বেড়েছে বৈধ উপায়ে অর্থ লেনদেন, প্রবাসী আয়ে নতুন রেকর্ড
2015.07.06

সদ্য শেষ হওয়া অর্থবছরে প্রবাসী আয়ে নতুন রেকর্ড হয়েছে। প্রথমবারের মত গেল অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবাসী আয় এক হাজার ৫৩০ কোটি অর্থাৎ ১৫ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। যা এর আগের অর্থবছরের চেয়ে ৭ দশমিক ৬০ শতাংশ বেশি। জনশক্তি রপ্তানি বাড়ার পাশাপাশি বৈধ চ্যানেলে অর্থ লেনদেনের কারণেই এই রেমিটেন্স বৃদ্ধির রেকর্ড, দাবি সংশ্লিষ্টদের। আর ক্রমবর্ধমান এই রেমিটেন্স প্রবাহকে দেশের অর্থনীতির উর্ধ্বমুখি প্রবণতা হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা।
২০১৩-১৪ অর্থবছরে অর্জিত এই রেমিটেন্স এক অর্থবছরের হিসাবে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এর আগে সর্বোচ্চ রেমিটেন্স আসে ২০১২-১৩ অর্থবছরে। ওইবার দেশে রেমিটেন্স এসেছিল ১ হাজার ৪৪৬ কোটি ১১ লাখ ডলার।
প্রবাসী আয়ের ওপর ভর করে বেড়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও। গত সপ্তাহের শেষ দিনে বৃহস্পতিবার দিনের শুরুতে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৫ দশমিক ০৩ বিলিয়ন ডলার। গত ২৫ জুন প্রথমবার রিজার্ভ ২৫ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের নতুন মাইলফলকে পৌঁছায়।
রেকর্ড পরিমান রেমিটেন্সের ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক এ এফ এম আসাদুজ্জামান বলেন, “২০১৪-১৫ অর্থবছরে রেমিটেন্স এক হাজার ৫৩০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। এর আগে কখনো এই পরিমাণ রেমিটেন্স দেশে আসেনি। এবার প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ৬০ শতাংশ।”
প্রবাসী আয়ের এই প্রবাহকে ‘অর্থনীতির উর্ধ্বমুখি প্রবণতা’উল্লেখ করে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক মোস্তফা কে মুজেরি বলেন, “রেমিটেন্সের প্রবাহ প্রতিবছরই বাড়ছে। এটা সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির জন্য সুফল বয়ে আনতে পারে। প্রতিবছর রেমিটেন্স বৃদ্ধির কারণে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও বেড়েছে। যার ফলে আমরা বৈদেশিক ঋণ পাওয়াসহ অর্থনৈতিক অন্যান্য সুফল পাচ্ছি। এছাড়া সম্প্রতি বাংলাদেশ নিম্ন আয়ের দেশ থেকে মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার ক্ষেত্রেও দেশীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে এই রেমিটেন্সের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। কারণ, রেমিটেন্স দেশে আসার পরে সেটি জাতীয় গড় আয়ের সঙ্গে যোগ হয়ে যায়। এর ফলে দেশের মাথাপিছু আয়ের পরিমান বাড়ে। যেটি নিম্ন মধ্য আয়ের দেশে প্রবেশের অন্যতম মাপকাঠি।”
তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেছেন, রেমিটেন্সের পাশাপাশি প্রবৃদ্ধি বাড়াটাও জরুরি।
তিনি বেনারকে বলেন, “প্রত্যেক বছরে প্রবাসী আয় বাড়া স্বাভাবিক। নতুন করে শ্রমিক বিদেশে যাচ্ছেন, যারা বিদেশে ছিলেন তাদের আয় বেড়েছে। তবে দেখতে হবে রেমিটেন্স প্রবৃদ্ধির হার বাড়ছে কিনা। গত অর্থবছরে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি ছিল। আর এবারের রেমিটেন্স প্রবৃদ্ধির হার মাত্র ৭ শতাংশ। এটাও সন্তোষজনক নয়। তবে ক্রমবর্ধমান রেমিটেন্স অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।”
এদিকে, একক মাস হিসাবে গেল অর্থবছরের শেষ মাস জুনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৪৩ কোটি ১৭ লাখ ডলার রেমিটেন্স এসেছে। আর বর্তমানে প্রতি মাসে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের গড় দাঁড়িয়েছে ১৩২ কোটি ডলারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের মহাব্যবস্থাপক কাজী ছাইদুর রহমান বলেন, “প্রবাসীরা ২০১৪-১৫ অর্থবছরের শেষ মাস অর্থাৎ জুনে ১৪২ কোটি ডলার পাঠিয়েছেন। একক মাসের হিসাবে এই অর্থ গত অর্থবছরের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এবং এ যাবৎকালের তৃতীয় সর্বোচ্চ।”
ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিটেন্স আনতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে নানামুখি পদক্ষেপ নেওয়ায় এই প্রবাহ বেড়েছে বলে দাবি বাংলাদেশ ব্যাংকের। তারা বলছে, আগের তুলনায় অধিক সংখ্যক প্রবাসী বৈধ চ্যানেলে অর্থ পাঠাচ্ছে।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তা ছাইদুর রহমান বেনারকে বলেন, “বিভিন্ন দেশে জনশক্তি রপ্তানি বৃদ্ধি ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ পাঠানো উৎসাহিত করায় এবং মুদ্রা বিনিময় হার স্থিতিশীল থাকায় এ বছর সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স দেশে আনা সম্ভব হয়েছে।”
এ বিষয়েটি স্বীকার করে অর্থনীতিবিদ মির্জ্জা আজিজুল ইসলামও বলেন, “দেশে টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর জটিলতা এখন অনেকটাই কমানো হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হারও সহনীয়। এখন ব্যাংকের শাখাগুলোতে ফরেন এক্সচেঞ্জ বেড়েছে। তাদের সেবাও মানসম্পন্ন। এতে গ্রাহকদের হয়রানি কমেছে। শহর থেকে গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে ব্যাংকগুলোর এসব সেবা।”
মুস্তফা কে মুজেরি বলেন, “প্রবাসীদের সংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি সঠিক চ্যানেলে টাকা পাঠানোর প্রবণতা বাড়ছে। যা দেশের জন্য সত্যি সুখবর। তবে এতেই সন্তুষ্ট হলে চলবে না। আমাদের সম্ভাবনা অনেক বেশি। এখনো প্রবাসীদের বিরাট একটি সংখ্যা হুন্ডির মাধ্যমে দেশে অর্থ পাঠাচ্ছেন। যেটা বৈধ পথে আনা গেলে এই রেমিটেন্সের পরিমাণ আরো বাড়বে। যার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা সম্ভব।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ২০০৯-১০ অর্থবছরে প্রবাসী আয় এক হাজার ডলারের ঘর অতিক্রম করেছিল। ২০১০-১১ অর্থবছরে ১ হাজার ১শ কোটি ডলার, ২০১১-১২ অর্থবছরের ১ হাজার ২শ কোটি ডলার ও ২০১২-১৩ অর্থবছরে এক লাফে এক হাজার ৪৪৬ কোটি (১৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন) ডলারের রেমিটেন্স পাঠায় । তবে দীর্ঘ একযুগেরও বেশি সময় পর গত অর্থবছরে প্রবাসী আয়ে ছন্দপতন ঘটে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে প্রবাসী বাংলাদেশিরা ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে এক হাজার ৪২২ কোটি ৭০ লাখ (১৪ দশমিক ২২ বিলিয়ন) ডলারের রেমিটেন্স পাঠায়। যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ১ দশমিক ৬ শতাংশ কম।
এদিকে, প্রতিবছরই বিদেশগামী শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছে। চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত বৈধভাবে বিদেশ গেছে দুই লক্ষ ৪৪ হাজার দুইশ ৩৯ জন বাংলাদেশি।
তবে এর পাশাপাশি অবৈধভাবে বিদেশ যাওয়ার শ্রমিকের সংখ্যাও কম নয়। বিশেষ করে প্রতিবছরেই একটা বিরাট সংখ্যক বাংলাদেশি সাগর দিয়ে মালয়েশিয়া কিংবা থাইল্যান্ড পাড়ি জমাচ্ছেন। অবৈধভাবে সাগর পথে বিদেশে গিয়েও তারা দেশের রেমিটেন্স পাঠিয়ে অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছেন। অথচ এসব প্রবাসীরা আটক হওয়ার পর প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক মন্ত্রণালয় তাদের দায় নিতে অস্বীকার করে।
সম্প্রতি মালয়েশিয়া সীমান্তবর্তী থাইল্যান্ডের জঙ্গলে মানব পাচারকারীদের কয়েকটি আস্তানা এবং পাচারের শিকারদের কবরের সন্ধান মেলার পর সাগর পথে বিদেশ পাড়ি দেওয়ার বিষয়টি আন্তর্জাতিক মহলের নজর কাড়ে। এই ঘটনার পর বৈধ পথে আরো শ্রমিক নিতে আগ্রহ দেখিয়েছে মালয়েশিয়া। বাংলাদেশ থেকে আগামী তিন বছরে পনের লাখ শ্রমিক নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে দেশটি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অবৈধভাবে বিদেশ গেলেও এসব প্রবাসীরা বৈধ শ্রমিকদের মত দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখেন। যে দেশে থাকেন, সে দেশের সমস্যার মুখে না পড়লে তারাও বৈধ পথেই টাকা পাঠান। অবৈধ বলে তাদের অবদান অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই।
মির্জ্জা আজিজ বলেন, “প্রবাসীদের পাঠানো অর্থে বৈধ বা অবৈধ লেখা থাকে না। সুযোগ পেলে অবৈধ শ্রমিকরাও বৈধ চ্যানেলে অর্থ পাঠান। সেটা নির্ভর করে যে দেশে আছেন, সেখান থেকে অর্থ পাঠাতে কোন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন কিনা। তাই অবৈধদেরকে অবহেলার সুযোগ নেই। তবে বৈধপথে বিদেশ যাওয়ার জন্য সুযোগ তৈরি এবং আগ্রহ বাড়ানো উচিত।”