খালেদা ঘরে ফিরলেন, রাজনীতিতে আচমকা অগ্রগতি

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2015.04.06
BD-politics আদালতে জামিন পেয়ে ৩ মাস পর বাসায় ফিরে সোমবার বনানীতে ছোট ছেলে কোকোর কবর জিয়ারত করতে যান খালেদা জিয়া। ছবিঃ ৬ এপ্রিল,২০১৫
বেনার নিউজ

টানা তিনমাসের রাজনৈতিক উত্তেজনা ও সহিংসতা, বিরোধী দলকে গণতান্ত্রিক কর্মসূচী চালাতে বাঁধা দেওয়া, পেট্রোলবোমা ও  নাশকতায় নিরীহ মানুষের মৃত্যু, অর্থনৈতিক ক্ষতিসহ বিভিন্ন কারণে দেশ স্থায়ী সঙ্কটের দিকে এগোচ্ছিল।

এরই মধ্যে সরকার ও বিরোধী পক্ষ নিজেদের সম্মানজনক প্রস্থানের উপায় খুঁজতে শুরু করে। এরই অংশ হিসেবে ৫ এপ্রিল বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আদালতে যাওয়া, জামিন লাভ, আদালত থেকে নিজ বাসায় ফেরা এবং পুরানো পল্টনের দলীয় কার্যালয় খুলে দেওয়া—রাজনীতিতে এই চারটি অগ্রগতি ঘটে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ঢাকা ও চট্টগ্রামের তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অনড় অবস্থা থেকে দুপক্ষ ছাড় দেওয়ায় রাজনীতিতে এই আচমকা অগ্রগতি হয়েছে। যদিও এর স্থায়ীত্ব নিয়ে সংশয় রয়েছে তাঁদের।

নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের মূল দাবিতে গত ৩ জানুয়ারি থেকে প্রায় তিনমাস বিএনপির চেয়ারপারসন দলীয় কার্যালয়েই অবস্থান করছিলেন। ৫ জানুয়ারি বিতর্কিত নির্বাচনের বর্ষপূর্তির দিনে রাজধানী ঢাকায় সমাবেশ কর্মসূচিকে ঘিরে ওই রাত থেকে তাঁকে কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করে তালা মেরে দেওয়া হয়। এরপর ১৯ জানুয়ারি তালা খুলে দেওয়া হলেও তিনি আর কার্যালয় থেকে বের হননি।

এমনকি ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস ও ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানেও যোগ দেননি খালেদা জিয়া। গুলশানের দলীয় কার্যালয় সূত্র জানায়, গত তিনমাসে তিনি তিনদিন দোতলা থেকে নীচে নেমেছেন। একদিন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে, আরেকদিন সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দিতে। এ ছাড়া আরাফাত রহমান কোকো মারা যাওয়ার পর নীচে নেমেছিলেন তিনি।
“তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী যে পরিবেশে সেখানে অবস্থান করেছেন সেটি বর্ণনা করে বোঝানো যাবে না। দলের নেতা–কর্মী ও তাঁর নিরাপত্তাকর্মীরা এই দীর্ঘসময় অনেক কষ্ট করেছেন,” বেনারকে জানান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান।

গত তিনমাসের মধ্যে প্রায় দেড়মাস গুলশান কার্যালয়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে অবস্থান করেন তিনি। গত ৫ এপ্রিল খালেদা জিয়ার সঙ্গে গুলশান কার্যালয় থেকে বের হয়ে তিনি রাজধানীর একটি হাসপাতালে ভর্তি হন।  
এই সময়ে বিএনপির আন্দোলন সফল না ব্যর্থ?—জানতে চাইলে নজরুল ইসলাম বলেন, “সফলতা ও ব্যর্থতা দু–ই আছে। আমরা দেশে–বিদেশে নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে আন্দোলনের যৌক্তিকতা তুলে ধরতে পেরেছি। নিজ দলের শক্তি ও সামর্থ্য বুঝতে পেরেছি। সরকারের মনোভাব ও অবস্থান সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া গেছে।”

বিএনপির নেতা–কর্মীরা এখন ২৯ এপ্রিল অনুষ্ঠিতব্য তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। সরকারি দল জোরজবরদস্তি করলে এই নির্বাচন আন্দোলন শুরুর উপলক্ষ এনে দেবে বলেও মনে করছেন তাঁরা।

“সিটি করপোরেশন নির্বাচন সরকার, বিরোধী দল, নির্বাচন কমিশন ও ভোটারদের জন্য একটি বড় সুযোগ। এর মধ্যে দিয়ে একটি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ফের শুরু হবে বলে মানুষ আশা করে,” বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমদ। তাঁর মতে, অবশ্য এই স্বস্থি সাময়িক এবং এটাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে দুই পক্ষের আলাপ–আলোচনা দরকার।

গত কয়েক সপ্তাহে রাজনৈতিক সহিংসতা কমে আসার পাশাপাশি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিরোধী দলগুলোর অংশগ্রহণের সিদ্ধান্তকেও স্বাগত জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন। গত ৩ এপ্রিল জাতিসংঘের ওয়েবসাইটে দেওয়া এক বিবৃতিতে সবার অংশগ্রহণে স্থানীয় এই নির্বাচন স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য করতে সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

গত রোববারের রাজনৈতিক অগগ্রতির পর খালেদা জিয়া গ্রেপ্তার হবেন বা বিএনপির গুলশান কার্যালয়ে পুলিশ ফের তালা লাগিয়ে দেবে—এমন জল্পনা–কল্পনার আপাতত অবসান হয়েছে। হরতাল কর্মসূচী দেওয়ার ক্ষেত্রে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০–দলীয় জোট নমনীয়। নাশকতাও বন্ধ হয়েছে। অবরোধ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাহার না করা হলেও এর কার্যকারিতা আর নেই।
তবে খালেদা জিয়াকে যে কার্যালয় থেকে জোর করে বের করা বা গ্রেপ্তারের কথা বলা হচ্ছিল, সেখান থেকে স্বেচ্ছায় তাঁর বের হওয়ার বিষয়টি নিয়ে মানুষের মধ্যে প্রশ্ন রয়েই গেছে।

এ প্রসঙ্গে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান ৫ এপ্রিল বিবিসি বাংলাকে বলেন, তিনি (খালেদা জিয়া) ইচ্ছা করে সেখানে থাকেন নি। সেখানে যাওয়ার পর তাঁকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়।
সেলিমা রহমান আরো বলেন, সিটি নির্বাচন সামনে রেখে সরকার হয়ত কিছুটা নমনীয়। বিএনপির দাবি ছিল নির্বাচনে গেলে কিছু কথা মানতে হবে। যেমন, কার্যালয় খুলে দেওয়া, কর্মীদের হয়রানি না করা। তাঁর মতে, পল্টন কার্যালয় খোলার পর মনে হচ্ছে দু’একটি কথা সরকার শুনছে।   

বিএনপি নেতাদের একটি অংশ মনে করেন, তাঁদের আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নেতা বলেন, বিএনপির বিপুল জনসমর্থন থাকলেও আন্দোলন করার মতো শক্তি নেই। এখন নতুন করে শুরু করতে হবে দলটিকে। “এটা সত্য বিএনপি একটি সমাবেশ ডাকলে জনতার ঢল নামে। কিন্তু পুলিশ গুলি করলে বা কেউ ককটেল ফুটলে সমাবেশস্থল ফাঁকা হয়ে যায়। এর অর্থ হচ্ছে, দলটির নেতা–কর্মী ও সমর্থকেরা শান্তিপ্রিয়,” জানান নজরুল ইসলাম খান।

সূত্রমতে, আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে খালেদা জিয়ার আদালতে হাজিরা দিতে যাওয়া, ঢাকা ও চট্টগ্রামের তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির অংশ নেওয়া এবং হরতাল ও সহিংসতা থেকে দলটির ফিরে আসার পেছনে কূটনৈতিক উদ্যোগ ছাড়াও বিএনপি–সমর্থক কয়েকজন বুদ্ধিজীবি ইতিবাচক ভূমিকা রাখেন।  এঁরা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এমাজ উদ্দিন আহমেদ, সাবেক উপ–উপাচার্য আ ফ ম ইউসুফ হায়দার, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ড. মাহবুব উল্লাহ, সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ প্রমুখ।

“উনি (খালেদা জিয়া) নির্বাচনের বিষয়ে খুবই ইতিবাচক ছিলেন। দলের কেউ কেউ না চাইলেও আমরাও ওনাকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কথা বলি,” বেনারকে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ উপাচার্য আ ফ ম ইউসুফ হায়দার। তাঁর মতে, বিএনপি এই নির্বাচনকে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছে। নির্বাচন কমিশন যদি স্বাধীনভাবে কাজ করে, সরকারের আনুগত্য থেকে বেরিয়ে আসে এবং সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে তাহলে রাজনীতির এই ইতিবাচক ধারা আরো অগ্রসর হবে বলে মনে করেন তিনি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করার পর ৪০ দিনেও খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার না করে শুধুমাত্র আওয়াজ তুলে সরকার কিছুটা বেকায়দায় পড়ে। সরকার একদিকে গ্রেপ্তারের কথা বলছিল, অন্যদিকে চাচ্ছিল তিনি যেন হাজিরা দিয়ে সরকারের মুখরক্ষা করেন।

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তারে পরোয়ানা জারি করেন আদালত। আদালতে হাজির না হলে ৫ মার্চ খালেদা জিয়া গ্রেপ্তার হবেন, পুলিশ ও প্রশাসনের এমন প্রস্তুতি এবং সরকারের ইঙ্গিত অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে।

রোববার জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়া হাজির হওয়ার পর আদালত তাঁকে জামিন দেন। কিন্তু সেই গ্রেপ্তারি পরোয়ানার বিষয়টি নিয়ে ধুম্রজাল রয়েই গেল। চল্লিশ দিন আগে আদালত থেকে পাঠানো পরোয়ানা থানায় পৌঁছাল না।  

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, গত ৪ মার্চ কূটনীতিকদের প্রকাশ্য দৌঁড়ঝাপের পর সরকার ও বিরোধী পক্ষের মধ্যে দৃশ্যত নমনীয় মনোভাবের সূত্রপাত হয়। ওইদিন কূটনীতিকরা বিএনপির গুলশান কার্যালয়ে অবস্থান করা খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করেন। এর আগে ১ মার্চ কূটনীতিকরা দেখা করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলীর সঙ্গে। এরপর থানায় না পৌঁছার অজুহাতে সরকার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তামিল করা থেকে বিরত থাকে।

“রাজনৈতিক এই অগ্রগতি স্বস্তিদায়ক। তবে বিএনপির এই বিলম্বিত বোধোদয় সাময়িক না কি কৌশল তা অচিরেই তাদের কর্মকাণ্ডে পরিষ্কার হবে,” বেনারকে জানান যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
তাঁর মতে, বিএনপির এই আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে, এটি আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।