রাজনীতির আগুনে পুড়ে মরছে নিরীহ মানুষ

শাহরিয়ার শরীফ
2015.03.23
BD-politics গত ২১ মার্চ রাতে মাগুরা-যশোর মহাসড়কে বালুর ট্রাকে পেট্রলবোমা হামলায় ৯ জন শ্রমিক দগ্ধ হন। তাঁদের মধ্যে মধ্যে তিনজন মারা গেছেন, আরও তিনজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। ছবিঃ বার্ন ইউনিট, ঢামেক হাসপাতাল। ২২ মার্চ ২০১৫
বেনার নিউজ

পেট্রলবোমা হামলা কিছুটা কমে আসায় সাধারণ মানুষের মধ্যে খানিকটা স্বস্তির নিশ্বাস দেখা যাচ্ছিল। তবে কয়েক দিন ধরে এই বোমা হামলা আবার বেড়ে যাওয়ায় মানুষের উদ্বেগ–উৎকন্ঠাও বেড়েছে।

সর্বশেষ গত ২২ মার্চ সহিংসতার আগুনে পুড়ে নিহত হন চারজন নিরীহ খেটে খাওয়া মানুষ। এঁদের মধ্যে তিনজনই দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলা মাগুরার বালুশ্রমিক।

গত ১৯ মার্চ একসঙ্গে মাগুরা থেকে শালিখা উপজেলার ভাটোখালী গ্রামে ট্রাকে বালু নিয়ে গিয়েছিলেন জেলার মালিকগ্রামের নয় বাসিন্দা। বালু নামিয়ে সন্ধ্যার পর মাগুরা শহরের দিকে ফিরছিলেন তাঁরা।

“সারা দিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম শেষে খালি ট্রাকের ভেতর ক্লান্তিতে গা এলিয়ে তাঁরা ফিরছিলেন। সন্ধ্যার দিকে মাগুরা-যশোর মহাসড়কে দুর্বৃত্তরা ট্রাকটিতে দুটি পেট্রলবোমা ছোড়ে। এতে তাঁরা গুরুতর দগ্ধ হন,” জানান মাগুরা জেলা প্রশাসক মুহঃ মাহবুবর রহমান ।

দগ্ধদের মধ্যে শাকিল মোল্লা (২০), আবদুল মতিন বিশ্বাস (২৫) ও রওশন আলী (৪০) ২২ মার্চ মারা যান।

একইদিন পৃথক ঘটনায় দগ্ধ যশোরের ঝিকরগাছার ব্যবসায়ী শরীফ মারা যান। ১৯ মার্চ চালকের পাশে বসে নিজের ট্রাকে করে চট্টগ্রাম যান। সেখান থেকে চাঁদপুরের হরিণা ফেরিঘাটের দিকে যাওয়ার পথে চাঁদপুরের চান্দ্রা সড়কে রাত ১২টার দিকে দুর্বৃত্তরা ট্রাকটিতে পেট্রলবোমা ছোড়ে।

“ধার করে ট্রাক কিনেছিলেন শরীফ। ঋণ শোধ করেছেন গেল সপ্তাহে। হরতাল-অবরোধে যদি পুড়ে যাওয়ার ভয়ে বের করেননি ট্রাকটি। কিন্তু কত দিন বসে থাকবেন। তাই ঝুঁকি নিয়েই বেরিয়েছিলেন,” জানান শরীফের স্বজন শাহ সেকান্দার।

বার্ন ইউনিটের চিকিৎসকেরা জানান, মাগুরা থেকে আসা নয়জন রোগীর মধ্যে চিকিৎসাধীন আছেন ছয়জন। এঁদের মধ্যে তিনজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। ইয়াদুলের (২৫) শরীরের ৯০ শতাংশ, ইলিয়াস আলীর (৩০) শরীরের ৫০ শতাংশ এবং ইমরানের (৩০) শরীরের ৫০ শতাংশ পুড়ে গেছে।

চিকিৎসকেরা আরও জানান, বাকি তিনজনের দেহের ২০ থেকে ২৯ শতাংশ পুড়লেও তাঁরা আশঙ্কামুক্ত নন।

“এভাবে নিমর্ম ও নিষ্ঠুরভাবে মানুষ মারা বন্ধ হওয়া উচিত।এ ধরণের রোগীর দুঃসহ যন্ত্রণায় আমরাও আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ি,” জানান জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের অবৈতনিক উপদেষ্টা ডা. সামন্তলাল সেন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিট থেকে ২৩ মার্চ প্রাপ্ত সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলমান সহিংসতায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে ভর্তি হয়েছেন ১৮১জন। এঁদের মধ্যে মারা গেছে ১৯ জন। সেখানে ভর্তি আছে ২৮ জন।

এই তথ্য শুধু ঢাকা মেডিকেলের হলেও দেশের বিভাগ ও জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে নাশকতার আগুনে দগ্ধরা ভর্তি হয়েছেন।  

বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের টানা অবরোধের ৭৭তম দিন ছিল ২৩ মার্চ। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগের দাবিতে গত ৬ জানুয়ারি থেকে চলছে এ হরতাল–অবরোধ।

এই কর্মসূচী চলাকালে পেট্রলবোমা মেরে সাধারণ মানুষ হত্যার ঘটনা দেশে–বিদেশে সমালোচিত হচ্ছে।সরকার এই নৃশংসতার জন্য বিএনপি–জামায়াতকে দায়ি করছে। আর সম্প্রতি খালেদা জিয়া এ ধরণের নৃশংস কর্মকাণ্ডের জন্য সরকারকে দায়ি করে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন।

বিরোধী জোটের আন্দোলন চলাকালে ‘ক্রসফায়ারে’ ৩৩ জনসহ ২৩ মার্চ পর্যন্ত সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ১২৮ জন; আহতের সংখ্যা সহস্রাধিক। আগুন দেওয়া হয়েছে ৭৩৪টি যানবাহনে এবং ভাঙচুর করা হয়েছে ৬৬১টি।

সরেজমিন দেখা যায়, জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষনে দগ্ধ শ্রমিকরা এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন।বার্ণ ইউনিটের নিচতলায় একসঙ্গে কয়েকটি পরিবারের সদস্যরা একে অন্যের ওপর ভর করে কাঁদছিলেন। এঁরা সবাই মাগুরার মালিক গ্রামের বাসিন্দা।

তাঁদের কারও স্বজন মারা গেছেন, কেউবা মৃত্যুর প্রহর গুনছেন। আর হতভাগা শ্রমিকরা একই সঙ্গে বালুর ট্রাক নিয়ে বেরিয়েছিলেন। পেট্রলবোমায় দগ্ধ হয়ে একসঙ্গে বার্ণ ইউনিটে এসেছেন।

“ ওর কোনো ভাই নেই; ছয় বোন। কাজ শেষে চাল-ডাল কিনে ভাই বাড়ি ফিরলে সবার খাওয়া হতো,” ২৩ মার্চ বার্ণ ইউনিটে জানান দগ্ধ ইয়াদুলের চাচা তরিকুল ইসলাম।

এ ঘটনার পর মাগুরা সদর উপজেলার মালিকগ্রামে চলছে মাতম। কারণ দগ্ধ নয়জনের আটজনই মালিকগ্রামের বাসিন্দা, বাড়িও পাশাপাশি।

আবার পেট্রলবোমায় দগ্ধ শ্রমিকদের চারজনই একই পরিবারের ভাই বা ভাতিজা। তাঁরা হলেন নিহত রওশন আলী ও আবদুল মতিন,  তাঁর ভাই দগ্ধ ইলিয়াস বিশ্বাস এবং ও  আরব আলী।

“ খুব সকালে বার (বের) হয়। বালির কাজ করে দিনি ৩০০ টাকা পায়। তাই দিয়েই কষ্টে সংসার চালাই। এখন আমার সব শেষ। কীভাবে আমরা বাঁচপো?” জানান নিহত আবদুল মতিনের স্ত্রী জাহিদা খাতুন।

“দগ্ধ ও হতাহতরা হতদরিদ্র দিনমজুর। তারা রাজনীতি বোঝে না। কাজ না করলে অভূক্ত থাকে, জানান মাগুরার পুলিশ সুপার জিহাদুল কবীর।

সন্দেহভাজন সাতজনকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়ে পুলিশ সুপার জানান, দুষ্কৃতকারীদের গ্রেপ্তারের সবরকম চেষ্টা চলছে।  

পেট্রলবোমা হামলার ঘটনায় বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের ৪৬ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে পুলিশ। ২২ মার্চ রাতে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলাটি করেন মাগুরা সদর থানার সহকারী উপপরিদর্শক আব্দুস সালাম।

মামলায় ২৬ জনের নাম উল্লেখসহ ২০ জনকে অজ্ঞাতনামা হিসেবে দেখানো হয়েছে। তদন্তের স্বার্থে পুলিশ আসামীদের নাম প্রকাশ করতে চায়নি।

জেলা প্রশাসক জানান, দগ্ধ নয়জনের প্রত্যেককে তাৎক্ষনিক ১০ হাজার টাকা করে অর্থ সহাযতা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া নিহতদের প্রত্যেক পরিবারকে আরো ১৫ হাজার টাকা দেওয়া হবে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।