প্রধানমন্ত্রী বললেন, আইএসের অস্তিত্ব প্রমাণের চেষ্টা ও চাপ আছে
2015.11.09
এত দিন আওয়ামী লীগের নেতারা বিদ্যমান জাতীয় সংকট নিরসনে সংলাপ করতে বিরোধী দলের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে আসছিলেন, যার ধারাবাহিকতায় সরকার প্রধান ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ হাসিনাও এ বিষয়ে তাঁর অনাগ্রহের কথা প্রকাশ্যে জানিয়ে দিলেন।
এর পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী বললেন, বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএস আছে—এ ধরনের কিছু স্বীকার করানোর জন্য বাইরের চাপ আছে।
তাঁর মতে, “এই চাপের লক্ষ্য হচ্ছে, যদি এ ধরনের কিছু স্বীকার করানো যায়, তাহলে বাংলাদেশের ওপর তারা হামলে পড়তে পারে।”
বাংলাদেশের আইএসের অস্তিত্ব নেই মর্মে সরকারের দৃঢ় অবস্থানের অংশ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বললেন।
ঢাকা ও আশুলিয়ায় তল্লাশি চৌকিতে দুই পুলিশ হত্যা, পুরান ঢাকায় তাজিয়া মিছিলে গ্রেনেড হামলায় দুজনের মৃত্যু, একজন প্রকাশককে হত্যা ও আরেক প্রকাশকসহ তিনজনকে হত্যার চেষ্টা এবং তার আগে দুই বিদেশি নাগরিক হত্যার পর আইএস জঙ্গিরা প্রতিটি ঘটনার দায় স্বীকার করে আসছে।
এ প্রসঙ্গে জনগণের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমরা যদি সচেতন না হই, তাহলে সর্বনাশ হবে। সিরিয়া, ইরাক, মিসর, পাকিস্তান, আফগানিস্তানের মতো পরিবেশ বাংলাদেশে সৃষ্টি হোক তা আমাদের কারও কাছে কাম্য নয়। বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণ দেশ হিসেবে থাকতে চায়।”
তাঁর মতে, “এ বিষয়ে একটি ষড়যন্ত্র আন্তর্জাতিকভাবে যেমন আছে, তেমনি আমাদের দেশের কিছু মানুষও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত। চক্রান্তকারীদের বহু পরিকল্পনা আছে। তারা আরও বেশি দূর যেতে চায়।”
শেখ হাসিনা বলেন, “বিশ্বের দিকে তাকালে দেখব, এক মুসলমান আরেক মুসলমানকে হত্যা করছে। কিন্তু খেলছেটা কে? সুতাটা কার কাছে? এ ব্যাপারে মানুষকে সচেতন হতে হবে। আমরা চাই না এ ভূখণ্ড কেউ ব্যবহার করুক।”
এ প্রসঙ্গে বিএনপির মুখপাত্র আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, “সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড ‘আইএস’ ঘটিয়েছে—এমন স্বীকারোক্তির জন্য সরকারের ওপর প্রচণ্ড চাপ রয়েছে বলে জানিয়েছেন সরকার প্রধান। এ তথ্যে সমগ্র জাতি উৎকণ্ঠিত।”
“কারণ এর পরিণাম বাংলাদেশের জন্য বিপর্যয় বয়ে আনতে পারে। এ জন্য বিএনপি চায় সবাই মিলে বিপদের হুমকি মোকাবিলা করা হোক,” বেনারকে জানান রিপন।
সংলাপে বসতে চান না প্রধানমন্ত্রী
“যার হাতে মানুষ পোড়ে, তার সঙ্গে বসার কোনো ইচ্ছা আমার নেই। বাংলাদেশ এমন কোনো রাজনৈতিক সংকটে পড়ে নাই বা এত রাজনৈতিক দৈন্যতায়ও পড়ে নাই যে একজন খুনির সঙ্গে বসতে হবে,” সংবাদ সম্মেলনে জানান শেখ হাসিনা।
গত রবিবার গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া এই বক্তব্য নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা–সমালোচনা চলছে।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার লন্ডন থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে খালেদা জিয়া জাতীয় সংলাপের জন্য বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল রোববার সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “উনি বসার যোগ্যতা তখনই অর্জন করবেন, যখন বলবেন বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হওয়া উচিত।”
তিন দিনের নেদারল্যান্ডস সফরের বিষয়ে জাতিকে অবহিত করতে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এ সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, “দয়া করে আমাকে ওই খুনির (খালেদা জিয়ার প্রতি ইঙ্গিত) সঙ্গে বসতে অনুরোধ করবেন না।”
প্রধানমন্ত্রীর এই প্রত্যাখ্যানের প্রতিক্রিয়ায় সোমবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান বেনারকে বলেন, “দেশের এখনকার পরিস্থিতিতে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি খুবই প্রয়োজন। বিরোধী নেত্রী সংলাপের যে আহ্বান জানিয়েছেন, তা তো প্রধানমন্ত্রীর জানানো উচিত ছিল।”
“সরকার দেশকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে,” অভিযোগ করেন মাহবুবুর রহমান, যিনি সাবেক সেনা প্রধান ছিলেন।
সংলাপের বিষয়ে করা এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, “আপনি যদি কারও বাড়ি যান, আর সে যদি আপনার মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিয়ে আপনাকে বাড়িতে ঢুকতে না দেয়, তাহলে আপনি আবার তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করার জন্য গলাগলি করবেন?”
তিনি বলেন, “আমি রাজনীতি করলেও একজন মানুষ। আমার একটা দেশ আছে। আমার একটি দল আছে। আমার দলের সম্মানটাও বড়। আমি ওনাকে ফোন করেছিলাম বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে। সেই ফোন করে কী ধরনের কথা শুনতে হয়েছে, কত ঝাড়ি খেতে হয়েছে আপনারাই বলেন!”
“যখন সত্যিকার অর্থে জাতীয় ঐকমত্য তৈরি করার সুযোগটা এসেছিল তখন উনি সাড়া দেন নাই। উনি নির্বাচন বানচাল করার জন্য শত শত মানুষ হত্যা করেছেন। ওনার কাছে গেলেই তো পোড়া মানুষের গন্ধ পাব,” বলেন প্রধানমন্ত্রী।
“সংলাপের আহ্বান বিএনপির দুর্বলতা নয়। সরকারের সৌভাগ্য যে নির্মম-নির্যাতন চালানোর পরও সরকারের সঙ্গে সংলাপে বসার প্রস্তাব দিয়েছে বিএনপি। কিন্তু সংলাপ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য দেশবাসীকে হতাশ ও বিস্মিত করেছে,” জানান আসাদুজ্জামান রিপন।
গুপ্তহত্যার লক্ষ্য অস্থিতিশীলতা তৈরি করা
গত ৫ জানুয়ারি নির্বাচন ঠেকানো এবং এ বছরের প্রথম তিন মাস সরকার পতনের জন্য বিএনপি-জামায়াতের সহিংস কর্মকাণ্ডের বর্ণনা দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “এসব করার পরও যখন দেখেছে কিছু করা যাচ্ছে না, তখন একটি শ্রেণি নেমে পড়েছে গুপ্তহত্যায়। এর মাধ্যমে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চায় তারা।”
“আমরা দেখতে পাচ্ছি, কারা এসব করছে। যারা ধরা পড়ছে, কেউ ছাত্রজীবনে শিবির করেছে, কেউ বিএনপি করেছে। তারাই একেকটা ঘটনা ঘটাচ্ছে। এর বাইরে কিছু দেখছি না।” জানান শেখ হাসিনা।
শেখ হাসিনা বলেন, “দেশ যখন এগিয়ে যাচ্ছে, তখন বাংলাদেশ অনিরাপদ, অনিরাপদ বলে একটা কৃত্রিম আওয়াজ তোলার চেষ্টা হচ্ছে।”
তাঁর মতে, “যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিদিন কত ঘটনা ঘটছে। সে তুলনায় বাংলাদেশ অনেক নিরাপদ। ১৬ কোটি মানুষের দেশ। সেখানে একটা ঘটনা ঘটতেই পারে।”
হত্যা তালিকার শীর্ষে প্রধানমন্ত্রী
লেখক, প্রকাশক, সাংবাদিক ও রাজনীতিকদের হত্যার তালিকা-সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “হ্যাঁ, তালিকা আছে। কিন্তু এটা তো জানেন, সব তালিকার শীর্ষে আমি আছি।”
“আমি যখন ৮১ সালে দেশের মাটিতে পা দিই তখন তো খুনিরাই ক্ষমতায় ছিল। তখন আমার অবস্থা কী ছিল? বাড়ি ছিল না, একটা গাড়ি, আর্থিক সংগতি ছিল না। ২০০৭ সালে আমাকে বলা হয়েছিল, দেশে ফিরলে বিমানবন্দরে গুলি করে হত্যা করা হবে। পরোয়া করিনি। চলে এসেছি দেশের টানে, মাটির টানে,” নিজের হুমকির কথা তুলে ধরে বলেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “সরকারের যতটুকু নিরাপত্তা দেওয়ার তা দিচ্ছি। তবে প্রত্যেকের মনে সাহস থাকতে হবে। যেকোনো অবস্থা মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। রাষ্ট্র যেমন নিরাপত্তা দেবে, সেভাবে নিজেকেও সচেতন থাকতে হবে।”
লেখার বিষয়ে সতর্ক থাকুন
সরকারের কেউ কেউ লেখক-ব্লগারদের লেখালেখি বন্ধ রাখার পরামর্শ দিচ্ছেন। এতে মত প্রকাশের স্বাধীনতা প্রশ্নের মুখে পড়ছে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “ধর্ম নিয়ে বিকৃত করে লিখলে, নোংরা লেখা লিখলে তা আমার সেন্টিমেন্টে লাগবে। হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধসহ সব ধর্মের বিরুদ্ধে লিখলেও তাদের লাগবে।”
“তাই লেখার ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে এমন কথা যেন লেখা বা বলা না হয়। কেউ যদি ধর্ম মানতে না চান সেটা তার ব্যাপার। তার বিশ্বাস নিয়ে সে থাকবে। কিন্তু অন্যের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিতে পারবে না,” জানান প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “আমি খোলামেলা কথা বলি। আমি সব ধর্মকে সম্মান করি। কিন্তু আমি আমার ধর্ম পালন করি।”
বিএনপি-জামায়াতের কেউ আ.লীগে যোগদান আর না
আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে শেখ হাসিনা বলেন, “অনেক জায়গায় বিএনপি-জামায়াতের অনেকেই দলে ঢোকার চেষ্টা করছে। ঢুকেই খুন করে বলছে, এটা দলীয় কোন্দল,” জানান প্রধানমন্ত্রী।
“আমাদের যথেষ্ট লোকবল আছে, লোকজন আছে, সমর্থন আছে। বিএনপি-জামায়াতের লোকজনকে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগে নেওয়া যাবে না। এরা যেসব অপরাধ করেছে, এরা মানুষের জাত না,” মত দেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, “আজকের সংবাদ সম্মেলন থেকে বলছি, বিএনপি-জামায়াতের কেউ আমার দলে আসতে পারবে না। তাদের আমরা গ্রহণ করব না। এটা স্পষ্ট। এটা সকলকেই মেনে নিতে হবে।”
যুদ্ধাপরাধীদের রায় কার্যকর হবে
যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাম্প্রতিক বিবৃতির সমালোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী। তাদের বক্তব্যকে গর্হিত বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আমরা প্রতিবাদ করেছি। আরও প্রতিবাদ করব।...কোথায় কে কী বলল, কার পক্ষে সাফাই গাইল তাতে কিছু যায় আসে না।”
“যুদ্ধাপরাধীদের আমরা চিনি। রায় হয়ে গেছে। কার্যকরও হবে।” জানান প্রধানমন্ত্রী।
উল্লেখ্য, দুই যুদ্ধাপরাধী বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী ও জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসির রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন বিবেচনাধীন রয়েছে। সরকার মনে করছে, সাম্প্রতিক অস্থিরতা ও সহিংসতার সঙ্গে ওই দুজনের ফাঁসির ঘটনার যোগসূত্র রয়েছে।
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের জবাবে বিএনপির মুখপাত্র আসাদুজ্জামান রিপন বেনারকে বলেন, “আমরা শুরু থেকেই বলেছি, যুদ্ধাপরাধী-মানবতাবিরোধী অপরাধের সুষ্ঠু ও আন্তর্জাতিক মানের বিচার চাই এবং এ প্রশ্নে আমাদের সমর্থন রয়েছে, তারপরেও নিছক রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে শাসক দল একধরনের গোয়েবলসীয় প্রোপাগান্ডা অব্যাহত রেখেছে।”
ভাইবার সাময়িক বন্ধের ইঙ্গিত
দেশে জঙ্গি অর্থায়ন নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “কারা অর্থায়ন করছে, অবশ্যই আমরা তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। অর্থায়ন করছে একটা দল। আর মাঠে খুন-খারাবি করছে আরেকটা দল। কিছু তথ্যও পেয়েছি।”
জঙ্গি অর্থায়নে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ধরতে জটিলতার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “বাংলাদেশ ডিজিটাল করেছি। এর শুভ ফলও যেমন আছে, খারাপ ফলও আছে। জঙ্গিরা ইন্টারনেট, ভাইবার থেকে শুরু করে নানা ধরনের অ্যাপস ব্যবহার করে জঙ্গি কার্যক্রম চালাচ্ছে।”
“সে জন্য আমাদের চিন্তাভাবনা আছে, হয়তো একটা সময়ের জন্য বা কিছুদিনের জন্য এগুলো বন্ধ করে দেব,” জানান প্রধানমন্ত্রী।