পশ্চিমা নাগরিক হত্যা, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর দাবি দেশে আইএসের কর্মকাণ্ড নেই

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2015.09.29
BD-killing গত সোমবার সন্ধ্যার দিকে গুলশানের কূটনৈতিক পাড়ায় দুর্বৃত্তের গুলিতে ইতালির নাগরিক তাবেলা সিজার (৫০) নিহত হন। ২৮ সেপ্টেম্বর,২০১৫
বেনার নিউজ

ইতালীয় এক নাগরিককে হত্যার পর আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) দায় স্বীকার নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশ সরকার এখন বলছে, দেশটিতে আইএস বা আন্তর্জাতিক কোনো জঙ্গি সংগঠনের অস্তিত্ব বা কর্মকাণ্ড নেই।

অথচ কয়েক দিন পরপর জঙ্গি তৎপরতায় জড়িত থাকার অভিযোগে র‍্যাব বা পুলিশ আইএস বা বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের নেতা বা কর্মী সন্দেহে আসামি গ্রেপ্তার করছে। পুলিশের হিসেবে এ পর্যন্ত আইএস পরিচয়ে গ্রেপ্তার হয়ে জেলে আছে কমপক্ষে ২২ জন।

আইএস এর কর্মকাণ্ড না থাকলে গ্রেপ্তার হওয়া এসব ব্যক্তি তাহলে কারা?-স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রথম আলোর একজন সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গতকাল মঙ্গলবার ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের সহায়তা নিলেন।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে নামের মিল থাকা পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান বললেন, আইএস বা আন্তর্জাতিক অন্য কোনো জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে যাঁদের ছিটেফোটা যোগসূত্র থাকে বা যারা এ ধরনের কর্মকাণ্ডে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করে, তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু এ দেশে আই এস বা অন্য কোনো আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের অস্তিত্ব বা কর্মকাণ্ড নেই।

“যেসব বিদেশি নাগরিকের এ দেশে আসা-যাওয়া আছে বা যেসব বাংলাদেশি বিদেশে বা বিশেষ কিছু দেশে থেকেছেন এবং যারা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বিদেশি নাগরিক, তাদের দিকে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর বিশেষ নজর থাকে,” সাংবাদিকদের জানান পুলিশ কমিশনার।

আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সাংবাদিকদের জানান, আইএস এর সঙ্গে টুকটাক যোগাযোগ থাকার অভিযোগে যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তারা আসলে সন্দেহভাজন। তদন্ত ও বিচারে তাদের আসল পরিচয় পাওয়া যাবে।

“এটা সত্য যে, এ পর্যন্ত বাংলাদেশে আইএস এর কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বিশ্বাসযোগ্য কোনো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি। কিন্তু বিভিন্ন সময় আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর পক্ষ থেকে এ সংক্রান্ত যেসব বক্তব্য দেওয়া হয়, তাতে ভীতসন্ত্রস্ত হওয়ার মতো কারণ থাকে,” বেনারকে জানান নিরাপত্তা বিশ্লেষক ইশফাক এলাহী চৌধুরী, যিনি ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার।

তিনি বলেন, তা ছাড়া জঙ্গিবাদের অভিযোগে শুধু গ্রেপ্তার পর্যন্ত তথ্য জানা যায়, এরপর মানুষ আর কিছু জানে না।

গত সোমবার সন্ধ্যার দিকে গুলশানের কূটনৈতিক পাড়ায় দুর্বৃত্তের গুলিতে ইতালির নাগরিক তাবেলা সিজার (৫০) নিহত হন। সিজার নেদারল্যান্ডস-ভিত্তিক আইসিসিও-বাংলাদেশ নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের একটি প্রকল্পের ব্যবস্থাপক ছিলেন। তিনি গুলশান ২ নম্বরের ৯০ নম্বর সড়ক দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। এ সময় তিন যুবক মোটরসাইকেলে তাঁকে অনুসরণ করে। একপর্যায়ে দুজন মোটরসাইকেল থেকে নেমে তাঁকে লক্ষ্য করে পরপর তিনটি গুলি ছোড়ে।


এ ঘটনার পরদিন মঙ্গলবার বেলা এগারোটা থেকে সাংবাদিকেরা ভিড় জমান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বারান্দায়। এরপর মন্ত্রী এ ঘটনা সম্পর্কে সরকারের অবস্থান তুলে ধরেন। এটা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতা কিনা, জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অবশ্য বলেন, এটা বিচ্ছিন্ন একটি ঘটনা।

সরকারের একাধিক সূত্র জানায়, স্মরণকালের মধ্যে এই প্রথম একজন পশ্চিমা নাগরিক হত্যার শিকার হওয়ায় বিব্রতকর অবস্থার মুখে পড়েছে সরকার। বিশেষ করে জঙ্গি হামলার আশঙ্কায় অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দল বাংলাদেশে আসতে আপত্তি জানানোর পরপরই এ ধরনের ঘটনায় ওই দেশটির আশঙ্কার পক্ষে যুক্তি জোরদার হয়েছে।

ইশফাক এলাহী মনে করেন, জঙ্গিবাদ প্রশ্নে বিভ্রান্তিকর তথ্য না দিয়ে সরকারের অবস্থান পরিষ্কার হওয়া উচিত। নাইলে জঙ্গিবাদ দমনের কর্মকাণ্ড ‘সাজানো নাটক’ কিনা, সেই প্রশ্ন উঠতেই থাকবে।


ইসলামিক স্টেটের দায় স্বীকার

ইতালীয় নাগরিককে হত্যা করার দায় স্বীকার করেছে জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস)। বিভিন্ন জঙ্গি গোষ্ঠীর ইন্টারনেটভিত্তিক তৎপরতা নজরদারি করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এমন ওয়েবসাইট ‘সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ’ গত সোমবার এ তথ্য জানায়।


আইএসের দাবির বিষয়টি বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনেও উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, উগ্র জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের নামে এক অনলাইন বিবৃতিতে হামলার দায় স্বীকার করা হয়েছে।

“আইএসের কথিত দাবি সত্য নাকি বিভ্রান্তিকর, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের একটি ওয়েব সাইট থেকে আইএসের হত্যার দায় স্বীকারের কথা জানানো হয়েছে। তবে কোনো সন্দেহকে তদন্তের জন্য অমূলক ভাবা হচ্ছে না,” জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

মন্ত্রী জানান, বিদেশি ওই নাগরিকের ব্যক্তিগত কোনো বিরোধ ছিল কিনা বা তিনি যে বেসরকারি সংস্থায় কাজ করতেন সেখানে কোনো বিরোধ ছিল কিনা, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

এই হত্যাকাণ্ডের কারণ সম্পর্কে পুলিশ এখন পর্যন্ত নিশ্চিত নয়-এমন তথ্য জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তাভেলা সিজারকে হত্যার কারণ সম্পর্কে এখনো কিছু জানা যায়নি। ঘটনা অনুসন্ধানে পুলিশ ছাড়াও চারটি গোয়েন্দা সংস্থা ও বিশ্বস্ত গুপ্তচরেরা কাজ করছে। এখন পর্যন্ত এটুকু বলা যায়, এটা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।


যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য তাদের নাগরিকদের সতর্ক করেছে

বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে ‘মার্কিন স্বার্থের ওপর’ জঙ্গি হামলার ‘সম্ভাব্য পরিকল্পনার’ তথ্য পাওয়ার কথা জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রও তাদের নাগরিকদের সতর্ক করেছে।  

ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস সোমবার হালনাগাদ করা ওই বার্তায় তাদের নাগরিকদের বলেছে, বাংলাদেশে জঙ্গিরা অস্ট্রেলিয়ার স্বার্থে আঘাত হানতে পারে বলে ‘নির্ভরযোগ্য নতুন’ তথ্য তারা পেয়েছে।

“এ ধরনের হামলা হলে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশের নাগরিকরাও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন।”

বার্তায় বলা হয়, “যুক্তরাষ্ট্র সরকার যেসব নতুন তথ্য পাচ্ছে তাতে ধারণা করা যায় যে, দক্ষিণ এশিয়ার জঙ্গি দলগুলো ওই অঞ্চলে মার্কিন স্থাপনা, মার্কিন নাগরিক ও মার্কিন স্বার্থের ওপর হামলার পরিকল্পনা করে থাকতে পারে।”

‘ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ায়’ পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে তাদের আঞ্চলিক নিরাপত্তা দপ্তরের অনুমতি ছাড়া বাংলাদেশে বড় ধরনের জমায়েত বা আন্তর্জাতিক হোটেলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে (যেখানে বিদেশিরা সমবেত হতে পারে) অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে।

বাংলাদেশে অবস্থানরত যুক্তরাষ্ট্রের অন্য নাগরিকদেরও একই পরামর্শ দিয়ে রেস্তোরাঁ, হোটেলসহ সব জনসমাগম স্থলে চলাফেরার ক্ষেত্রে ‘উচ্চ মাত্রায় সতর্কতা’ অবলম্বন করতে বলেছে মার্কিন দূতাবাস।

যুক্তরাজ্য সরকারও বাংলাদেশে তাদের নাগরিকদের চলাফেরা সীমিত করে আনার পরামর্শ দেয়।

যুক্তরাজ্যও বলেছে, বাংলাদেশে জঙ্গিরা পশ্চিমা স্বার্থের ওপর আঘাত হানতে পারে বলে তথ্য রয়েছে তাদের কাছে।

“জঙ্গিদের কাছ থেকে হুমকি রয়েছে। সেপ্টেম্বরের শেষদিকে বাংলাদেশে পশ্চিমা স্বার্থের ওপর জঙ্গিদের আঘাত হানার পরিকল্পনার নির্ভরযোগ্য তথ্য রয়েছে।”

‘নিরাপত্তা ঝুঁকির’ কথা জানিয়ে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দল গত শনিবার বাংলাদেশ সফর পিছিয়ে দিলে হঠাৎ করেই জঙ্গি হামলার প্রসঙ্গটি সামনে আসে।    

তার আগের দিন অস্ট্রেলিয়ার ডিপার্টমেন্ট অব ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড ট্রেড (ডিএফএটি) বাংলাদেশে ভ্রমণের বিষয়ে এক বার্তায় তাদের নাগরিকদের সতর্ক থাকতে বলে।

এরপর ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার নিরাপত্তা প্রধান শন ক্যারল নিরাপত্তা পরিস্থিতি ও পরিকল্পনা খতিয়ে দেখতে বাংলাদেশে আসেন এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে বৈঠক করেন।

তাদের আশ্বস্ত করে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, জঙ্গি হামলার আশঙ্কার বিষয়টি ভিত্তিহীন, বাংলাদেশে অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটাররা পূর্ণ নিরাপত্তা পাবে।

এরই মধ্যে ইতালীয় নাগরিককে গুলি করে হত্যার পর অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট দলের বাংলাদেশ সফর আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়ল।

গত দুই বছরে একের পর এক ব্লগার হত্যার ঘটনায় বারবার জঙ্গি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল উঠেছে, পুলিশও জোরের সঙ্গে উগ্রপন্থীদের সংশ্লিষ্টতার সন্দেহের কথা বলেছে। তবে বাংলাদেশে বিদেশি কোনো নাগরিকের জঙ্গি হামলায় খুন হওয়ার অভিযোগ এর আগে কখনো ওঠেনি।

“জঙ্গিবাদের সমস্যাটি এখন বৈশ্বিক সমস্যা। বিশ্বের কোনো দেশ এই সমস্যা থেকে মুক্ত নয়। আমাদের এখানে এটা মোকাবিলার সব ধরনের চেষ্টা চলছে এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আছে,” বেনারকে জানান ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম।


ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিন্দা

ইতালীয় নাগরিক সিজার তাভেল্লা হত্যার নিন্দা জানিয়েছেন বাংলাদেশে ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত পিয়েরে মায়াদন। মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, এটি একটি সন্ত্রাসী হামলা। বর্বর এ হামলার সঠিক তদন্ত ও সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করতে হবে।


পিয়েরে মায়াদন বলেন, এ ঘটনায় নিজেও আতঙ্কিত বোধ করছি। ইইউ রাষ্ট্রদূত বলেন, বাংলাদেশের প্রান্তিক দরিদ্রদের সহায়তা করতে এসেছিলেন তাভেল্লা। এ জন্যই তার হত্যার ঘটনা আরও বেশি উদ্বেগজনক।

সিজার যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন নেদারল্যান্ড-ভিত্তিক চার্চ কো-অপারেটিভ-আইসিসিও ইন্টারন্যাশনালের ওয়েবসাইটে মঙ্গলবার এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে তাদের সহকর্মির মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে বলা হয়,  আমরা আশা করি বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ তাঁর হত্যার তদন্ত চালিয়ে যাবে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।