আইন সংশোধন হলেও অর্পিত সম্পত্তি পায়নি ৯ লাখ দাবিদারের কেউই

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2015.06.10
BD-minority অর্পিত সম্পত্তি ফিরে পেতে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় মানববন্ধন করছেন। জুন,২০১৫
বেনার নিউজ

দুই বছরে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনের সংশোধন হয়েছে ছয়বার।এই সময়ে বিভিন্ন পর্যায়ের ট্রাইব্যুনাল ও কমিটিতে মামলা ও আবেদন পড়েছে প্রায় নয় লাখ। কিন্তু আজ পর্যন্ত একজন দাবিদারও সম্পত্তি ফেরত পাননি।

“অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ প্রক্রিয়া ঘুষ-দুর্নীতি ও মানুষ হয়রানির একটি উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে,” বেনারকে জানান বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশ গুপ্ত।

তাঁর অভিযোগ, অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণে প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছা নস্যাৎ করার জন্য পরিকল্পিতভাবে আমলাতান্ত্রিক বিঘ্ন সৃষ্টি করছেন সরকারেরই একশ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী।

আইন ও ভূমি মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২০০১ সালের অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন পাস হয়। এরপর ২০১১ সাল থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে আইনটি ৬ বার সংশোধন হয়।  

“গত দুবছরের মধ্যে আমরা আশা করেছিলাম ভুক্তভোগী জনগোষ্ঠী ছয় দশকের অব্যাহত যন্ত্রণা থেকে চিরতরে মুক্তি পাবে, অর্পিত সম্পত্তির মালিকানা ফিরে পাবে। কিন্তু উল্টো আরও যন্ত্রণা বেড়েছে,” বেনারকে জানান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) সি আর দত্ত।


১৯৬৫ সালে ভারত–পাকিস্তান যুদ্ধের পর এ অঞ্চলের যেসব সংখ্যালঘু দেশ ছেড়ে যায় সরকার তাদের জমিজমা শত্রু সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করে। এরপর সরকার ওই সব জমি অধিগ্রহণ করে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর শত্রু সম্পত্তির নাম দেওয়া হয় অর্পিত সম্পত্তি।

১৯৭৪ সালের ২৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকার অর্পিত সম্পত্তি আইন বাতিল করে। ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমান বাতিল ঘোষিত আইনটি পুনরুজ্জীবিত করে। তখন থেকে শুরু হয় হিন্দুদের নামে সম্পত্তি দেখালে তা অর্পিত সম্পত্তি ঘোষণার প্রবণতা।

এরপর থেকে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণের দাবি জানিয়ে আসছে সংখ্যালঘুরা। ২০১১ সালে বর্তমান সরকার ওই আইন জাতীয় সংসদে পাস করে। এরপর শুরু হয় নতুন টানাপোড়েন।

আমলারই অর্পিত সম্পত্তির দুটি তালিকা তৈরি করে। একটি ‘ক’ এবং আরেকটি ‘খ’ তফসিল। সরকারের খাতাপত্রে অর্পিত সম্পত্তি হিসাবে দেখানো থাকলেও প্রকৃতপক্ষে ব্যক্তির দখলে থাকা ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি ‘খ’ তালিকায় দেখানো হয়।

এরপর থেকে ‘খ’ তফসিলভুক্ত সম্পত্তি নিয়ে একধরনের অরাজকতা শুরু হয়। আন্দোলন ও দাবির মুখে সরকার ‘খ’ তফসিল বাতিল করে গত বছরের ১৪ জুলাই ভূমি মন্ত্রণালয় পরিপত্র জারি করে।

এতে বলা হয়, ‘খ’ তফসিলভুক্ত যেসব সম্পত্তির ভোগদখলকারী এক বছরের মধ্যে তাঁদের মালিকানার সমর্থনে বৈধ প্রমাণপত্র ও দলিলাদি উপস্থাপনে ব্যর্থ হবেন, তাঁদের সম্পত্তি রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০-এর ৯২ ধারামতে খাস ঘোষণা করা হবে।

ওই পরিপত্র অনুযায়ী আর মাত্র দুই মাস সময় বাকি আছে মালিকানাস্বত্ব প্রমাণের। অথচ মালিকানার বৈধ প্রমাণপত্র-খতিয়ান, দলিল, সনদপত্র প্রভৃতি ভূমি অফিস থেকে সরবরাহে নানা অজুহাতে দীর্ঘ সময়ক্ষেপণ করা হচ্ছে।

‘খ’ তফসিলের সম্পত্তির মালিকানা প্রমাণের জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রে ঘোষিত সময় এক বছরের স্থলে পাঁচ বছর করতে হবে। এই সম্পত্তির খাজনা আদায় ও নাম জারির ক্ষেত্রে প্রশাসনের হয়রানি বন্ধ করতে হবে,” জানান রানা দাশ গুপ্ত।

এদিকে আমলাতান্ত্রিক বিঘ্ন সৃষ্টির উদাহরণ উল্লেখ করে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ গত ১৯ মে সংবাদ সম্মেলনে বলছে, “ ক তফসিলভুক্ত সম্পত্তি প্রত্যর্পণের আবেদন নিষ্পত্তির সময়কাল আইনে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ থাকলেও ট্রাইব্যুনাল তা মানছেন না। আবার জেলা প্রশাসকেরা আইনের ১১ ধারা অনুযায়ী ট্রাইব্যুনালের রায় বাস্তবায়ন করছেন না।”

সম্মেলনে আরও বলা হয়, আপিল ট্রাইব্যুনালে সরকার হেরে গেলেও সম্পত্তি প্রত্যর্পণে গড়িমসি করা হচ্ছে। জেলা প্রশাসকেরা অহেতুক রায় বাস্তবায়নের জন্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা চাচ্ছেন।

“আমলাতান্ত্রিক চক্রান্তের জাঁতাকলে পড়ে আইনটি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এর কারণ এ সমস্যা যত দিন থাকবে তত দিন তাদের পকেটে টাকা আসবে,” জানান বেসরকারি সংস্থা নিজেরা করির সমন্বয়কারী খুশি কবির।


আট দফা দাবি

ঐক্য পরিষদের আট দফা দাবির মধ্যে রয়েছে দ্রুত আইনটি যথাযথ বাস্তবায়ন করে ভুক্তভোগী জনগোষ্ঠীকে পরিত্রাণ দেওয়া ও আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যাবতীয় চক্রান্ত নস্যাৎ করে উদ্ভূত সমস্যাগুলো দ্রুত নিরসন করা।

২০১৪ সালের ১৪ জুলাই ভূমি মন্ত্রণালয়ের জারিকৃত পরিপত্রে উল্লেখিত ভোগদখলকারীদের মালিকানার সমর্থনে বৈধ প্রমাণপত্র উপস্থাপনের সময় ১ বছরের পরিবর্তে ৫ বছর বৃদ্ধি করা।

অন্যান্য দাবির মধ্যে রয়েছে, তফসিলভুক্ত জমির খাজনা আদায় ও নামজারির ক্ষেত্রে প্রশাসনের হয়রানি ও টালবাহানা বন্ধ করা, ভূমি অফিসসহ প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট নানা স্তরে অব্যাহত ঘুষ-বাণিজ্য ও দুর্নীতি বন্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করা, অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আবেদন নিষ্পত্তির জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনালগুলোকে আরও সক্রিয় ও সচল করা এবং আইনে নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যে তা নিষ্পত্তিতে বাধ্য করা।

আইনের ২৬ ধারা অনুযায়ী, প্রাপ্ত সরকারি সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা ও বন্দোবস্ত বিধিমালা, ২০১৫ চূড়ান্তকরণের কার্যক্রম অনতিবিলম্বে বাতিল করা, ট্রাইব্যুনালের রায় ও সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সরকারের পক্ষ থেকে ঢালাও আপিল বন্ধ করা এবং আপিল ট্রাইব্যুনালের রায় ও ডিক্রি দ্রুত বাস্তবায়ন করা।
“সব রকম চক্রান্ত নস্যাৎ করে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে। এই প্রক্রিয়ায় ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধে অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে,” বেনারকে জানান  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নিম চন্দ্র ভৌমিক।

“জানি না এ বিষয়টি নিয়ে আর কতকাল আমাদের কথা বলতে হবে,” হতাশার সঙ্গে বেনারকে জানান সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।