নির্বাচন নিয়ে হাইকোর্টের দুটি ফর্মুলা, রাজনৈতিক মহলে প্রতিক্রিয়া

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2015.08.14
BD-politics সম্প্রতি হাইকোর্ট বেঞ্চ তাদের রায়ের পর্যবেক্ষণে নির্বাচনকালে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ফর্মুলা দিয়েছে। আগষ্ট ২০১৫
বেনার নিউজ


নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা বিষয়ে হাইকোর্টের দুটি ফর্মুলা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে ক্রিয়া–প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। একটি রিট আবেদনের রায়ের পর্যবেক্ষণ হিসেবে একটি বেঞ্চ এই ফর্মূলা দেন, যার মূল লক্ষ্য আগামী নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা।

২০১৪ সালের ১৯ জুন হাইকোর্ট বেঞ্চ রিট আবেদনটির সংক্ষিপ্ত রায় দেয়। পূর্নাংগ রায় অনানুষ্ঠানিকভাবে গত জুলাই এর শেষে প্রকাশিত হয়। ডেইলি স্টার প্রথম গত ১২ আগষ্ট-এ রায়টি সংগ্রহ করে প্রকাশ করে।

বিচারপতি মির্জা হোসেন হায়দার এবং বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকার সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ তাদের রায়ের পর্যবেক্ষণে প্রথম ফর্মুলায় বলেন যে, নির্বাচনকালে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা যেতে পারে।



প্রথম ফর্মুলা

ওই সরকার ব্যবস্থায় সংসদের মেয়াদ পুরা হলে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীর অধীনে সংসদ ভেঙে যাওয়ার দিন থেকে ৯০ দিনের জন্য সব দল থেকে ৫০ জন নতুন মন্ত্রী নেওয়া হবে। বর্তমান সংসদে প্রতিনিধিত্বের অনুপাতে মন্ত্রীর সংখ্যা ঠিক হবে।

দৃষ্টান্ত হিসেবে রায়ে বলা হয়, বর্তমান সংসদ বয়কট করার কারণে বিএনপি ও জামায়াত একাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রস্তাবিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে কোনো মন্ত্রী দিতে পারবে না। জাতীয় পার্টি গত নির্বাচনে ৭ ভাগ ভোট পেয়েছে সেই অনুপাতে তারা মন্ত্রিত্ব পাবে।

কিন্তু অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের স্বার্থে সংবিধানের ৫৬ (২) অনুচ্ছেদের আওতায় বয়কটকারী দলগুলো সর্বোচ্চ ৫ জন টেকনোক্রেট মন্ত্রী দিতে পারবে।

সম্ভাব্য বিতর্ক এড়াতে স্বরাষ্ট্র, অর্থ, পররাষ্ট্র, জন প্রশাসন, প্রতিরক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দপ্তর লটারির মাধ্যমে বিতরণ করার প্রস্তাব করা হয় ওই রায়ে।


দ্বিতীয় ফর্মুলা

দ্বিতীয় ফর্মুলা হিসেবে বলা হয়, নির্বাচনে বিজয়ী দল প্রথম চার বছর দেশ শাসন করবে। এরপর প্রধান বিরোধী দল শেষ এক বছর দেশ চালাবে।

তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রাপ্ত মোট ভোটের অন্তত অর্ধেক সমান ভোট প্রধান বিরোধী দলকে পেতে হবে। কোনো নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল তা না পেলে তাকে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের ৫ বছর ব্যাপী দেশ শাসনের ম্যান্ডেট মেনে নিতে হবে।

নির্বাচনকালে প্রথম ফর্মুলা অনুযায়ী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে। এটা সংবিধান সংশোধন ছাড়াই চলবে। কিন্তু দ্বিতীয় বিকল্পের জন্য সংবিধান সংশোধন লাগতে পারে। কারণ এক বছরের জন্য যাতে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের ওপর নির্ভরশীল হতে না হয়।


পর্যবেক্ষণের প্রাসঙ্গিক বিবেচনা

২০১১ সালে সুপীমকোর্টের আপিল বিভাগের এক রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হয় এবং ওই আদেশের ভিত্তিতে সংবিধান সংশোধন করে বিদ্যমান সরকারের অধীনেই নির্বাচনের মাধ্যমে ফের ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট।

বিএনপির নেতৃত্বাধীন প্রধান বিরোধী জোট গত বছরের ৫ জানুয়ারির ওই নির্বাচন বয়কট করে। কিন্তু নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন হয়, যা নিয়ে দেশে–বিদেশে ব্যাপক সমালোচনা হয়।

এ নিয়ে হাইকোর্টে ‘খন্দকার আবদুস সালাম বনাম বাংলাদেশ’ এবং ‘শাহরিয়ার মজিদ বনাম বাংলাদেশ’ শীর্ষক দুটি রিট আবেদন দাখিল হয়।

গত বছরের ১৯ জুন হাইকোর্টের বেঞ্চ আবেদন নিষ্পত্তি করে ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতদের বিষয়ে আদেশ দেন যে, এর আইনগত বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই।

এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয় অতি সম্প্রতি, যাতে আগামী নির্বাচন কীভাবে হতে পারে সে বিষয়ে পর্যবেক্ষণ প্রদানকে আদালত তাদের ভাষায় ‘অন্তর্গতভাবে প্রাসঙ্গিক’ বিবেচনা করেছেন।


প্রতিক্রিয়া

তবে আইনজ্ঞরা বলছেন, এই পর্যবেক্ষণের আইনগত ভিত্তি নেই। তাই এটি গ্রহণ করার বাধ্যবাধকতাও নেই। এ ধরনের পর্যবেক্ষণ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ।

“সংবিধান হচ্ছে সবার ওপর সর্বোচ্চ আইন। তাতে কার, কী কাজ তা বলা আছে। এর বাইরে কেউ কোনো মত বা পর্যবেক্ষণ দিলেও তা গ্রহণের বাধ্যবাধকতা নেই,” বেনারকে জানান আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত।

অবশ্য প্রখ্যাত আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে যেমন বিভিন্ন মত দেওয়া হয়, এটি তেমনই একটি মত বা পর্যবেক্ষণ বলে মনে হচ্ছে।

“সরকার কীভাবে চলবে, নির্বাচন কীভাবে হবে, নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হবে—সেসব বিষয়ে হাইকোর্টের মত কাম্য নয়,” বেনারকে জানান ড. শাহদীন মালিক।   

অবশ্য এ বিষয়ে ভিন্নমত দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমেদ। ওই রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মতে, নির্বাচন এবং গণতন্ত্র নিয়ে এ দেশে যে অনেক বড় একটি প্রশ্ন রয়েছে এগুলো তারই বহিঃপ্রকাশ।

তিনি মনে করেন, “হাইকোর্ট তাঁর মত দিয়েছেন, এটি যে পালন করতেই হবে তা নয়। আমরা ওই মতকে না মানতে পারি, কিন্তু শ্রদ্ধা জানানো উচিত।”  

এমাজউদ্দীন আহমদ বেনারকে বলেন, “১৫৩ জনের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার বিষয়টি বেআইনি নয়, রায়ে এ কথা বলা হলেও নীতির প্রশ্নে, রুচির প্রশ্নে ও গণতন্ত্রের প্রশ্নে এটি চরম প্রশ্নবিদ্ধ।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।