জঙ্গিদের অর্থায়নের অভিযোগে তিন আইনজীবী আটক

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2015.08.19
BD-militants জঙ্গি অর্থায়নের কারণে র‍্যাব তিন আইনজীবী শাকিলা ফারজানা, মো. হাসানুজ্জামান লিটন ও মাহফুজ চৌধুরী বাপনকে গ্রেপ্তার করে। ১৯ আগষ্ট,২০১৫
বেনার নিউজ

একের পর এক ব্লগার হত্যা, বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের দায় স্বীকার আর পরে এসব অভিযোগে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ‘জঙ্গি’ আটক। কিছুদিন ধরে এটাই চলে আসছে বাংলাদেশে। তবে এবার জঙ্গি অর্থায়নের অভিযোগে সুপ্রিম কোর্টের তিন আইনজীবীকে আটক করেছে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন-র‍্যাব, যাদের একজন বিএনপি নেতার সন্তান।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি, এই তিন আইনজীবীর বিরুদ্ধে ‘শহীদ হামজা ব্রিগেড’ নামে একটি জঙ্গি সংগঠনে অর্থ যোগান দেওয়ার প্রমাণ মিলেছে। আটকৃতরা হলেন, বিএনপি দলীয় সাবেক হুইপ ও কেন্দ্রীয় তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক সৈয়দ ওয়াহিদুল আলমের মেয়ে ও জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানা, অ্যাডভোকেট মো. হাসানুজ্জামান লিটন ও অ্যাডভোকেট মাহফুজ চৌধুরী বাপন।

মঙ্গলবার রাতে ঢাকার ধানমণ্ডির একটি বাসা থেকে ব্যারিস্টার ফারজানাকে এবং আইনজীবী হাসানুজ্জামান লিটন ও মাহফুজ চৌধুরী বাপনকে ধানমণ্ডির চেম্বার থেকে আটক করা হয়। পরে তাদেরকে মামলার স্থান চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। বুধবার দুপুরে চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় র‍্যাব ৭-এর কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে আটককৃতদের জঙ্গি অর্থায়নের বিষয়টি তুলে ধরা হয়।


চারদিনের রিমান্ডে তিন আইনজীবী

গ্রেফতারের পর তিন আইনজীবীকে চট্টগ্রামের বাঁশখালি আদালতে হাজির করে লটমণি পাহাড় থেকে অস্ত্র উদ্ধারের মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে রিমান্ড আবেদন করা হয়। এরপর চারদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। এ বিষয়ে র‍্যাবের চট্টগ্রাম জোনের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মিফতাহ উদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেন, “বাঁশখালী থানায় দায়ের হওয়া অস্ত্র মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আমরা সাতদিনের রিমান্ড চেয়েছিলাম। আদালত শুনানি শেষে চারদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন।”


‘অশনি শংকেত’

এদিকে জঙ্গি অর্থায়নের সঙ্গে আইনজীবীদের সংশ্লিষ্টতার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তিনি বেনারকে বলেন, এটা একটি অশনি সংকেত। যে তথ্য এসেছে তা খুবই উদ্বেগের বিষয়। আমরা আইনজীবীরা কোনোদিনই চরমপন্থায় ছিলাম না। জঙ্গি কার্যক্রমে আইনজীবীদের অর্থায়ন বিষয়টি নতুন দেখা যাচ্ছে।”

তবে বিষয়টি এখনো তদন্তাধীন থাকায় এর বেশি মন্তব্য করতে চাননি সরকারের এই প্রধান কৌঁসুলি।


তিনজনের লেনদেন ১ কোটি ৮ লাখ টাকা

সংবাদ সম্মেলনে কর্নেল মিফতাহ জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি শাখা রয়েছে যারা বিভিন্ন অর্থ কোথায়, কীভাবে লেনদেন হচ্ছে এ বিষয়টি নিয়ে কাজ করে। তাদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে তদন্ত করে আদালতের নির্দেশনা নিয়ে অর্থ যোগানদাতাদের চিহ্নিত করা হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, শহীদ হামজা ব্রিগেডের বিভিন্ন নেতাদের অ্যাকাউন্টে মোট ১ কোটি ৩৮ লাখ ৭০ হাজার টাকা জমা হয়েছে। এর মধ্যে গ্রেফতার হওয়া তিন আইনজীবী দিয়েছেন ১ কোটি ৮ লাখ টাকা, যার মধ্যে ব্যারিস্টার ফারজানা শাকিল ৫২ লাখ, অ্যাডভোকেট লিটন ৩১ লাখ ও অ্যাডভোকেট বাপন দিয়েছেন ২৫ লাখ টাকা।

এর সঙ্গে আল্লামা লিবদি নামে একজন দুবাইয়ের নাগরিকও জড়িত থাকার বিষয় জানা গেছে বলে এই র‍্যাব কর্মকর্তার দাবি।


জঙ্গি অর্থায়ন নয়, মামলার ফিস-দাবি আসামিপক্ষের

আটক তিন আইনজীবীদের পক্ষ থেকে র‍্যাবের আনা অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। তাদের দাবি, মামলার ফিস আদান-প্রদানের অর্থকেই জঙ্গি অর্থায়ন বলা হচ্ছে।

শাকিলা ফারজানার আইনজীবী অ্যাডভোকেট আব্দুস সাত্তার বেনারকে বলেন, “শাকিলা একজন পেশাদার আইনজীবী। কে হেফাজত, কে জঙ্গি, কে হামজা ব্রিগেড তা চেনেন না। ঢাকায় হেফাজতের বিরুদ্ধে যেসব মামলা আছে সেগুলো তিনি পরিচালনা করেন। বাঁশখালীর লটমণি পাহাড় থেকে অস্ত্র উদ্ধারের মামলার এক আসামিও শাকিলার সঙ্গে নিয়মিত হেফাজতের মামলার বিষয়ে যোগাযোগ রাখেন।  কয়েকটি মামলায় আসামিদের জামিন করানোর জন্য আইনজীবী হিসেবে তিনি এক তদবিরকারকের কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়েছিলেন। কিন্তু জামিন না হওয়ায় ওই টাকা শাকিলা ফেরত দেন। সেই টাকা জঙ্গি কার্যক্রমের জন্য দেয়া হয়েছে অভিযোগ করে শাকিলাকে তার দুই জুনিয়রসহ গ্রেফতার করা হয়েছে”।


জঙ্গিদের তথ্যের ভিত্তিতেই আটক

র‌্যাবের সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, গত ১৯ ফ্রেরুয়ারি হাটহাজারী আল মাদ্রাসাতুল আবু বকর ও ২১ ফ্রেরুয়ারি বাঁশখালীতে জঙ্গি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং ২৮ ফ্রেরুয়ারি নগরীর হালিশহর এলাকায় একটি বাড়িতে বিস্ফোরক মজুদের আস্তানায় অভিযান চালানো হয়। এ সময় ২৯ জনকে আটক করা হয়। এদের মধ্যে ২৮ জন জবানবন্দি দিয়েছেন। তারা জঙ্গি তৎপরতায় অর্থ যোগানদাতা হিসেবে তিন আইনজীবীর জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এ তিন আইনজীবীকে আটক করা হয়েছে।

মিফতাহ উদ্দিন আহমেদ দাবি করেন, মিয়ানমানের রোহিঙ্গাদের অবমাননা ও তাদের নির্যাতনের বিষয়টিকে সামনে এনে জিহাদে উদ্বুদ্ধ করে ছাত্র-যুবকদের সংগঠনের পতাকাতলে জড়ো করত জঙ্গিরা। বিভিন্ন স্থানে নাশকতার চেষ্টা চালাত তারা।


এপ্রিলে সন্ধান মেলে শহীদ হামজা ব্রিগেডের

চলতি বছরের এপ্রিলে নতুন জঙ্গি সংগঠন শহীদ হামজা ব্রিগেডের সন্ধান পাওয়ার কথা জানায় র‌্যাব। সেসময় র‌্যাব জানায়, সংগঠনটির তিনটি সামরিক উইং আছে। এগুলো হচ্ছে, গ্রিন, ব্লু এবং হোয়াইট। প্রত্যেক উইংয়ে সাতজন করে সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সদস্য আছেন। ২০১৩ সালের নভেম্বরে চট্টগ্রাম নগরীর ফয়েস লেকে একটি রেস্টুরেন্টে সভা করে এই জঙ্গি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটান সংগঠকরা।

বুধবার র‌্যাব জানায়, এ জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে অনেকেই জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলামের সাবেক সদস্য। এ ছাড়া মাদ্রাসার ছাত্র ও সাধারণ যুবকরাও রয়েছে। “লাভ ফর রোহিঙ্গা” (এলএফআর) নাম দিয়ে একটি এনজিওর আদলে শহীদ হামজা ব্রিগেড তাদের কাজ শুরুর পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু সফল হয়নি। এ সংগঠনের বেশ কিছু নেতাকে আটক করা গেলেও এখনো অনেকেই পলাতক।

তবে তাদের ধরতে এবং অর্থের উৎস ও যোগানদাতাদের শনাক্ত করতে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করে যাচ্ছে বলেও র‍্যাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।