স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ক্ষেত্রে ধনীরাই বেশি সুবিধা ভোগ করছে, গরিবরা পিছিয়ে
2015.07.08

স্বাস্থ্য, শিক্ষার মতো মৌলিক সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশে গরিব জনগোষ্ঠী। ধনীরাই অপেক্ষাকৃত বেশি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে। আর এ কারণে ধনী-গরিবের মধ্যে সামাজিক বৈষম্য প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রোববার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত বহু নির্দেশক গুচ্ছ জরিপ বা মাল্টিপল ইনডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে ২০১২-১৩’-তে উঠে এসেছে এই চিত্র।
জরিপে সম্পদ বিবেচনায় জনগোষ্ঠীকে পাঁচ ভাগে ভাগ করেছে বিবিএস। এতে সবচেয়ে ধনী ও সবচেয়ে গরিব এমন ২০ ভাগ জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ বিভিন্ন সামাজিক সুবিধাপ্রাপ্তির তথ্যও দেওয়া হয়েছে। জরিপে দেখা গেছে, শিক্ষা, পুষ্টি, স্বাস্থ্যসহ সব সূচকেই গ্রামের চেয়ে শহরের মানুষ বেশি সুবিধা পায়।
এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এর নির্বাহী পরিচালক ড.ইফতেখারুজ্জামান বেনারকে বলেন, “প্রায় প্রতিটি খাতে দুর্নীতির প্রভাব পড়ায় সেবার মান কমে গেছে। এছাড়া শিক্ষা বা স্বাস্থ্য খাত অতি বানিজ্যিকীকরণের ফলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উপর চাপ পড়ছে। মৌলিক চাহিদার বিষয়গুলোতেও বঞ্চিত হচ্ছে দরিদ্র সমাজ। তবে সরকার যদি সুশাসনের মাধ্যমে এসব বিকাশমান খাতকে সুসংগঠিত না করে, তাহলে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েও পূর্ণ সুবিধা সাধারন জনগণ পাবে না। কোন গুণগত উন্নয়নও এদের হবেনা।”
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক বিনায়ক সেন বলেন, “শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি খাতের এই বিরাট বৈষম্যের জন্য দায়ী সামাজিক বঞ্চনা। এই বঞ্চনা শেষ না হলে এসব খাতের বৈষম্য কমবে না। ফলে কমানো যাবে না উৎপাদনশীলতা বা আয়ের বৈষম্যও। প্রজন্মের পর প্রজন্ম তা থেকে যাবে। তবে ধনী দেশগুলোতে আয় বৈষম্য থাকলেও সামাজিক বৈষম্য নেই। যে কারণে সেসব দেশের দরিদ্র পরিবারের সন্তানেরাও রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে যাওয়ার সুযোগ পান।”
তিনি বলেন “আয় বৈষম্য কমে আসলে দারিদ্র্য কিছুটা কমতে পারে। কিন্তু গরিবেরা কখনো মধ্যবিত্ত, উচ্চ-মধ্যবিত্ত হতে পারবে না। সামাজিক বৈষম্য থাকলে কোনো দেশের কাঙ্ক্ষিত উন্নতি সম্ভব নয়।”
বিবিএস জরিপে দেখা গেছে, প্রাথমিক শিক্ষা পাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে ধনী-গরিবের বৈষম্য অত্যন্ত প্রকট। সবচেয়ে বেশি দরিদ্র এমন ২০ ভাগ জনগোষ্ঠীর শিশুদের সাড়ে ৬৪ শতাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যায়। যেখানে সবচেয়ে বেশি ধনী ২০ ভাগ পরিবারের ৮১ দশমিক ৪ শতাংশ শিশু প্রাথমিক শিক্ষায় অংশ নেয়।
জরিপের ফল বলছে, দেশের ৭৩ দশমিক ২ শতাংশ শিশু প্রাথমিক শিক্ষায় অংশগ্রহণ করে। এই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অংশ নেওয়ার প্রবণতা ছেলেশিশুদের চেয়ে কন্যাশিশুদের মধ্যে অনেক বেশি। প্রতি ১০০ জন কন্যাশিশুর মধ্যে ৭৬ জন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যায়, আর ছেলেশিশু যায় ৭১ জন। এক্ষেত্রেও ধনী পরিবারের কন্যাশিশুরাই এগিয়ে আছে। প্রায় ৮২ শতাংশ ধনী পরিবারের কন্যাশিশু স্কুলে যায়, আর দরিদ্রতম পরিবারের মধ্যে এদের হার ৬৭ দশমিক ৩ শতাংশ।
তবে গত সাত বছরের ব্যবধানে ছেলে ও কন্যাশিশুদের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষায় অংশগ্রহণের প্রবণতা কমেছে বলে বিবিএস জরিপে উঠে এসেছে। ২০০৬ সালে প্রতি ১০০ জন কন্যাশিশুর ৮৪ জন স্কুলে যেত আর ছেলেশিশুদের মধ্যে যেত ৭৯ জন।
প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে মাধ্যমিক শিক্ষায় অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রেও ধনীদের সন্তানরাই এগিয়ে। সবচেয়ে বেশি ধনী এমন ২০ ভাগ জনগোষ্ঠীর ৬৬ শতাংশ শিশু মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রবেশ করে। অথচ সবচেয়ে দরিদ্রতম ২০ ভাগ জনগোষ্ঠীর শিশুদের মাত্র ২৪ দশমিক ১ শতাংশ মাধ্যমিক শিক্ষার সুযোগ পায়।
বিবিএস জরিপ বলছে, স্বাস্থ্য খাতের সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রেও ধনীরা এগিয়ে। বিশেষ করে শিশু স্বাস্থ্য, প্রজনন স্বাস্থ্যসুবিধা ও তথ্য জানার প্রবণতা ধনীদের মধ্যেই সবচেয়ে বেশি। শিক্ষার হার বেশি হওয়ায় তাদের মধ্যে সচেতনতাও বেশি। পত্রিকা, রেডিও-টেলিভিশনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে তারা এসব তথ্য জেনে থাকে।
এই গুচ্ছ জরিপে দেখা গেছে, সারা দেশের মাত্র ৪৬ শতাংশ মায়েদের শিশুর নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়া দুটি লক্ষণ, শ্বাসকষ্ট এবং বুকে ব্যাথা, তারমধ্যে একটি সম্পর্কে ধারণা রয়েছে। যাদের মধ্যে সাড়ে ৪৯ শতাংশই ধনী পরিবারের সদস্য। আর বাকি ৪৪ শতাংশ দরিদ্র পরিবারের।
ডায়রিয়া হলে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের প্রায় ৭৯ শতাংশই খাবার স্যালাইন বা বাসায় বানানো এমন তরল ওষুধ খায়। সেখানে ধনী পরিবারের প্রায় ৮১ শতাংশ শিশু এবং দরিদ্র পরিবারের ৭৭ শতাংশ শিশু এ পথ্য পায়। অন্যদিকে ধনী পরিবারের প্রতি ১ হাজারে ২৯ নবজাতকের মৃত্যু হয়। যেখানে দরিদ্র পরিবারে এ সংখ্যা ৫৯। আর পাঁচ বছর বয়সী শিশুর মৃত্যু হয় ধনী পরিবারে প্রতি হাজারে ৩৫, দরিদ্র পরিবারে ৭৯ জন।
সমাজ বিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. নেহাল করিম বলেন, “দেশে যাদের অর্থ আছে, তারাই উচ্চ শিক্ষা নিতে পারছে, স্বাস্থ্য সেবা কিনতে সক্ষম হচ্ছে। মেধা বা শ্রমের মাধ্যমে গরীবদের একটি অংশ উঠে আসলেও তা অতি সামান্য। অর্থের অভাবে বেশিরভাগ গরীব মেধাবী ঝরে যাচ্ছে। যা কোন দেশের জন্যই মঙ্গলজনক নয়। সর্বস্তরের জনগণের মাঝে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবার মত মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। না হলে বাংলাদেশের নিম্ন মধ্য-বিত্ত দেশে পরিণত হওয়া শুধু বাহ্যিক চাকচিক্য হয়ে থাকবে। কোনভাবেই দারিদ্র নিরসন হবে না।”