অনুপের বদলে নূর হোসেনকে পেল বাংলাদেশ

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2015.11.12
BD-nurhossain কলকাতায় পালিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের চাঞ্চল্যকর সাত খুনের প্রধান আসামি নূর হোসেনকে বৃহস্পতিবার রাতে ফেরত দিয়েছে ভারত।
বেনার নিউজ

উলফা নেতা অনুপ চেটিয়াকে পাওয়ার এক দিনের মধ্যে বাংলাদেশের চাঞ্চল্যকর সাত খুনের প্রধান আসামি নূর হোসেনকে ফেরত দিয়েছে ভারত, যার মাধ্যমে দুই আসামিকে নিয়ে দুই দেশের চলমান দীর্ঘ আলোচনার অবসান ঘটল।

রাত ১১টা ৩৫ মিনিটে ওপারের পেট্রাপোল বন্দর থেকে নীল রঙের একটি মাইক্রোবাসে করে নূর হোসেনকে নিয়ে ফেরেন বেনাপোল পোর্ট থানার ওসি অপূর্ব হাসান এবং বেনাপোল ইমিগ্রেশন ওসি তরিকুল ইসলাম।

বেনাপোলের ইমিগ্রেশনে উপস্থিত ছিলেন যশোরের পুলিশ সুপার অনিসুর রহমান, বিজিবি কর্মকর্তা মেজর লিয়াকত আলী, ইউএনও আব্দুস সালাম।

২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংকরোডের ফতুল্লার লামাপাড়া থেকে কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন সরকারসহ ৭ জনকে অপহরণ করা হয়। তিন দিন পর শীতলক্ষ্যা নদীতে তাঁদের লাশ পাওয়া যায়। এ ঘটনার পর ভারতে পালিয়ে যান নূর হোসেন (৫৫)।  

এরপর ১৪ জুন কলকাতার দমদম বিমানবন্দরের কাছে কৈখালি এলাকার একটি বাড়ি থেকে দুই সহযোগীসহ  নুর হোসেনকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ। সেখানেই তাঁর বিরুদ্ধে অবৈধভাবে ভারতে অবস্থানের মামলা হয়। গত মাসে ভারত সরকার সেই মামলা প্রত্যাহার করে নিলে ওই ঘাতকের দেশে ফেরার পথ সুগম হয়।

গত প্রায় ১৪ মাস পশ্চিমবঙ্গের দমদম কারাগারে রাখা হয়েছিল নূর হোসেনকে। তাকে ফেরত আনার খবরে গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকেই বেনাপোল স্থলবন্দরে জড়ো হন গণমাধ্যমের কর্মীরা।  ছিলেন প্রচুর পুলিশ, ও বিজিবি সদস্য। স্থলবন্দরের কর্মকর্তা ও কর্মীরাও সতর্ক অবস্থানে ছিলেন।

ভারতের বার্তা সংস্থা প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়ার (পিটিআই) খবরে বলা হয়, বৃহস্পতিবার বিকেলে নূর হোসেনকে দমদম কারাগার থেকে বের করা হয়। বর্ডার গার্ড অব বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ রাতে সাংবাদিকদের বলেন, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ নূর হোসেনকে বিজিবির কাছে তুলে দিয়েছে।  

স্থানীয় সাংবাদিকেরা জানান, রাত দশটার দিকে তাঁকে পেট্রোপল বন্দরে এসে নামায় ভারতীয় পুলিশ। এরপর নো ম্যানস ল্যান্ডে তারা নূর হোসেনকে বাংলাদেশের বিজিবির কাছে হস্তান্তর করে রাত ১১টা ৩৫ মিনিটে । ওই আসামির হাতে হাতকড়া ছিল। হস্তান্তরের পরে পুলিশ নূর হোসেনকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জ রওনা হয়।

গত বছরের ২৭ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড থেকে দুটি গাড়িতে থাকা সাতজন অপহৃত হন। এর মধ্যে একটি গাড়িতে ছিলেন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের দুই নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম ও তাঁর সহযোগীরা।

অন্য গাড়িতে ছিলেন নারায়ণগঞ্জ আদালতের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী চন্দন সরকার ও তাঁর গাড়ির চালক। তিন দিন পরে অপহৃতদের পেট চেরা-ইটবাঁধা লাশ ভেসে ওঠে নারায়ণগঞ্জের উপকণ্ঠে শীতলক্ষ্যা নদীতে। এ ঘটনা সারা দেশে হইচই ফেলে দেয়।

বাংলাদেশে আলোচিত হত্যা মামলার এই আসামিকে ফেরত পাঠাতে গত মাসে পশ্চিমবঙ্গের আদালতের অনুমতি মেলার পর তাকে ফেরানোর আলোচনা চলছিল। এই আলোচনা আরও জোর পায় গত বুধবার আসামের বিদ্রোহী নেতা অনুপ চেটিয়াকে বাংলাদেশ থেকে ফেরত পাঠানোর পর।

গত বুধবার বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, অনুপকে ভারতে ফেরত পাঠানোর পর নূর হোসেনও বাংলাদেশে ফেরত আসবে।


আনন্দবাজারের খবর

ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকায় গত বৃহস্পতিবার এ–সংক্রান্ত খবরের শিরোনাম ছিল ‘ফিরলেন অনুপ, হাসিনাকে ধন্যবাদ মোদীর।’

ওই খবরের শুরুতেই বলা হয়, “বাংলাদেশের কারাগারে ১৮ বছর কাটিয়ে অবশেষে ভারতে ফিরলেন এক সময়ে অসম কাঁপানো জঙ্গি সংগঠন উলফার সাধারণ সম্পাদক গোলাপ বরুয়া ওরফে অনুপ চেটিয়া। দীর্ঘ কূটনৈতিক টালবাহানার পরে গতকাল গভীর রাতে ঢাকায় কাশিমপুর কারাগার থেকে বার করে ভারতীয় দূতাবাসের হাতে তুলে দেওয়া হয় চেটিয়াকে।”

আনন্দবাজার বলেছে, বর্তমানে উলফার সঙ্গে শান্তি চুক্তি নিয়ে আলোচনা করছে ভারত সরকার। উলফার পক্ষ থেকে সেই আলোচনার নেতৃত্ব দিচ্ছেন সংগঠনের চেয়ারম্যান অরবিন্দ রাজ খোয়া। চেটিয়াকে হাতে পাওয়ায় ওই আলোচনা বাড়তি ওজন পাবে বলে মনে করছে সরকার।


প্রস্তুত নারায়ণগঞ্জ পুলিশ

সরকারের ‘উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশ’ পেয়ে বেনাপোল বন্দরের দিকে ৭ খুনের মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও ডিবির পরিদর্শক মামুনূর রশীদ রওনা হন বলে বৃহস্পতিবার রাতে বেনারকে জানান নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার খন্দকার মহিদ উদ্দিন।

তিনি বলেন, গ্রেপ্তারি পরোয়ানাসহ মামলার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রস্তুত রেখেছেন তারা।

পুলিশ জানায়, নূর হোসেনের বিরুদ্ধে সিদ্ধিরগঞ্জ ও ফতুল্লা থানায় ছয়টি হত্যা মামলাসহ ২২টি মামলা রয়েছে।

এর মধ্যে সাত খুনের প্রায় এক বছর পর গত ৮ এপ্রিল নূর হোসেন এবং র‍্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জের আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ।

লাশ উদ্ধারের পরে কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের শ্বশুর শহীদুল ইসলাম প্রথম র‍্যাবের বিরুদ্ধে ‘ছয় কোটি টাকা নিয়ে’ অপহরণ ও হত্যার অভিযোগ করেন। অর্থায়নকারী হিসেবে তিনি নূর হোসেনকে অভিযুক্ত করেন।

তদন্তেও এ ঘটনার সঙ্গে নারায়ণগঞ্জে র্যাব-১১ এ কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতা বের হয়ে আসে। জানা যায়, র‍্যাব-১১ এর তৎকালীন অধিনায়ক তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর আরিফ হোসেন, লে. কমান্ডার এমএম রানাসহ অন্যান্য সদস্যরা মিলে ওই সাতজনকে অপহরণের পরে হত্যা করে পেট চিরে লাশ নদীতে ফেলে দেয়।


কে এই নূর হোসেন?

ট্রাকের সহকারী হিসেবে জীবন শুরু করা নূর হোসেন পরে চালক হন। ১৯৯২ সালের পর তিনি কৃষক লীগের সাবেক নেতা ও পরে বিএনপির সাবেক সাংসদ গিয়াসউদ্দিনের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে যোগ দেন বিএনপিতে। সিদ্ধিরগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তিনি শামীম ওসমানের হাত ধরে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। এরপর সিদ্ধিরগঞ্জে তিনি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে থাকেন। ওই সময় তাঁর বিরুদ্ধে দাঙ্গা-হাঙ্গামাসহ ১৩টি মামলা হয়।

বাংলাদেশ ট্রাকচালক শ্রমিক ইউনিয়ন কাঁচপুর শাখার সভাপতিও হন তিনি। ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত তিনি এলাকায় ছিলেন না। ওই সময় তিনি ছিলেন পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী।

বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তাঁকে ধরিয়ে দিতে ইন্টারপোলে রেড নোটিশও পাঠানো হয়েছিল। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নবম সংসদ নির্বাচনের পর তিনি এলাকায় ফেরেন। সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতিও হন। গত বছর নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনে তিনি ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন।

কাঁচপুরে শীতলক্ষ্যা নদী দখল করে বালু-পাথরের ব্যবসা, উচ্ছেদে বাধা, পরিবহনে চাঁদাবাজিসহ নানা কারণে বারবার আলোচনায় এসেছেন তিনি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।