হত্যার মিছিল থামছে না, নাগরিক অশান্তি বাড়ছে

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2015.10.23
BD-killing নিহত পুলিশ কর্মকর্তা ইব্রাহিম মিয়াকে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে গার্ড অব অনার দেন তার সহকর্মীরা, ২৩ অক্টোবর ২০১৫
বেনার নিউজ

একে একে চারজন ব্লগার ও দুজন বিদেশি নাগরিককে হত্যার পর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তোলপাড় হলেও সেই পরিস্থিতি অনেকটা সামলে নিয়েছে সরকার। এসব ঘটনার তদন্ত ও বিচারে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখন পর্যন্ত বেশ তৎপর।

কিন্তু দেশের ভেতরে একের পর এক এমনসব খুন ও সহিংসতা হচ্ছে যেগুলো নাগরিকদের ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলছে, সৃষ্টি করছে সামাজিক অস্থিরতা।

সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার তল্লাশি করতে গেলে ছুরিকাঘাতে পুলিশের একজন সহকারী পরিদর্শককে হত্যার পর প্রশ্ন উঠেছে—পুলিশের এই অবস্থা হলে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা কোথায়?

এ ছাড়া গতকাল শুক্রবার ভোরে কক্সবাজারে ফিল্মি কায়দায় তিনজনকে অপহরণ করা হয়েছে, যাঁরা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে এক আত্মীয়কে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে করে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বাইশারীতে ফিরছিলেন ।

গতকালই নেত্রকোনার দুর্গাপুরে অরুণ কুমার সাহা (৭৪) ও তাঁর স্ত্রী হেনা রানী সাহার (৬৫) গলাকাটা লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ । এসব নৃশংস এক বা একাধিক হত্যা ঘটছে প্রায় প্রতিদিনই।


তিনজনকে অপহরণ, মুক্তিপণ দাবি

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে এক আত্মীয়কে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে করে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বাইশারীতে ফিরছিলেন আবু তৈয়বসহ ছয়জন।

“পথে কক্সবাজারের ঈদগাঁও-বাইশারী সড়কের ঈদগড় ঢালায় পৌঁছালে একটি কালভার্টের ওপর গাছ ফেলে তাদের অ্যাম্বুলেন্স আটকায় একদল লোক । পরে তারা তিনজনকে ধরে নিয়ে চলে যায়,” টেলিফোনে জানান কক্সবাজারের ঈদগড় পুলিশ ফাঁড়ির এসআই মো. ইউসুফ।

অপহৃত তিনজন হলেন- নাইক্ষংছড়ি উপজেলার বাইশারী ইউনিয়ন পরিষদের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য আবু তৈয়ব (৪০), বাইশারীর তুফান আলী পাড়ার আবু বক্কর সিদ্দিক (২৮) ও তার বন্ধু শাহ আলম (৩২)।

অপহরণকারীরা অ্যাম্বুলেন্স চালক, রোগী আবুল ফজল ও তার স্ত্রীকে গাড়িতেই রেখে যায়।

“অপহরণকারীরা অপহৃতদের আত্মীয়-স্বজনকে ফোন করে পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেছে,” টেলিফোনে বেনারকে জানান নাইক্ষ্যংছড়ি থানার ওসি মো. আবুল খায়ের। তিনি জানান, অপহৃতদের উদ্ধারে পুলিশ অভিযান শুরু করেছে।


তল্লাশি করতে গিয়ে পুলিশ খুন  

রাজধানীর গাবতলী এলাকায় দায়িত্ব পালনকালে দারুস সালাম থানার সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) ইব্রাহিম মিয়া (৪০) দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে গত বৃহস্পতিবার খুন হয়েছেন। ছুরিকাঘাতকারী পালিয়ে যায়।

তল্লাশি চৌকিতে কর্মরত পুলিশ সদস্যদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র থাকার পরেও একজন পুলিশ কর্মকর্তার এভাবে ছুরিকাঘাতে খুন হওয়ার ঘটনায় পুলিশের তল্লাশি চৌকিগুলোরই নিরাপত্তা ও কৌশল নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

“ইব্রাহিম অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে তার দায়িত্ব পালন করছিলেন। সন্দেহভাজনদের তল্লাশির যে নির্দেশনা মাঠ পর্যায়ের পুলিশকে দেওয়া হয়েছিল তা মেনেই এএসআই ইব্রাহিম সন্দেহভাজনের ব্যাগ তল্লাশি করছিলেন। এ সময়ই অন্য একজন তাকে ছুরিকাঘাত করে,” গতকাল রাজারবাগ পুলিশ লাইনে নিহত এএসআই ইব্রাহিমের জানাজা নামাজে গিয়ে মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক সাংবাদিকদের এ কথা বলেন।

তবে তল্লাশির সময় শুধু সাহসিকতা নয়, নিজেদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও তল্লাশির কৌশলগুলো অনুসৃত হওয়া উচিত বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

একজন পুলিশ সুপার ও একজন সহকারী পুলিশ সুপার পদের কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তল্লাশি চৌকি বা রণপাহারার কৌশল সম্পর্কে পুলিশের প্রশিক্ষণে শেখানো হয়। নিয়মানুযায়ী যখন কাউকে তল্লাশির জন্য থামানো হয় তখন তার সামনে পেছনে পাহারা থাকার কথা। তবে সাধারণ অবস্থায় শহর এলাকার থানা-পুলিশের তল্লাশি চৌকিগুলো  ঢিলে-ঢালা হয়।

“তল্লাশির ক্ষেত্রে যারা তল্লাশিতে নিয়োজিত থাকবেন তাঁদের নিজেদের নিরাপত্তার বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ। আর কেউ যেন তাঁদের ওপর শক্তিপ্রয়োগ করে চলে যেতে না পারে সে ব্যবস্থা থাকতে হবে,” বেনারকে জানান পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নুরুল হুদা।

ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মুনতাসিরুল ইসলাম বলেন, “কিছু তল্লাশি চৌকিতে ব্যারিকেড থাকে। আর অস্থায়ী বা ভ্রাম্যমাণ তল্লাশি চৌকিগুলোতে হাত দিয়ে সংকেত দিয়ে যানবাহন থামানো হয়।”

তল্লাশি চৌকির জন্য তাঁদের বিশেষ কোনো উপকরণ সরবরাহ করা হয় কী না জানতে চাইলে উপকমিশনার বলেন, তাঁদের টর্চ লাইট, সংকেত বাতি, বুলেটপ্রুফ ভেস্ট, রিফ্লেক্টর ভেস্ট (আলো পড়লেই জ্বল জ্বল করে ওঠে এ ধরনের পোশাক) দেওয়া হয়।


আরও যেসব হত্যাকাণ্ড

গত কয়েক দিনে ধর্মীয় যাজক লুক সরকারকে (৫০) হত্যার চেষ্টা, বাংলাদেশের স্পর্শকাতর এলাকা বান্দরবানে দুজন পর্যটক নিখোঁজ, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের একজন সাবেক চেয়ারম্যান খিজির খানের লাশ উদ্ধার ও অস্ত্র সহ বেশ কিছু জেএমবি সদস্য আটক ও তাদের এক নেতার বোমায় নিহত হওয়ার ঘটনা সামাজিক অস্থিরতাকে আরও উসকে দিয়েছে।

ঢাকায় ইতালীয় নাগরিক তাবেলা সিজারকে হত্যার ছয় দিন পর রংপুরে একই কায়দায় জাপানি নাগরিক কুনিও হোশিকে হত্যা করা হয়। মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস) দুই বিদেশি নাগরিক কুনিও হোশি ও তাবালা সিজারকে হত্যার দায় স্বীকার করলেও বাংলাদেশ সরকার তাদের ওই দাবি মানতে রাজি নয় ।

তবে কারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে, তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চললেও তদন্তকারীরা এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি। তবে সরকার ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সন্দেহের তীর এখন বিরোধী দল বিএনপির দিকে। যদিও বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।

গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-শিক্ষককেন্দ্রে বইমেলা থেকে বের হওয়ার পর লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

আর গত ১২ মে সিলেটের সুবিদবাজার এলাকায় কর্মস্থলে যাওয়ার পথে একইভাবে খুন হন ব্লগার ও সিলেট গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক অনন্ত বিজয় দাশ। এর আগে নিহত হন ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু ও রাজিব হায়দার। এই চার হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বেশ কয়েকজন আসামি গ্রেপ্তার হলেও বিচার নিশ্চিত করতে পারেনি পুলিশ।

“ঘটনা যেমন ঘটছে, তেমনি অপরাধীদেরও খুঁজে বের করা হচ্ছে। প্রত্যেকটি ঘটনার তদন্ত করে প্রকৃত অপরাধীকে বিচারের মুখোমুখি করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব। পুলিশ সে চেষ্টা অব্যাহতে রেখেছে,” জানান ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মোনতাসিরুল ইসলাম।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলেছেন, দেশে সেই অর্থে রাজনৈতিক আন্দোলন নেই। বিরোধী দলের মাঠের কোনো কর্মসূচি নেই গত কয়েক মাস ধরে। কিন্তু দেশে সামাজিক অস্থিরতা বেড়েই চলছে।    

তাঁদের মতে, দেশে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও মাথাপিছু আয় বাড়াসহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক সূচকে অগ্রগতির পরও নাগরিক জীবনে স্বস্তি ফিরছে না। গণতন্ত্র ও সুশাসনের অভাবে হয়রানির শিকার হয়ে একদিকে মানুষের ক্ষোভ বাড়ছে, অন্যদিকে  আইন, শাসন ও বিচার ব্যবস্থার প্রতি তাদের আস্থা কমছে।


মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।