চলমান রাজনৈতিক সংকট, দুপক্ষই চাইছে বিদেশীরা তাদের পক্ষে কথা বলুক

শাহরিয়ার শরীফ
2015.03.17
BD-politics যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরী সম্প্রতি সন্ত্রাস দমনে বাংলাদেশের প্রচেষ্টার প্রশংসা করেছেন। ছবিঃ জন কেরী ১৪ মার্চ ২০১৫
এএফপি


বাংলাদেশের চলমান সংকটে কূটনীতিক বা বিদেশীদের বক্তব্য বা মনোভাব প্রকাশ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। কিন্তু নিজের পক্ষে গেলেই এসব বক্তব্য গুরুত্বের সঙ্গেই বিবেচনা করছে রাজনৈতিক দলগুলো।

সাম্প্রতিক সময়ে রাজনীতি নিয়ে নিজ দলের পক্ষে যে কোনো বিদেশী মুখ খুললেই তা ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে।আর বিদেশীদের কোনো মত নিজ দলের বিপক্ষে গেলে কঠোর সমালোচনা করা হচ্ছে।

গত ১৪ মার্চ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বিদেশী কূটনীতিকদের কটাক্ষ করে বক্তব্য দেন। পশ্চিমা কূটনীতিকদের প্রতি সাংবাদিকদের আগ্রহের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এখানে উচ্চপদের কর্মকর্তারা আসেন না। তাঁরা নিজ দেশে কোনো মূল্য পান না। কিন্তু ৫০ টি টিভি চ্যানেল গিয়ে তাঁদের কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। মনে হয়, তারাই ত্রাণকর্তা।” (প্রথম আলো, ১৫ মার্চ, পৃষ্ঠা–১)

অথচ গতকাল সোমবার মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরীর বরাত দিয়ে বিভিন্ন ইতিবাচক তথ্য উত্থাপন করলেন।বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা সাংবাদিকদের জানান, বাংলাদেশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যে দায়িত্ব পালন করছে, তা প্রশংসনীয় বলে মনে করেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মন্ত্রিসভাকে জানিয়েছেন যে যুক্তরাষ্ট্র রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড হিসেবে সন্ত্রাসকে সমর্থন করে না বলে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁকে জানিয়েছেন। অন্যদিকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁকে জানিয়েছেন, রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে দেশটিতে যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চলছিল, তা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর যৌথ প্রচেষ্টায় অনেকটা স্তিমিত হয়ে এসেছে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গত ১৭ থেকে ১৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ওয়াশিংটন ডিসি সফর শেষে ঢাকায় ফিরে বেশ বিলম্বে মন্ত্রিসভার সদস্যদের একথা জানালেন ।মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে নির্দিষ্ট আলোচ্যসূচী থাকলেও এসব বক্তব্যই গণমাধ্যমে গুরুত্ব পায়।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান, “আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একমত হয়েছেন যে গণতন্ত্রে সন্ত্রাস বা চরমপন্থার কোনো সুযোগ নেই। জন কেরিও বলেছেন, আমেরিকা কখনো রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে সন্ত্রাস বা জঙ্গিবাদকে সমর্থন করে না।”

এদিকে চলমান রাজনৈতিক সংকটে প্রধান দুটি দলই বিদেশী বা কূটনীতিকদের বক্তব্য অতিরঞ্জিত করে প্রচারের চেষ্টা চালাচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে অতি উৎসাহি হয়ে বিদেশিদের মতামত ও মূল্যায়নের খণ্ডিত বিবরণ প্রচারের প্রবণতা বেড়েছে। ইউরোপীয় অতিথিদের একটি দল এ জন্য জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে সম্প্রতি তাদের হতাশা প্রকাশ করেছে।

বিদেশিদের সহানুভূতি আদায়ে বিএনপি-জামায়াতও যে কতটা বেপরোয়া তার নজির যুক্তরাষ্ট্রের ছয়জন কংগ্রেস সদস্যের বিবৃতি জাল করা। এ ছাড়া খালেদা জিয়াকে ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ টেলিফোন করেছেন মর্মে বিএনপি নেতারা অহেতুক বক্তৃতা–বিবৃতি দেন ।

আবার সরকারের বিরুদ্ধেও এমন কিছু অভিযোগ রয়েছে।গত ২২ জুলাই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠকের বিবরণী নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রকাশের পর ২৪ জুলাই ডাউনিং স্ট্রিট আলাদা বিবৃতি দেয়।ওই বিবৃতি থেকে পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে, বাংলাদেশের নির্বাচন ও গণতন্ত্র নিয়ে ডেভিড ক্যামেরন যা বলেছেন তা সঠিকভাবে প্রকাশ করেনি বাংলাদেশ সরকার।

সম্প্রতি পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের বিভ্রান্তিকর মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া এতটা কূটনৈতিক বিড়ম্বনার জন্ম দিয়েছিল যে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে মিলে একটি সম্মত সংশোধনী জারি করতে হয়েছিল।

তবে রাজনৈতিক সংকটে বিদেশীদের বক্তৃতা ও বিবৃতি এ দেশে নতুন কিছু নয়।জাতিসংঘের সহকারি মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর মধ্যস্থতায় ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত দশম নির্বাচনী সংলাপ কার্যত ব্যর্থ হয়।এর আগেও তিনি দুবার ঢাকা সফর করে সংলাপ ও সমঝোতার উদ্যোগ নেন।

১৯৯৪ সালের ১৩ অক্টোবর কমনওয়েলথ মহাসচিবের প্রতিনিধি হিসেবে স্টিফেন নিনিয়ান ঢাকা আসেন। সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগির মাধ্যমে সরকার গঠনে তাঁর প্রস্তাব আওয়ামী লীগ প্রত্যাখান করে।

জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন ২০১৪ সালের ২৫ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াকে চিঠি লিখেন। চলমান সংকটেও গত ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘ মহাসচিব দুই নেত্রীকে চিঠি লিখেছেন সহিংসতা বন্ধ এবং সংলাপ ও সমঝোতার জন্য।

২০১৩ সালের ৫ জানুয়ারির আগে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের মনোভাব ছিল, বিদেশীদের চাপেই সরকার তাদের দাবি মেনে নিবে। এখনকার সংকটেও বিএনপি জাতিসংঘসহ বিদেশীদের হস্তক্ষেপ চেয়ে আসছে।

অন্যদিকে দেশে এমন একটি ধারণা রয়েছে যে, আওয়ামী লীগের প্রতি নিকটতম প্রতিবেশী ভারতের রাজনৈতিক দল কংগ্রেসের নৈতিক সমর্থন রয়েছে। আর বিএনপির প্রতি রয়েছে বিজেপির সমর্থন।

“ভৌগলিক ও কৌশলগত কারণে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়,” এই প্রতিবেদককে জানান জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হারুন–অর–রশিদ।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. হারুন মনে করেন, বিএনপি ধারনা করেছিল, কংগ্রেসের কাছ থেকে ক্ষমতা বিজেপির হাতে গেলেই দলটি নতুন সরকারের আনুকুল্য পাবে। কিন্তু ক্ষমতা বিজেপির কাছে গেলেও বাংলাদেশ প্রশ্নে দেশটির অবস্থান আগের মতই রয়েছে।

“নিজের ঘর আমরা কীভাবে সামলাবো তা প্রতিবেশি ঠিক করে দিবে না।আমাদের ঘর আমাদেরকেই ঠিক করতে হবে,” এই প্রতিবেদককে জানান দেশের প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিষ্টার রফিকুল হক।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।