বাংলাদেশে টানা হরতাল-অবরোধে অর্থনীতি বিপর্যস্ত

ঢাকা থেকে কামরান রেজা চৌধুরী
2015.03.23
BD-politics বাংলাদেশে বিরোধী দলের অবরোধ-হরতাল চলাকালে অর্থনীতি বিপন্ন হচ্ছে। শ্রমিক শ্রেনীর মানুষ কাজের আশায় কোদাল-শাবল নিয়ে বসে আছে। ছবিঃ ঢাকা ৫ মার্চ ২০১৫
এএফপি

প্রায় ৩ মাস ধরে চলা অব্যাহত হরতাল-অবরোধে একদিকে যেমন মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে অন্যদিকে দেশের অর্থনীতিকেও দিতে হচ্ছে চরম মূল্য।এ পর্যন্ত এই কর্মসূচিতে নাশকতার হামলায় মৃত্যু ঘটেছে ১২০ নারী-শিশু সহ সাধারন খেটে খাওয়া মানুষের।

এই কর্মসূচির মধ্যেও ঢাকার রাজপথে যে হারে গাড়ি চলছে, ট্রাফিক জ্যাম দেখা যাচ্ছে তাতে মনে হবে অবরোধের কোনো প্রভাব কোথাও পড়ছে না।বড় ব্যবসায়ীদের গ্রুপ ও সরকারের দাবী অনুযায়ী অবরোধে কিছুই হচ্ছে না বলা সত্তেও ইতোমধ্যে লক্ষ-কোটি টাকার ক্ষতি ঘটে গেছে। অন্তত সকল পক্ষ স্বীকার করছে যে, ছোট ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী,হকার্স, গ্রামের কৃষকরা নীরবে হরতাল-অবরোধের শিকার হচ্ছে প্রতিদিন।

প্রতিদিনের ক্ষয়-ক্ষতির শিকার এমন একজন শব্জি বিক্রেতা আব্দুল বাতেন(৪০)। অন্তত ৫ জানুয়ারি অবরোধ শুরুর আগে বাতেন ঢাকার মিরপুরে শব্জি বিক্রি করে খুব ভালো আয় করে খুশিতেই ছিলেন। প্রতিদিন তার লাভ হতো ১০০০ টাকা (১৩ ডলার)। ৫-সদস্যের পরিবারের ব্যয় ও ঘর ভাড়া মিটিয়ে তার জীবন কাটছিল।

বাতেন ৭ বছর আগে দেশের উত্তরাঞ্চল কুড়িগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে একবছর রিক্সা চালায়, পরে পল্লবীতে শব্জি ব্যবসা  শুরু করে।কিন্তু হরতাল-অবরোধে তার ব্যবসা গুটিয়ে যায়। বাতেন বেনার নিউজকে জানায়, “ আমাকে আবার রিক্সা চালাতে হচ্ছে। ১০ হাজার টাকার ঋণ শোধ করতে হচ্ছে।প্রতি মাসে ১০০০ টাকার সুদও দিতে হচ্ছে। আমার অবস্থা এখন রোজ আয় করে খোরাকি জোগার করে রোজ বেঁচে থাকার মতো অবস্থা।কিন্তু এভাবে আর কতদিন চলা যায়?”

রহিম আরো একজন শব্জি বিক্রেতা। বেনার নিউজকে বলেন, “ইস্টার্ন হাউজিং এলাকায় আগে ৫০ জনের মতো শব্জি ফেরি করতো এখন অবরোধের পর ১৫ জনে নেমে এসেছে।আমি জানিনা আমার অবস্থা বাতেনের মতো হবে কিনা।লোকজন আর আগের মতো কেনা-কাটা করছে না”।

একজন বাসের কন্ডাক্টার মোতালেব জানালো। তার ড্রাইভার রোজ ২০০০ টাকা কামাই করতো।এখন ১০০০ টাকায় নেমে এসেছে।তার নিজের কামাই হতো ৪৫০ টাকা রোজ এখন নেমে এসেছে ২৫০ টাকায়।এখন যাত্রীবাহী গাড়ির সংখ্যাও কমে এসছে।“আগে আমি প্রতিদিন মাছ-মাংশ কিনতে পারতাম।এখন আর পারি না। এক কিলো গরুর মাংশের দাম এখন ৩৫০ টাকা,আগে ২৮০ টাকা ছিলো। আয় কমেছে কিন্তু জিনিসের দাম বেড়েছে, এভাবে হরতাল-অবরোধ চললে আমরা বাঁচবো কি করে?” বেনার নিউজকে জানায় মোতালেব।

মাংশ বিক্রেতা হালিম জানায়, সে প্রতি শুক্রবার ১০টা গরু জবাই করতো, এখন ৩টা গরুর মাংশ বিক্রি করতে পারে।একদিকে, ভারত থেকে গরু আসছে কম আর দামও বেড়ে গেছে।

এইসব অবরোধ আর হরতাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে নামাতে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু অর্থনৈতিক কার্যক্রমের সাপ্লাই চেইন ভেঙ্গে পড়েছে। অনেক কোম্পানিতে  কর্মচারীরা বেতন পাচ্ছে না, তাদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ায়।

মেট্রোপলিটান চেম্বার অব কমার্সের হিসাব মতে প্রতিদিন ২,২২৭ কোটি টাকা (২৯২ মিলিয়ন ডলার) অর্থনীতির ক্ষতি করছে। এ যাবত সর্বমোট ২০ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়েছে। যা বাংলাদেশের মোট বার্ষিক বাজেটের দুই-তৃতীয়াংশ।

ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স এন্ড ইন্ড্রাস্ট্রির(এফবিসিসিআই) প্রেসিডেন্ট কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ বেনার নিউজকে বলেন, দেশের ব্যবসায়ী সমাজ সকলে সারাদেশে প্রতিবাদ করেছে  হরতাল অবরোধ অবিলম্বে বন্ধ করার দাবী জানিয়ে। তার মতে। “ এই দাবীর কোনো ফল এখনো পাই নি। আমরা এখন খুব খারাপ সময় পার করছি। নিরাপত্তা ও বেশি টাকার ট্রাক ভাড়ার জন্য সাপ্লাই চেইন বন্ধ হবার দশা।অতিদ্রুত এই হরতাল কর্মসূচি বন্ধ করতে হবে নইলে দেশের চরম ক্ষতি হবে”।

তবে কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ দেশের অর্থনীতির ভবিষ্যতের ব্যপারে খুব বেশি হতাশ নন। তাদের মতে, দেশের সংগ্রামী মানুষ বিকল্প উপায় খুঁজে বের করবে।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমিতির সাবেক সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক কাজী খলিকুজ্জামান আহমেদ বেনার নিউজকে বলেন, হরতাল অবরোধ বিভিন্ন ভাবে দেশের রক্ত ঝড়াচ্ছে, কোনো সন্দেহ নাই।বিশেষ করে কৃষি উৎপাদন ব্যপকভাবে ব্যহত হচ্ছে এবং গণপরিবহন ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। তবে তিনি বলেন, “কিন্তু জনগন ইতো মধ্যে বেশি মূল্য দিয়ে হলেও পরিবহন ব্যবস্থা আগের মতো ফিরিয়ে আনছে এবং আসন্ন ফসলের মৌসুমে বাম্পার ফলন হতে যাচ্ছে। আমার মতে, জনগন চরম দূরাবস্থার মধ্যেও মানিয়ে চলা শিখেছে এবং ক্ষতি পুষিয়ে নিচ্ছে”।
গত বছর ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে ২ মাসের অচলাবস্থাতে তাই ঘটেছিলো বলে খলিকুজ্জামান উল্লেখ করেন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।