছিল। তারা অন্য পেশায় চলে যাচ্ছিল।

কেউ রিকশা চালাচ্ছে, কেউ মুদি দোকানে কাজ করছে। এখন জুট মিল এলাকাগুলোয় মাইকিং করে তাদের মিলে ডাকা হচ্ছে, তোমরা আসো, লুম বন্ধ, কাজে যোগ দাও।

" আমরা আশা করছি আগামী বছর পাটের আবাদ আরও বেশি হবে। ‘ম্যান্ডেটরি প্যাকেজিং অ্যাক্ট’ কার্যকর করা গেলে আমাদের সরকারি-বেসরকারি পাটকলগুলো সারা বছর কর্মমুখর থাকবে। পাট ফিরে পাবে সেই হারানো সুদিন,"  আশাবাদ পাট প্রতিমন্ত্রীর।


মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।