ইতালীয় নাগরিক হত্যার রহস্য উদঘাটনের দাবি পুলিশের‏

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2015.10.26
BD-killing ইতালীয় নাগরিক হত্যায় জড়িত সন্দেহে রোববার ৪ জনকে আটক করেছে পুলিশ। ২৬ অক্টোবর, ২০১৫
বেনার নিউজ

ঢাকায় ইতালীয় নাগরিক চেজারে তাভেল্লা হত্যায় জড়িত সন্দেহে চারজনকে গ্রেফতারের পর এ হত্যাকান্ডের `রহস্য উন্মোচন’র দাবি করেছে বাংলাদেশের পুলিশ। এদের মধ্যে একজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন, বাকিদেরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটদিনের পুলিশ হেফাজতে পাঠিয়েছে আদালত।

এ হত্যাকান্ডের সঙ্গে কোন জঙ্গি সংগঠনের সম্পৃক্ততা খুঁজে পায়নি পুলিশ। পুলিশের দাবী, আটকৃতরা সবাই ভাড়াটে খুনি। একজন কথিত বড় ভাইয়ের নির্দেশে এই হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। তাকেও খুঁজছে পুলিশ।

এদিকে দ্রুততার সঙ্গে ‘আসামিদের’ আটক করায় পুলিশকে সাধুবাদ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে ‘রহস্য উদাঘাটনের’ চাপে যেন কোন নিরপরাধ ব্যক্তি পুলিশের শিকারে পরিণত না হয় সেদিকটার প্রতি সচেতন থাকার কথা বলেছেন তারা।


তিনজন রিমান্ডে

পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে চারজনকে রোববার ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে আটক করা হয় বলে জানায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মুনিরুল ইসলাম। এরা হলেন তামজিদ আহম্মেদ রুবেল ওরফে শুটার রুবেল, রাসেল চৌধুরী ওরফে চাকতি রাসেল, মিনহাজুল আরেফিন রাসেল ওরফে ভাগ্নে রাসেল ওরফে কালা রাসেল এবং শাখাওয়াত হোসেন ওরফে শরীফ। এদের মধ্যে তামজিদ আহম্মেদ রুবেল হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। বাকিদের আট দিনের রিমান্ডে দিয়েছে আদালত।

পুলিশের অপরাধ তথ্য ও প্রসিকিউশন বিভাগের সহকারী কমিশনার মিরাশ উদ্দিন বলেন, তামজিদ আহম্মেদ রুবেল হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করায় তাকে বাদ দিয়ে বাকি তিনজনকে আদালতে হাজির করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের পুলিশ হেফাজতে চাওয়া হয়। শুনানি শেষে আটদিন পুলিশ হেফাজতে নেওয়ার অনুমতি দিয়েছে আদালত।’

গত ২৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার কূটনৈতিক এলাকার একটি সড়কে তাভেল্লাকে গুলি চালিয়ে হত্যা করে পালিয়ে যায় মোটর সাইকেল আরোহী দুর্বৃত্তরা। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত মোটর সাইকেলটিও জব্দ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। নেদারল্যান্ডস ভিত্তিক আইসিসিও কো-অপারেশন নামে একটি সংস্থার প্রুফ (প্রফিটেবল অপরচ্যুনিটিজ ফর ফুড সিকিউরিটি) কর্মসূচির প্রকল্প ব্যবস্থাপক ছিলেন ইতালীয় নাগরিক তাভেল্লা।

এদিকে গ্রেফতার হওয়া চারজনকে এক সংবাদ সম্মেলনে গণমাধ্যমের সামনে হাজির করে পুলিশ। তবে তাদের সঙ্গে সাংবাদিকদের কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয়নি।


‘বিদেশিরা অনিরাপদ- প্রমাণ করাই উদ্দেশ্য’

পুলিশ বলছে, হত্যাকারীদের উদ্দেশ্য ছিল সরকারকে চাপে ফেলা। সে উদ্দেশ্যে ‘বাংলাদেশে বিদেশিরা নিরাপদ নয়’  প্রমান করতে  ‘কোনো একজন শ্বেতাঙ্গকে’  হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। তারই অংশ হিসেবেই খুন করা হয় গুলশানের কূটনৈতিক এলাকায় ইতালির নাগরিক চেজারে তাভেল্লাকে।

“গ্রেফতারকৃতরা  ‘নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকার চুক্তিতে’  কথিত এক  ‘বড় ভাই’-এর নির্দেশে এ হত্যাকান্ড চালায়। দুই রাসেল ও রুবেল সরাসরি হত্যাকান্ডে অংশ নেয় এবং এ কাজে তারা শরীফের মোটরসাইকেলটি ব্যবহার করে।”- সোমবারের সংবাদ সম্মেলনে এমনটি জানান ঢাকার পুলিশ কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া।

তিনি বলেন, “নির্দিষ্টভাবে চেজারে তাভেল্লা টার্গেট ছিলেন না। নৈরাজ্য তৈরি করে আন্তর্জাতিকভাবে সরকারকে চাপে ফেলার অপকৌশল হিসেবে এই হত্যার ঘটনা ঘটানো হয়েছে।”


ক্ষমতাসীন দল ও পুলিশের একই ঈঙ্গিত

এদিকে কথিত বড় ভাই সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য দেয়নি পুলিশ। সেই বড় ভাইয়ের কোনো রাজনৈতিক পরিচয়ও গণমাধ্যমকে জানানো হয়নি। তবে বিএনপি-জামায়াত জোটের দিকে ইঙ্গিত করে পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান বলেন, “এ বছরের শুরুতে যারা মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করেছে, তারা এ ঘটনায় যুক্ত কি না- তা পুলিশ খতিয়ে দেখছে।’

তার এ বক্তব্যের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সঙ্গে মিল পাওয়া যায়। হত্যাকান্ডটির পর থেকেই এর সঙ্গে বিএনপি জামায়াত জড়িত বলে মন্তব্য করে আসছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা।


ভিন্ন তথ্য আটকৃত রাসেলের মায়ের

এদিকে অভিযুক্তদের আটকের বিষয়ে ভিন্ন তথ্য দিচ্ছে পরিবার; যা পুলিশের সঙ্গে মিলছে না। পুলিশ রোববার আটকের কথা বললেও আটককৃত রাসেল চৌধুরীর মা আফরোজা আখতার দাবি করছেন, অক্টোবরের ১০ তারিখে তার ছেলেকে দক্ষিণ বাড্ডায় নিজ বাড়ি থেকে ধরে আনা হয়। (বিবিসি)

অথচ পুলিশ বলছে, ঢাকার গুলশান এলাকা থেকে আটক হয়েছেন রাসেল।

আফরোজা আক্তার বলেন, “ডিবি পুলিশের লোক বলে পরিচয় দিয়ে তিন-চারজন লোক কোন গ্রেফতারি পরোয়ানা না দেখিয়ে শুধু তদন্তের কথা বলে রাসেলকে  সেদিন সকাল ১১টাযর দিকে ধরে নিয়ে যায়। তবে কী অভিযোগের তদন্ত তা তারা জানাননি। এ বিষয়ে স্থানীয় থানায় সাধারণ ডায়েরি করতে গেলেও পুলিশ তা গ্রহণ করেনি।”


‘বিদেশিদের পর্যাবেক্ষণে বাংলাদেশ’

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইতালীয় নাগরিক হত্যার অভিযোগে চারজনকে গ্রেফতারের খবর বিদেশিদের কিছুটা সস্তি দিলেও সার্বিক পরিস্থিতি কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে তারা।

এ বিষয়ে কূটনৈতিক বিশ্লেষক ও সাবেক রাষ্ট্রদূত মহিউদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেন, চারজনকে গ্রেফতার করা ইতালীয় নাগরিক খুনের ঘটনায় কিছুটা অগ্রগতি বটে। তবে এদের জড়িত থাকার বিষয়ে যা যা বলা হচ্ছে, তা পুরোটাই পুলিশের ভার্সন। বিচারিক কার্যক্রমের মাধ্যমে আদালতে প্রমাণিত হওয়ার পরেই আসল কারণ জানা যাবে। এমনকি পুলিশ রিমান্ডে আসামিদের স্বীকারোক্তিও গ্রহণযোগ্য নয়।”

এর মাধ্যমে নিরাপত্তা ইস্যুতে বিদেশিদের চাপ কমবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “বিদেশিরা একটি ঘটনা দিয়ে পরিস্থিতি মূল্যায়ন করবে না। সার্বিক পরিস্থিতির উপর নজর রাখছে তারা। সম্প্রতি শিয়া সম্প্রদায়ের তাজিয়া মিছিলে হামলা, দেশের বিমানবন্দরগুলোতে অতিরিক্ত নিরাপত্তা জোরদার-সবই আরো হামলা হওয়ার আশঙ্কার প্রমাণ দেয়। এসব কিছু বিবেচনায় নিয়েই পরিস্থিতি পর্যালোচনা করবে বিদেশি বন্ধুরা।”


‘গড ফাদারদের খুঁজে বের করতে হবে’

‘তাভেল্লা হত্যাকারীদের’ গ্রেফতার করতে পারায় পুলিশকে সাধুবাদ জানালেও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ ঘটনার পেছনে ইন্ধন দেওয়া গড ফাদারদেরকে খুঁজে বের করে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। এছাড়া দ্রুত রহস্য উৎঘাটন করতে গিয়ে কোন নিরপরাধ মানুষ যেন চক্রান্তের শিকার না হয় সে বিষয়টিও লক্ষ্য রাখতে হবে।

এ বিষয়ে একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক সম্পাদক সাব্বির খান বেনারকে বলেন, “এ হত্যাকান্ডের পেছনে ইন্ধন দেওয়া গড ফাদারদেরকেও বিচারের সম্মুখীন করতে হবে। না হলে বহির্বিশ্বের বিশ্বাস আদায় করা যাবে না। আমাদের দেশে ‘জজ মিয়া’ কান্ডের মত উদাহরণ রয়েছে; যেখানে ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনার দায় জজ মিয়া নামক একজন নিরপরাধ ব্যক্তির উপর চাপানো হয়। যা তৎপরবর্তি যেকোন মামলার ক্ষেত্রে প্রচন্ড বিশ্বাসহীনতার সৃষ্টি করেছে”।

তাঁর মতে, বিদেশি নাগরিক হত্যার ক্ষেত্রে যেনো এমন কোন কান্ড না ঘটে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত না এ হত্যার মোটিভ এবং অপরাধীর অপরাধ প্রমাণ করা যায়, ততক্ষণ পর্যন্ত এ হত্যাকান্ডের বিষয়ে বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করা কঠিন হবে।

তাভেল্লা হত্যার পরপরই রংপুরে খুন হন জাপানি নাগরিক হোশি কুনিও। এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে হোশি কুনিওর বাড়ির মালিক জাকারিয়া বালা, ব্যবসায়ী পার্টনার হুমায়ুন কবির হীরা, রিকশাচালক মুন্নাফ ও আলুটারি এলাকার মুরাদকে আটক করা হয়। পরে ওই ঘটনায় বিএনপি নেতাসহ দুজনকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেওয়া হয়।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।