সিটি নির্বাচনে অংশ নিয়ে অচলাবস্থা থেকে বেরুতে চাচ্ছে বিএনপি

ঢাকা থেকে কামরান রেজা চৌধুরী
2015.03.25
BD-politics আসন্ন সিটি নির্বাচনে প্রাধান বিরোধী দল বিএনপি অংশ নিতে পারে, দলের উপদেষ্টারা বলছেন। ছবিঃ ঢাকার একটি ভোট কেন্দ্রে মহিলা ভোটার। ৫ জানুয়ারি,২০১৪
এএফপি

সিটি নির্বাচনে অংশ নেবে বিএনপি কয়েকদিন ধরে দেশে আলোচনা-গুঞ্জন চলছিলো। এরই মধ্যে বিএনপির পরামর্শকদের একটি দল প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে দেখা করে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করলে বিএনপি অংশ নেবে জানায়। ঢাকা সহ চট্টগ্রামের সম্ভাব্য বিএনপি প্রার্থীরা আবেদন পত্র সংগ্রহ করে। বুধবার চট্টগ্রামে বিএনপির বর্তমান মেয়র এম মঞ্জুর আলম পূনরায় প্রার্থী হবার ঘোষণা দিয়েছে। এইসব ঘটনা প্রবাহে স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে বিএনপি অবরোধের আন্দোলন থেকে বেরিয়ে এসে নির্বাচনে অংশ নিতে যাচ্ছে।

প্রায় ৩ মাস ধরে চলমান অবরোধ-হরতালে ১২০ জনের মতো প্রাণ কেড়ে নিয়েছে, অর্থনীতির ক্ষতি করেছে ২০ বিলিয়ন ডলারের মতো। আন্দোলন একটি ক্লানিকর অচলাবস্থার মধ্যে পড়ে গেছে। এই অবস্থা থেকে বেরুনোর উপায় হিসেবে প্রধান বিরোধী দল-বিএনপি ও তাদের জোট আগামী ২৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিতব্য ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনে অংশ নেয়ার কথা ভাবছে।
নির্বাচন কমিশন গত ১৮ মার্চ ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে মেয়র ও কাউন্সিলর পদে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা ঘোষণা করে।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, এই নির্বাচনে অংশ নেবার মাধ্যমে বিএনপি সংঘাত-নাশকতার আন্দোলন পরিহারের সুযোগ নিয়ে ভোটের রাজনীতিতে ফিরে আসছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লেফট্যানেন্ট জেনারেল মাহবুবুর রহমান বেনার নিউজকে বলেন, “আশা করছি আমরা নির্বাচনে অংশ নেবো। যদি নির্বাচন কমিশন আস্থা গড়ে তোলার পদক্ষেপ নেয়, সকল পক্ষকে সমান সুযোগ দেয় এবং সরকারী দলের সমর্থিত প্রার্থীদের প্রতি পক্ষপাত না করে আমরা নির্বাচনে যাবো”। তার মতে বিএনপি ‘সুস্থ নির্বাচনে’ বিশ্বাস করে ‘সংঘাত ও হত্যার রাজনীতি’ করে না। বিএনপি নির্বাচনে যাবে চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে।

এদিকে, গত বুধবার প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে দেখা করে আসন্ন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় বাড়ানোসহ ছয়টি অনুরোধ জানিয়েছেন বিএনপির একদল পরামর্শক।
তাদের অন্য চাওয়াগুলো হচ্ছে- গ্রেপ্তার ও হয়রানিতে থাকা সম্ভাব্য প্রার্থীদের নির্বাচনী কাজ বাধাহীন করা, কারাবন্দিদের প্রচার কাজে অংশগ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত, বিরোধী দল সমর্থিতদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক পদক্ষেপ ঠেকানো, অস্ত্র ও পেশি শক্তি নিয়ন্ত্রণ, প্রচারকর্মী ও পোলিং এজেন্টদের নিরাপত্তা নিশ্চিত।

এসব বিষয়ে সুনির্দিষ্ট আশ্বাস পেয়েছেন কি না- জানতে চাইলে প্রতিনিধি দলের নেতা অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, “কোনো বিষয়ে সিইসি উত্তর দেননি। সামগ্রিক বিষয়ে সিইসি আমাদের আশ্বস্ত করেছেন। তার সাধ্যমতো চেষ্টা করবেন বলে জানিয়েছেন।”

সরকার পতনে ২০ দলের হরতাল-অবরোধের মধ্যে আসন্ন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণের আলোচনার মধ্যে বুধবার সিইসি কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের সঙ্গে দেখা করতে যান খালেদা জিয়ার এই পরামর্শকরা।
প্রতিনিধি দলে ছিলেন- বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার মাহবুব হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাদা দলের অধ্যাপক মাহবুবউল্লাহ, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি জাফরুল্লাহ চৌধুরী, বিএনপি সমর্থক সাংবাদিক নেতা আবদুল হাই শিকদার ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ফাহমিদা ইয়াসমীন  মুন্নী।

তবে তারা দাবি করেছেন, বিএনপির পক্ষ থেকে তারা যাননি। তারা গেছেন ‘শত নাগরিক কমিটি’র পক্ষ থেকে।

এমাজউদ্দীন বলেন, “আমরা বিএনপির পক্ষ থেকে আসিনি। আমরা কারও পক্ষে না। বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে কি না, তা দল সিদ্ধান্ত নেবে। আমরা চাই, সুষ্ঠু নির্বাচন হোক। সৎ ও যোগ্য প্রার্থী পেলে আমরা সমর্থন দেব।”

লাগাতার অবরোধ ডেকে দলীয় কার্যালয়ে অবস্থানরত খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে কয়েকদিন আগেই অধ্যাপক এমাজউদ্দীন বলেছিলেন, সিটি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে বিএনপি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেবে।

বিএনপির পক্ষ থেকে এখনও আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা না এলেও নির্বাচন কমিশনে এমাজউদ্দীনদের যাওয়ার তোড়জোড়ের মধ্যে বুধবার বিএনপি নেতাদের পক্ষে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে।

ঢাকা উত্তরে মেয়র পদে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আব্দুল আউয়াল মিন্টু এবং দক্ষিণে দলের অর্থবিষয়ক সম্পাদক আব্দুস সালামের পক্ষে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করা হয়। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের বর্তমান মেয়র এম মঞ্জুর আলম বলেছেন, দল সিদ্ধান্ত জানালে তিনি ভোটের জন্য তৈরি।

দেড় ঘণ্টা ধরে সিইসির সঙ্গে বৈঠকের পর ‘শত নাগরিক কমিটি’র পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, স্থানীয় সরকার নির্বাচন নির্দলীয় হলেও বিভিন্ন দল সমর্থক প্রার্থীরা এ নির্বাচনে অংশ নেয়। এবার পরিস্থিতি অনেকটাই ভিন্ন। দেশের সচেতন নাগরিক হিসেবে কিছু বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ জানায় কমিটি।

মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় বাড়ানোর দাবির বিষয়ে এমাজউদ্দীন বলেন, “বিষয়টি মুখ্য নয়। তবে সার্বিক বিষয়ে সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিতের অনুরোধ জানানো হয়েছে।”

ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, ২৯ মার্চ মনোনয়ন দাখিলের শেষ দিন। ভোট হবে আগামী ২৮ এপ্রিল।

অন্যদিকে, বিএনপি এখনও সিদ্ধান্ত না জানালেও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে প্রার্থী হচ্ছেন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য এম মঞ্জুর আলম। বুধবার ‘চট্টগ্রাম উন্নয়ন আন্দোলন’র ব্যানারে এক সংবাদ সম্মেলনে বর্তমান মেয়র মঞ্জুরকে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়, যে ফোরাম থেকে আগেরবারও নির্বাচনী লড়াইয়ে নেমেছিলেন তিনি।

সন্ধ্যায় নগরীর জিইসি কনভেশন সেন্টারে অনুষ্ঠিত ওই সংবাদ সম্মেলনে মঞ্জুর ছিলেন না। বিএনপির কোনো নেতাকেও দেখা যায়নি সেখানে।

এই সংবাদ সম্মেলনের আগে সকালে নগর ভবনে মঞ্জুর সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “গত ২২ বছর ধরে জনসেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছি। দল যদি চায়, আল্লাহর হুকুম আর সবকিছু অনুকূলে থাকলে আমি নির্বাচন করব।”

সন্ধ্যার সংবাদ সম্মেলনের পর যোগাযোগ করা হলে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হ্যাঁ, আমি চট্টগ্রাম উন্নয়ন আন্দোলনের প্রার্থী।”

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টার পদে থেকে দলীয় সিদ্ধান্তেই কি নির্বাচন করছেন- জানতে চাইলে মঞ্জুর বলেন, “এই বিষয়ে পরে কথা বলব।”

মঞ্জুর বর্তমান মেয়র হওয়ায় পদত্যাগ করেই তাকে নির্বাচন করতে হবে। আর সেই প্রস্তুতিও তার রয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন।  

সকালে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “ম্যাডাম যদি আমাকে নির্বাচন করার নির্দেশ দেয়, তাহলে আমি পদত্যাগ করব। দলীয় সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত পদত্যাগ সম্পর্কে কিছু বলা যাচ্ছে না।”

সংবাদ সম্মেলনে কেউ না থাকলেও চট্টগ্রাম বিএনপির শীর্ষনেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিএনপি নির্বাচনে গেলে মঞ্জুরকেই মেয়র পদে সমর্থন দেওয়া হবে।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ প্রফেসর তোফায়েল আহমেদ বেনার নিউজকে বলেন, “ সিটি নির্বাচন সরকার ও বিরোধী উভয় দলের জন্য সমান সমান বিজয়ের পথ সূচনা করবে। আমরা টানেলের শেষ মাথায় আলো দেখতে পাচ্ছি। নির্বাচনে বিজয় হলে বিএনপিকে নতুন জীবন দান করবে, দলের কর্মি ও সমর্থকদের উজ্জীবিত করবে।যদি পরাজিত হয় বিএনপির আন্দোলনে গতি লাভ করবে”। তার মতে, বিএনপি জিতে গেলে বা ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী হেরে গেলে বরং সরকারের গনতান্ত্রিক বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়বে। আর সাধারন মানুষ চায় রাস্তায় সংঘাত-নাশকতার দিন শেষ হোক।

তেজগাঁ কলেজের রাষ্ট্র বিজ্ঞানের ছাত্র মামুনুর রশীদ বেনার নিউজকে বলেন, “বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে দলটি অবরোধ-হরতালের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নির্বাচনে ভোটারদিকে মনোযোগ দিতে পারবে, আমরা প্রার্থনা করি বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিক”।



মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।