আউটসোর্সিংয়ে আয়ের লক্ষ্য ১০০ কোটি ডলার, ৫৫ হাজার ফ্রিল্যান্সার গড়ে তুলবে সরকার

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2015.06.01
BD-outsourcing বেসিস আউটসোর্সিং অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্তদের সঙ্গে অতিথিবৃন্দ। জুন, ২০১৩
বেনার নিউজ

বাংলাদেশে এই মুহূর্তে আউটসোর্সিং বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, দেশের ছেলে-মেয়েরা এখন বছরে আউট সোর্সিং-এর মাধ্যমে ৪৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করছে।

হাজারো তরুণ চাকরি নামের সোনার হরিণের পেছনে না ছুটে ঘরে বসেই আয় করছেন। ধীর গতির ইন্টারনেট, লোডশেডিংসহ নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও এগিয়ে  যাচ্ছে দেশের এই খাত।

সরকারের হিসেবে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী মানুষের সংখ্যা এখন বেশি, যা জনসংখ্যার প্রায় ৩২ শতাংশ।  ২০১৫- ২০১৬ সালের মধ্যে এটা ৪০ শতাংশে উন্নীত হবে।

“কোনো দেশের তরুণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা যখন আনুপাতিক হারে সবচেয়ে বেশি থাকে তখন তাকে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড  বা ডেমোগ্রাফিক বোনাস বলে। এ অবস্থাকে আবার উইন্ডোজ অব অপরচুনিটিও  বলা হয়ে থাক, যার মাধ্যমে কোনো দেশের উন্নয়নের সম্ভাবনাময় দুয়ার খুলে যেতে পারে,” বেনারকে জানান জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এ কে এম  নূর–উন–নবী।

তাঁর মতে, আউটসোর্সিং খাতকে ঠিকমতো কাজে লাগানো গেলে দেশের জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তর করা সম্ভব হবে, সমাধান হবে বেকার সমস্যার, দেশে বসেই আয় হবে বৈদেশিক মুদ্রা।

আউটসোর্সিং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আমেরিকা-ইউরোপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান অর্থ সাশ্রয়ের জন্য তাদের কাজগুলো উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোর কর্মীদের দিয়ে করিয়ে থাকে। কারণ এতে আমেরিকা ও ইউরোপের কর্মীদের তুলনায় কম অর্থ খরচ হয়। আর এ ক্ষেত্রে রয়েছে বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, শ্রীলঙ্কা, চীন, ফিলিপাইন, ভিয়েতনামের জনশক্তি।

“বাংলাদেশি একজন সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজার যেখানে প্রতি ঘণ্টার জন্য ৩ থেকে ৫ ডলার মূল্যে কাজ করেন সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের একজন ওয়েব ডেভেলপার প্রতি ঘণ্টার জন্য ৩০ থেকে ১০০ ডলার পর্যন্ত চার্জ করেন তার দক্ষতার কারণেই। এ জন্য বাংলাদেশি ফ্রিল্যান্সারদের আরও দক্ষতা অর্জন করা দরকার,” বেনারকে জানান ফ্রিলান্সার  মো. নজরুল ইসলাম, যিনি স্বাবলম্বী হয়েছেন ফ্রিল্যান্স করে।

বাংলাদেশে বর্তমানে পাঁচ শতাধিক নিবন্ধিত আউটসোর্সিং কোম্পানি রয়েছে। এগুলোর কর্মীর সংখ্যা প্রায় ২৫ হাজার। এ ছাড়া অনেকে ব্যক্তিগতভাবেও আউটসোর্সিং করে থাকেন যারা ফ্রিল্যান্সার বলে পরিচিত এবং বাংলাদেশে এই সংখ্যা প্রায় ৩৫ হাজার।

বাংলাদেশি ফ্রিল্যান্সারদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় তিনটি হলো ওডেস্ক ডটকম, ফ্রিল্যান্সার ডটকম এবং ইল্যান্স ডটকম। আউটসোর্সিংয়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্ম ওডেস্কে বাংলাদেশের সাড়ে চার লাখ তরুণ–তরণী নিবন্ধন করেছে কাজ করার জন্য। অন্যান্য প্লাটফরম মিলিয়ে কাজে আগ্রহী তরুন–তরণীর সংখ্যা প্রায় সাত লাখ। এদের প্রায় অর্ধেক সক্রিয় আছেন।

ওডেক্সের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল তৃতীয়। ওডেক্স ও ইল্যান্স একীভূত হওয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান এখন সপ্তম।

প্রবাসী আয় দ্বিগুণ হতে পারে

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, ২০১৩–১৪ অর্থ বছরে বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি শ্রমিকেরা প্রায় ১৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাঠিয়েছেন।

আর বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) এর তথ্য অনুসারে, ২০১৫ সালে সারা বিশ্বে সর্বমোট ৪৪৩ বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণের কাজ আউটসোর্স হবে। এর পাঁচ শতাংশ মার্কেট শেয়ার বাংলাদেশের প্রবাসী আয়ের চেয়েও বেশি।

তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের হিসেবে, ২০১২ সালে ৪৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ৩৬৫ কোটি টাকারও বেশি আয় করেন বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সাররা। এ বছর তা ৬৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা পাঁচ শ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে।

বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সাররা মূলত ডেটা এন্ট্রি এবং এসইও, এসইএম, এসএমএম এর কাজ বেশি করে থাকে। এ ছাড়া ওয়েবসাইট ডিজাইন এবং ডেভেলপমেন্ট, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, রাইটিং, গ্রাফিকস ডিজাইনসহ অন্যান্য কাজও করে থাকে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, এটা মূলত চুক্তিভিত্তিক কাজ। কেউ কোন একটা কাজ করাতে চাইলে তার বাজেট জানান, কত দিনের মধ্যে করতে হবে সেটা বলে দেন। সম্ভাব্য প্রার্থীরা তাদের অভিজ্ঞতা বলেন, কত টাকায় করে দিতে পারবেন সেটা জানান।

ডেটা এন্ট্রি থেকে শুরু করে জটিল প্রোগ্রাম তৈরি করা সহ নানা রকম কাজ পাওয়া যায়। কাজ দু’ভাবে করা হয় ঘন্টাভিত্তিক অথবা ফিক্সড রেট। আর এই সব কাজ পাওয়ার জন্য আছে বিভিন্ন মাধ্যম বা ওয়েবসাইট।

বেসিস আউটসোর্সিং অ্যাওয়ার্ড’

দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) দেশে পঞ্চমবারের মতো ‘বেসিস আউটসোর্সিং অ্যাওয়ার্ড’ আয়োজন করতে যাচ্ছে। সম্ভাবনাময় আউটসোর্সিং পেশার সঙ্গে যুক্ত কোম্পানি, একক ফ্রিল্যান্সার, নারী ফ্রিল্যান্সার ও জেলাভিত্তিক ফ্রিল্যান্সার বিভাগে মোট সেরা ১০০ ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানকে কাজের স্বীকৃতি হিসেবে এই অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হবে।  

“বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সাররা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। তারা এককভাবে বা কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে কাজ করছেন। কিন্তু এখন আমাদের দেশে দরকার বড় বড় প্রতিষ্ঠান উঠে আসার। ফ্রিল্যান্সারদের বড় প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে ও এই ক্ষেত্রে তাঁদের উৎসাহ বাড়াতে বেসিস আউটসোর্সিং অ্যাওয়ার্ড দিচ্ছে,” বেনারকে জানান বেসিস সভাপতি শামীম আহসান।

বেসিস আউটসোর্সিং অ্যাওয়ার্ড ২০১৫ এর আহ্বায়ক শাহ ইমরাউল কায়ীশ বলেন,  “আউটসোর্সিংকে সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে, সচেতনতা বাড়াতে ও ফ্রিল্যান্সারদের উৎসাহিত করতে এই আয়োজন। ৬৪ জেলা থেকেই এই পুরস্কার দেওয়া হবে।”

এ ছাড়াও ছয়টি আলাদা বিভাগে পুরস্কার দেওয়া হবে। কোম্পানিগুলোকে উৎসাহিত করতেও পুরস্কার দেওয়া হবে। কয়েকটি ধাপে নিবিড় পর্যালোচনা ও সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে বিজয়ী নির্বাচন করা হবে। পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রে রপ্তানির পরিমাণ, কর্মসংস্থান ও তাদের সামাজিক ভূমিকাকে প্রাধান্য দেওয়া হবে।

এবারের আয়োজনে বেসিসের সঙ্গে রয়েছে আইসিটি বিজনেস প্রমোশন কাউন্সিল (আইবিপিসি), ব্যাংক এশিয়া, ও পেওনিয়ার। গোল্ড স্পনসর বিডিজবস।

গত ২৮ মে থেকে নিবন্ধন শুরু হয়েছে এবং শেষ হবে ২১ জুন। জুন মাসের শেষ সপ্তাহে আনুষ্ঠানিকভাবে ফ্রিল্যান্সারদের হাতে পুরস্কার তুলে দেবে বেসিস।

দক্ষ ফ্রিল্যান্সার তৈরির উদ্যোগ

সরকার দক্ষ ফ্রিল্যান্সার তৈরির একটি বিশেষ প্রকল্প হাতে নিয়েছে। ‘লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং ডেভেলপমেন্ট’ নামের এই প্রকল্পের আওতায় ৫৫ হাজার দক্ষ ফ্রিল্যান্স তৈরি করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

প্রকল্পটির প্রধান উদ্দেশ্য দক্ষ ফ্রিল্যান্স তৈরির মাধ্যমে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং আউটসোর্সিং বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি। প্রকল্পটির প্রধান কার্যক্রম হবে, ইউনিয়ন পর্যায়ে ২০ হাজার নারীকে বেসিক আইটি লিটারেসি প্রশিক্ষণ প্রদান এবং ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে ২৫ হাজার জনকে আউটসোর্সিং ফ্রিল্যান্স হিসেবে গড়ে তোলার জন্য বেসিক আইটি শিক্ষা দেওয়া।

প্রকল্পের আওতায় উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে ১০ হাজার জনবলকে বিশেষায়িত আউটসোর্সিং কাজে ফ্রিল্যান্স হিসেবে গড়ে তোলার জন্য উচ্চতর আইটি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।

লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পটির মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১৮০ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এ ব্যয় সরকারি খাত থেকে মেটানো হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) মন্ত্রণালয়।

এ ছাড়া তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দিয়ে দেশে ৩৪ হাজার দক্ষ তথ্য প্রযুক্তি পেশাজীবী তৈরির প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। পাঁচটি মেয়াদে প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক ৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ দেবে। প্রকল্পে মোট ব্যয় ৫৭২ কোটি ৪৮ লাখ ৪৯ হাজার টাকা। এর মধ্যে বৈদেশিক সহায়তা ৫৭১ কোটি ৯৭ লাখ ২ হাজার এবং বাকিটা সরকারি তহবিলের।

“আমাদের লক্ষ্য আগামী পাঁচ বছরে আউটসোর্সিং খাত থেকে বার্ষিক আয় ১০০ কোটি ডলারে উন্নীত করা। পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ ১০ লাখ মানুষ তৈরি করতে চাই,” বেনারকে জানান তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক।

প্রতিমন্ত্রী জানান, বাংলাদেশে অনলাইন আউটসোর্সিং প্রসারের ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে এসব প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হলে ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে দেশ আরও এক ধাপ এগিয়ে যাবে এবং ইন্টারনেট ভিত্তিক কার্যক্রমের এক নতুন দিগন্তের সূচনা হবে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।