আল কায়েদার বাংলাদেশ শাখার দুই শীর্ষ নেতাসহ ১২ জন আটক
2015.07.02

ঈদের পর রাজধানীতে নাশকতার পরিকল্পনা করার অভিযোগে আল কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশের (একিউআইএস) বাংলাদেশ শাখার দুই শীর্ষ নেতাসহ ১২ জনকে আটক করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। তবে এই অভিযানের ধরন ও বিবরণ নিয়েও যথারীতি প্রশ্ন উঠেছে, এতো জঙ্গি আসে কোথা থেকে, বিচার হয়না কেন?
র্যাবের দাবি, আটকদের মধ্যে মাওলানা মাইনুল ইসলাম ওরফে মাহিন ওরফে নানা ওরফে বদিউল (৩৫) একিউআইএস-এর বাংলাদেশ শাখার প্রধান সমন্বয়ক। একসময় তিনি হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামির (হুজি) সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। আর মুফতি জাফর আমিন ওরফে সালমান (৩৪) একিউআইএসের একজন উপদেষ্টা।
আগের মতোই এ জঙ্গি সদস্যদের আটকের কথা প্রথমে গণমাধ্যমকে জানানো হয়, র্যাবের গণমাধ্যম শাখা থেকে অপরাধ বিষয়ক প্রতিবেদকের মুঠোফোনে খুদেবার্তা (এসএমএস) পাঠিয়ে। ২ জুন দুপুরের দিকে উত্তরায় র্যাবের সদর দপ্তরে সংবাদ সম্মেলন করে অভিযানের বিষয়ে একতরফা বিবরণ তুলে ধরে র্যাব।
এ সময় জঙ্গিদের কথা বলতে দেওয়া হয়নি।
“যারা গ্রেপ্তার হচ্ছে, জেলে পাঠানো হচ্ছে এবং যে প্রক্রিয়ায় তা গণমাধ্যমকে একতরফাভাবে জানানো হচ্ছে তাতে পদে পদে প্রশ্ন ও সন্দেহ থেকে যায়,” বেনারকে জানান ঢাকা জজকোর্টের আইনজীবী ফারুক আহমেদ যিনি ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা, বিডিআর বিদ্রোহ মামলাসহ বেশ কয়েকটি জঙ্গি মামলার আইনজীবী।
তাঁর মতে, জঙ্গি গ্রেপ্তারের বিষয়গুলো স্বচ্ছ এবং এসব মামলার বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত হওয়া উচিত।
“লেখক অভিজিৎ রায় ও ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ খুন হওয়ার পর ওই জঙ্গি সংগঠনের (একিউআইএস) পক্ষ থেকেই দায়িত্ব স্বীকার করে বার্তা দেওয়া হয়েছিল,” জানান র্যাবের গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান।
র্যাব-৪ এর একটি দল ‘গোপন তথ্যের ভিত্তিতে’ ১ জুন ভোর সাড়ে ৬টার দিকে সদরঘাটে অভিযান চালিয়ে প্রথমে মাওলানা মঈনুল, মুফতি জাফর, একিউআইএস বাংলাদেশ শাখার সদস্য মো. সাইদুল ইসলাম ওরফে সাইদ তামিম (২০), মো. মোশাররফ হোসেন (১৯) ও আব্দুর রহমান বেপারীকে (২৫) আটক করে।
তাদের দেওয়া তথ্যে ওই দিন সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় খুলনা থেকে আসা একিউআইএস বাংলাদেশের সদস্য আলামিন ওরফে ইব্রাহিম (২৮), মো. মুজাহিদুল আসলাম ওরফে নকীব ওরফে শরীফ (৩১), আশরাফুল ইসলাম ওরফে আবুল হাশেম (২০), রবিউল ইসলাম ওরফে হাসান (২৮) ও মো. জাবিবুল্লাহকে (২৬) গ্রেপ্তার করা হয়।
এরপর মিরপুর ১ নম্বর সেকশনের বর্ধন বাড়ি থেকে মো. শহীদুল ইসলাম ওরফে সাগর (২৯) ও আলতাফ হোসেন ওরফে আল মামুনকে (২৬) আটক করে র্যাব।
গ্রেপ্তার হওয়া কথিত জঙ্গিদের বেশির ভাগের বাড়ি বরিশাল ও খুলনা জেলায়।
র্যাবের তথ্য অনুযায়ী, ওই বাড়িতে পাওয়া যায় আড়াই লিটার সালফিউরিক অ্যাসিড, এক কেজি সালফার, ৪০০ গ্রাম পটাশিয়াম ক্লোরাইড, ৫৫০টি মার্বেল, উগ্র মতবাদ সম্বলিত বিভিন্ন ধরনের বই, ১৬টি মোবাইল ফোন সেট, চারটি নান চাকু, পাঁচটি ছুরি, একটি চাপাতি, দুটি চায়নিজ কুড়াল, এক কার্টন দেশলাই, ১৫টি বিস্ফোরক ডিভাইস এবং ১০টি ছোট ছুরিসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম।
মুফতি মাহমুদ খান বেনারকে বলেন, “ঈদের পর রাজধানীতে নাশকতা সৃষ্টির জন্য এরা ঢাকায় জড়ো হচ্ছিল। নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য তারা মিরপুরে একটি বাসাও ভাড়া করেছিল।”
র্যাব বলছে, আটক এই জঙ্গি সদস্যরা এক সময় নিষিদ্ধ সংগঠন হুজিতে সক্রিয় ছিলেন। ব্রিটিশ হাইকমিশনারের ওপর বোমা হামলার দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হুজির শীর্ষ নেতা মাওলানা মুফতি মঈনুদ্দীন ওরফে আবু জান্দাল ওরফে মাসুম বিল্লাহ কাশিমপুর কারাগার থেকে মোবাইল ফোন ও চিঠির মাধ্যমে আত্মগোপনে থাকা এই নেতা কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
তার নির্দেশনা অনুযায়ী এই জঙ্গি সদস্যরা প্রথমে ‘দাওয়াতে তাবলিগ’ এবং পরে ‘৩১৩ বদরের সৈনিক’ নামে আত্মপ্রকাশ করার চেষ্টা চালাচ্ছিল বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।
র্যাব জানায়, ‘৩১৩ বদরের সৈনিক’ এর অর্থ জোগানদাতা রফিক নামের এক ব্যক্তি, যিনি সৌদি আরব ও দুবাই থেকে ‘ফিদাই মওলা’ নামে ফেইস বুক ব্যবহার করেন।
মুফতি মাহমুদ বলেন, “আটকেরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, আল কায়েদার বিস্তার সামনে রেখে বাংলাদেশে সর্বাত্মক কার্যক্রম শুরু হলে তারা একিউআইএসে যোগ দেবে- এটাই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য।”
“আটকেরা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ড্রেনের রড কেটে হুজি নেতা মাওলানা মাইন আমিনকে মুক্ত করার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু পরে তারা ওই পরিকল্পনা থেকে সরে এসে দেশের বিভিন্ন এলাকায় নাশকতার পরিকল্পনা করে,” দাবি করেন গণমাধ্যম শাখার ওই পরিচালক।
অন্যান্য ঘটনার মতো এই অভিযানে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলার প্রস্তুতি চলছে বলে জানায় র্যাব।
আইনজীবী ফারাক আহাদ বলেন, “আমার অভিজ্ঞতা হচ্ছে, এ ধরনের মামলা সহজে শেষ হয় না। বছরের পর বছর চলতে থাকে। জঙ্গিদের মামলায় সাক্ষি যেমন পাওয়া যায় না, তেমনি অনেক আইনজীবীরাও এই মামলা নিতে চায় না।”
“দেশে কী জঙ্গিবাদের চাষ হয়েছে? নইলে এত জঙ্গি আসে কোথা থেকে? কদিন পরপর যারা গ্রেপ্তার হয়, তারা কোথায় যায়? এদের বিচার হয় কিনা, জানা যায় না। গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচারের পর যেন দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়,” বেনারকে জানান সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মহিউদ্দিন আহমেদ।
তাঁর মতে, অবশ্য গণমাধ্যমও এ বিষয়ে আগের মতো কথা বলতে বা প্রশ্ন তুলতে পারছে বলে মনে হয় না।