‘জেল–জুলমের ভয় পাইনা, যৌক্তিক পরিনতিতে না পৌঁছানো পর্যন্ত আন্দোলন চলবে'- সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়া
2015.03.13
জেল–জুলুম ও ফাঁসির ভয় দেখিয়ে লাভ হবে না বলে সাফ জানিয়ে দিলেন বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। শুক্রবার বিকেল পৌণে পাঁচটায় গুলশানে নিজের কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনবারের সাবেক ওই প্রধানমন্ত্রী এ মন্তব্য করেন।
গত ৩ জানুয়ারি থেকে খালেদা জিয়া নিজ কার্যালয়ে অবস্থান করছেন। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের বর্ষপূর্তির দিন থেকে লাগাতার অবরোধ এবং পরবর্তীতে হরতালের ডাক দেন তিনি। টানা ৫৩ দিন পর গতকাল তিনি সাংবাদিকদের সামনে আসেন।
দীর্ঘ প্রায় দুমাস হরতাল ও অবরোধ চলার পর খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করায় মানুষের মধ্যে কৌতুহল সৃষ্টি হয়। তিনি আন্দোলন প্রত্যাহার করবেন, না নতুন কোনও কর্মসূচী দিবেন তা নিয়ে জল্পনা–কল্পনা ছিল। গতকাল তিনি সংবাদ সম্মেলনে জানিয়ে দেন, ‘যৌক্তিক পরিণতিতে না পৌঁছানো পর্যন্ত’ আন্দোলন অব্যাহত রাখবেন।
এর ফলে দেশের অর্থনীতি, শিক্ষা ও জীবনযাত্রায় যে ক্ষতির ধারা তা অব্যহত থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
শুক্রবারের সংবাদ সম্মেলনের পর সরকার ও বিরোধী পক্ষের অনমনীয় অবস্থান আরও বেশি সুদৃঢ় হওয়ার ইঙ্গিত বলে মনে করা হচ্ছে। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকার একটি আদালত খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলে রাজনৈতিক উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে।
দুর্নীতির একটি মামলায় গরহাজির থাকায় আদালত এই পরোয়ানা জারি করে। কিন্তু সরকারের নানা চাপের মুখে আদালতে হাজিরা দিতে যাননি খালেদা। আর তাঁকে গ্রেপ্তার করলে উদ্ভূত পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে সরকার তাকে গ্রেপ্তার করছে না।
পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তাদের হাতে এসে পৌঁছেনি। আইনজীবীরা বিষয়টিকে হাস্যকর বলে আখ্যা দিচ্ছেন।
“আর কোনো সাধারণ মানুষের পরোয়ানা হলে দেখতেন, কত দ্রুত তা আদালত থেকে থানায় যায়,” বললেন প্রখ্যাত আইনজীবী ব্যারিষ্টার রফিকুল হক।
গত ১১ মার্চ জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আদালতের গ্রেপ্তারি ও তল্লাশি পরোয়ানা সংশ্লিষ্ট থানায় পৌঁছামাত্রই বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার এবং তাঁর গুলশানের কার্যালয়ে তল্লাশির আদেশ বাস্তবায়ন করা হবে।
“ক্ষমতাসীনেরা প্রতিনিয়ত আমাকে জেল-জুলুম ও ফাঁসির ভয় দেখাচ্ছে। নানা ভাবে হেনস্তা করছে।এসবে কোনো লাভ হবে না,” প্রধানমন্ত্রীর ওই বক্তব্যের জবাবে বলেন খালেদা।
তাঁর মতে, নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সকলের অংশগ্রহণে দ্রুত একটি নির্বাচনের আয়োজন করলেই কেবল চলমান সংকটের সুরাহা হবে।
খালেদা বলেন, “তথাকথিত হলেও একটি সংসদের অধিবেশন চলছে। একতরফাভাবে যে বিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনী তারা পাশ করেছে তা তারা একতরফাভাবে বাতিলও করে দিতে পারে। তাতে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের পথ খুলবে।” দৃষ্টান্ত হিসেবে খালেদা জিয়া তাঁর শাসনামলে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নিয়ম রক্ষার নির্বাচন করে সংবিধান সংশোধনের পর পদত্যাগ করার কথা উল্লেখ করেন।
দেশে গভীর সংকট চলার কথা উল্লেখ করে এর জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেই দায়ী করেন তিনি। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীও এই সংকট ও নাশকতার জন্য বিরোধী নেত্রী খালেদাকে দায়ী করে আসছেন।
সরকার ও বিরোধী জোটের এই বিরোধে নিরীহ মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। ১৩ মার্চ পর্যন্ত অবরোধের ৬৭ তম দিবসে নাশকতা, সহিংসতা ও ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন ১২১ নিরীহ মানুষ। গতকাল হতাহতদের পরিবারকে খালেদা জিয়া ‘বেদনাহত চিত্তে’ সমবেদনা জানান।
গত ১১ ফেব্রুয়ারি থেকে গুলশান কার্যালয়ে সাংবাদিক ও দলীয় নেতা–কর্মীদের প্রবেশে ‘কড়াকড়ি’ ছিল। সংবাদ সম্মেলনের কারণে শুক্রবার দুপুরের পর থেকে সাংবাদিকদের গুলশান ২ নম্বর সেকশনের ৮৬ নম্বর সড়কে খালেদা জিয়ার ওই কার্যালয়ে ঢুকতে দেয় পুলিশ।
খালেদা জিয়া বলেন, ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর শেখ হাসিনা দ্রুত নির্বাচন দেওয়ার অঙ্গীকার করেও তা রাখেননি।
তার সেই প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করে ৫ জানুয়ারির পর বিএনপির আন্দোলন থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল বলেও মন্তব্য করে ২০ দলীয় জোট নেত্রী।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, দেশ আজ গভীর সংকটে। এ সংকট রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক। আর এ সংকটের স্রষ্টা আওয়ামী লীগ এবং আরো সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে শেখ হাসিনা।
এর জবাবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছে, দেশে কোনো রাজনৈতিক সংকট নেই। দলটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে বিএনপির সঙ্গে কোনো সংলাপ বা সমঝোতা হবে না।
বিকেলে খালেদা জিয়ার বক্তব্যের পর সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় একথা জানানো হয়।
“এখন দেশে যা হচ্ছে তা কোনো রাজনৈতিক সংকট নয়। কিছু সহিংস কর্মকাণ্ড চালানো হচ্ছে। সহিংসতাকারীদের সঙ্গে কোনো সংলাপ হতে পারে না,” জানান আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ।
সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়া বলেন, “শেখ হাসিনা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে একটা সমঝোতা হলে সংসদ ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচনের অঙ্গীকারও করেছিলেন। কিন্তু যথারীতি তিনি তার সেই অঙ্গীকারও ভঙ্গ করেছেন।”
তাদের প্রতিশ্রুতির কারণে ৫ জানুয়ারি ২০১৪-এর পর আন্দোলনের কর্মসূচি স্থগিত করার কথা উল্লেখ করে খালেদা জিয়া বলেন, “কিন্তু শেখ হাসিনার কথা বিশ্বাস করে আমাদের সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া যে সঠিক ছিল না তা আমরা অচিরেই বুঝতে পারি।”