টাকা পাচার বাড়ছে, সুইস ব্যাংকে জমা হচ্ছে

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2015.06.23
BD-money বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার বাড়ছে, বিত্তবানরা সুইস ব্যাংকে টাকা জমাচ্ছেন। জুন, ২০১৫
বেনার নিউজ

রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ছাড়াও বিনিয়োগের পরিবেশ না থাকা এবং নিরাপত্তাহীনতার কারণে বাংলাদেশের বিত্তবানেরা টাকা পাচার করছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক অস্থিরতার বছরেই বাংলাদেশ থেকে বেশি টাকা পাচার হচ্ছে।

সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের জমা রাখা অর্থের পরিমাণ আগের তুলনায় বেড়ে যাওয়ায় এ নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। ২০১৩ সালের তুলনায় ২০১৪ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশি নাগরিকদের ৪০ দশমিক ৭২ শতাংশ অর্থ বেশি জমা হয়েছে।

গ্রাহকের তথ্য গোপন রাখা কিংবা ‘সেফ হ্যাভেন’ হিসেবে সু্ইস ব্যাংকগুলোর পরিচিতি রয়েছে। জুরিখ থেকে ১৮ জুন প্রকাশিত 'ব্যাংকস ইন সুইজারল্যান্ড ২০১৪' শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৪ সাল শেষে সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ৫০ কোটি ৬০ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা ৪ হাজার ৩০০ কোটি টাকা গচ্ছিত রয়েছে।

সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোর প্রকাশিত হিসাব বিশ্লেষণে দেখা যায়, নির্বাচনের বছরগুলোতেই সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয়েছে।

“দেশে যখন নির্বাচন আসে, তখনই অর্থ পাচার অনেক বেড়ে যায়। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা এর বড় কারণ,” জানান বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।

অর্থনীতিবিদ ও বিশিষ্ট নাগরিকেরা মনে করছেন, কয়েক বছর ধরেই দেখা যাচ্ছে, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় বিনিয়োগের যে হার রয়েছে, তার চেয়ে সঞ্চয়ের হার বেশি।

“দেশে বিনিয়োগের তুলনায় সঞ্চয়ের হার ২-৩ শতাংশ বেশি হলে পাচার তো হবেই,” বেনারকে জানান অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ।


এক বছর আগে বাংলাদেশ ব্যাংক সামান্য উদ্যোগ নিলেও দেখা গেছে, অর্থ পাচার কমার বদলে উল্টো বেড়েছে। গত বছর সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থ থাকার খবর প্রকাশিত হওয়ার পর সে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে এ বিষয়ে তথ্য চেয়ে চিঠি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

“এখনো পর্যন্ত সে অনুরোধে সাড়া পাওয়া যায়নি। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক তথ্য পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী,” বেনারকে জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক ম. মাহফুজুর রহমান।

সুদের হার কমলেও সুইস ব্যাংকে অর্থ জমা রাখার ক্ষেত্রে তার কোনো প্রভাব পড়েনি। ২০১৪ সালে সুইস ব্যাংকগুলোতে বিদেশি গ্রাহকের গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ফ্রাঁ বা ১২৬ লাখ কোটি টাকা।

“সুদের হার খুবই কম হলেও সুইস ব্যাংকে মানুষ সাধারণত অর্থ রাখে নিরাপত্তার জন্য। যারা অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন, তাদের মধ্যে সুইস ব্যাংকে অর্থ নিরাপদে রাখার প্রবণতা দেখা যায়,” জানান দেবপ্রিয়।

সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত এক দশকের মধ্যে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার বছর ২০১৩–তে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের সবচেয়ে বেশি অর্থ (৩৭ কোটি ২০ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা তিন হাজার ১৬০ কোটি টাকা গচ্ছিত ছিল)।

এর আগে সর্বোচ্চ পরিমাণ অর্থ গচ্ছিত ছিল ২০০৭ সালে, তখনো চরম রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ছিল। সে বছর সুইস ব্যাংকসমূহে বাংলাদেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ ছিল ২৪ কোটি ৩০ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা দুই হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি।

“প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল হওয়ায় বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার বাড়ছে। ব্যাংক এবং কাস্টমস কঠোরভাবে তদারকি করলে দেশের বাইরে অর্থ পাচারের প্রবণতা কমে আসবে,” জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, কর ফাঁকি, দুর্নীতি কিংবা মানি লন্ডারিংয়ের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে সে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবের তথ্য পাওয়া যায়। এর বাইরে তথ্য চাইলে সাধারণত পাওয়া যায় না।


সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে চুক্তি নেই

বাংলাদেশ ব্যাংক কয়েকটি দেশের সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদানের জন্য সমঝোতা স্মারক সই করেছে। তবে সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে এ ধরনের চুক্তি নেই।

“অর্থ পাচার রোধ শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকের একার চাওয়ার ব্যাপার নয়। বিষয়টি রাজনৈতিক,” জানান  দেবপ্রিয়।

দেবপ্রিয়র প্রশ্ন, শক্তিশালী লোকেরাই অর্থ পাচার করে। সরকার তাঁদের মুখোশ উন্মোচন করতে চায় কি না—সেটি আগে ভাবতে হবে।

বাংলাদেশি বা অন্য কোনো দেশের নাগরিক বা প্রতিষ্ঠান যদি নিজের বদলে অন্যের নামে কোনো অর্থ গচ্ছিত রেখে থাকে, তাহলে তা এই হিসাবের মধ্যে আসেনি। আর তাই এই হিসাব সুইস ব্যাংকে গচ্ছিত পাচার হয়ে যাওয়া অর্থের পূর্ণ পরিমাণও নির্দেশ করে না।

একইভাবে সুইস ব্যাংকে গচ্ছিত রাখা মূল্যবান শিল্পকর্ম, স্বর্ণ বা দুর্লভ সামগ্রীর আর্থিক মূল্যমান হিসাব করে এখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।


সমালোচনার মুখে তথ্য দিতে কিছুটা নমনীয় সুইস ব্যাংক

“আন্তর্জাতিক চাপের কারণে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোও এখন আগের মতো কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করছে না। বরং গচ্ছিত অর্থের তথ্যাদির বিষয় কিছুটা শিথিল করেছে। তাই বাংলাদেশ সরকার চাইলে সুইস সরকারের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি করতে পারে তথ্য বিনিময়ের জন্য,” সাংবাদিকদের জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ।

তিনি এ-ও বলেন, সুইস ব্যাংকে গচ্ছিত সব টাকাই পাচার হওয়া অর্থ নয়। কেননা, বিদেশে কর্মরত অনেক বাংলাদেশির বৈধ অর্থ সুইজারল্যান্ডে তাঁদের ব্যাংক হিসাবে জমা থাকে।

সুইস ব্যাংক কখনোই আমানতকারীদের তথ্য প্রকাশ করে না, টাকার পরিমাণও জানতে দেয় না। ব্যাংক টাকা জমা রাখে একটি কোড নম্বরের ভিত্তিতে। বেশ কয়েক বছর ধরেই আন্তর্জাতিকভাবে বিষয়টি নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছে সুইজারল্যান্ড।

তবে বিশ্বব্যাপী টাকা পাচার রোধে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ব্যাপকভাবে কার্যকর হওয়ায় সুইস ব্যাংক গত বছর থেকে দেশওয়ারি অর্থের পরিমাণ প্রকাশ করছে।


এক বছরে তিনগুণ পাচার বাড়ার তথ্য

বিদেশে অর্থ পাচারের ওপর তথ্য প্রকাশ করে থাকে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি বা জিএফআই। এ সংস্থার সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে বিদেশে টাকা পাচার এক বছরের ব্যবধানে তিন গুণ বেড়েছে।

২০১২ সালে দেশ থেকে ১৭৮ কোটি ডলার বা প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। এর আগের বছর ২০১১ সালে পাচার হয়েছিল ৫৯ কোটি ৩০ লাখ ডলার বা ৪৬২৫ কোটি টাকা।

রপ্তানির ক্ষেত্রে কম মূল্য দেখানো (আন্ডার ইনভয়েসিং) ও আমদানির ক্ষেত্রে বেশি মূল্য দেখানো (ওভার ইনভয়েসিং) এবং নানাভাবে পুঁজি দেশের বাইরে নেওয়ার মাধ্যমে ওই পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে বলে জিএফআই উল্লেখ করেছে ।



ভারত থেকে পাচার কমেছে

ভারতের মতো বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের একটি অংশ সুইস ব্যাংকগুলোতে জমা হয়। তবে অনেক কড়াকড়ি আরোপের কারণে ভারতীয়দের জমা রাখা অর্থের পরিমাণ আগের বছরের তুলনায় কমেছে। অবশ্য সারা বিশ্ব থেকে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে অর্থ জমা রাখার পরিমাণ বেড়েছে।

এসএনবির রিপোর্টের তথ্যমতে, সু্ইস ব্যাংকগুলোতে ২০১৪ সালে ভারতীয়দের জমা থাকা অর্থের পরিমাণ ১৮৬ কোটি ৪০ লাখ ফ্রাঁ বা প্রায় ১২ হাজার ৬২৫ কোটি রুপি।

আগের বছর এর পরিমাণ ছিল ২০২ কোটি ৭০ লাখ ফ্রাঁ বা প্রায় ১৪ হাজার কোটি রুপি। এক বছরের ব্যবধানে কমেছে ১০ শতাংশের বেশি।

ভারতে নতুন সরকার গঠনের পর পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে নানা পদক্ষেপ নেয়। সে দেশের সুপ্রিম কোর্ট এ বিষয়ে অনুসন্ধানের নির্দেশ দেয়। ভারত সরকারের সঙ্গে সুইস কর্তৃপক্ষের কিছু বিষয়ে সমঝোতাও হয়েছে।

২০১৪ সালে সুইস ব্যাংকে পাকিস্তানিদের জমা থাকা অর্থের পরিমাণ ১৩০ কোটি ফ্রাঁ। শ্রীলঙ্কার অর্থের পরিমাণ খুবই কম, মাত্র ৮ কোটি ২০ লাখ ফ্রাঁ। এ ছাড়া নেপালের ১০ কোটি ২০ লাখ, মিয়ানমারের ৬ কোটি, মালদ্বীপের ১ কোটি ৭০ লাখ এবং আফগানিস্তানের ১ কোটি ৪০ লাখ ফ্রাঁ জমা আছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।