মসজিদে চেয়ারে বসে নামাজ পড়া নিয়ে বিতর্কিত ফতোয়ায় প্রতিক্রিয়া
2015.06.03
সৌভাগ্যের রজনী পবিত্র শবে বরাত পালন করা নিয়ে মুসলমানদের মধ্যে যখন ব্যস্ততা ও প্রস্তুতি তখন মসজিদে চেয়ারে বসে নামাজ আদায় করার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন প্রায় ৯০ শতাংশ মুসলমানদের দেশে বেশ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।
সরকারের প্রতিষ্ঠান ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে এমন ফতোয়া দেওয়ায় সরকারের নীতি নির্ধারকেরাও বিষয়টি নিয়ে বিব্রত। অবশ্য প্রতিক্রিয়া জানতে পেরে একদিনের মাথায় বোর্ডসভা ডেকে ফাউন্ডেশন বলেছে, এটা ফাউন্ডেশনের নিজস্ব বক্তব্য নয়।
তবে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মুফতি, মুহাদ্দিস ও মুফাস্সির—এই তিনজন মিলে ফতোয়াটি দিয়েছেন। সরকারের বেতনভোগী এই তিন কর্মকর্তা ফতোয়া দেওয়ার যথাযথ কর্তৃপক্ষ বলেও বিবেচিত।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, মন্ত্রিসভার প্রায় সব সদস্য এবং আলেম-ওলামা ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা এ বিষয়ে তাঁদের প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন। পরিস্থিতি উপলব্ধি করে করণীয় ঠিক করতে ২ জুন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বোর্ডসভায় ১১ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে।
“চেয়ারে বসে নামাজ আদায় করা বৈধ নয় মর্মে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ফতোয়া বিভাগের ফতোয়া অনুমোদন করেনি ফাউন্ডেশনের পরিচালনা বোর্ড,” বেনারকে জানান ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক সামীম মোহাম্মদ আফজাল।
মহাপরিচালক বলেন, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বিজ্ঞ চারজন আলেম সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে বিষয়টি পর্যালোচনার লক্ষ্যে এই ১১ সদস্যের নাম ঠিক করবেন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওই কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে গৃহীত সিদ্ধান্ত ইসলামিক ফাউন্ডেশন দেশবাসীকে অবহিত করবে।
১ জুন মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ধরনের ফতোয়া দেওয়ার বিষয়ে ধর্মমন্ত্রী মতিউর রহমানের বক্তব্য জানতে চান। ধর্মমন্ত্রী বিষয়টি সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত নন বলে প্রধানমন্ত্রীকে জানান। যত শিগগির সম্ভব তা জেনে প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করার কথা বলেন তিনি।
পরদিন ২ জুন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পরিচালনা বোর্ডের সভা ডেকে জানানো হয়, এই ফতোয়া ইসলামিক ফাউন্ডেশনের নয়। সভায় আরও বলা হয়, এটা ফাউন্ডেশনের গবেষণা বিভাগের মুফতি মোহাম্মদ আবদুল্লাহসহ অন্যদের ব্যক্তিগত মত। উল্লেখ্য,ধর্মমন্ত্রী ফাউন্ডেশনের পরিচালনা বোর্ডের সভাপতি।
সরকারের একাধিক সূত্র বলছে, এ ধরনের ফতোয়া গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি আকারে দেওয়ার রহস্য খুঁজে দেখা হচ্ছে। কারণ স্পর্শকাতর এমন একটি বিষয়ে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে দেশবাসীকে জানানোর মধ্যে অন্য কোনও উদ্দেশ্য থাকতে পারে।
৩১ মে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের গবেষণা বিভাগ ‘চেয়ারে বসে নামাজ পড়া’ প্রসঙ্গে ১২ দফা ব্যাখ্যা প্রকাশ করে। এর আগে ১৯ মার্চ ২০১৫ এই ব্যাখ্যায় সই করেন গবেষণা বিভাগের মুফতি আবদুল্লাহ।
ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া থানার কান্দানিয়া গ্রামের সারোয়ার হোসেন নামে এক ব্যক্তি মসজিদে চেয়ারে বসে নামাজ পড়া নিয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের শরীয়তসম্মত সমাধান চেয়েছিলেন। তাঁর জবাব দিতে গিয়ে বিষয়টি মুসল্লীদের অবগিতর জন্য প্রকাশ করা হয়।
ফাউন্ডেশনের ফতোয়া বিভাগের ব্যাখ্যায় বলা হয়, চেয়ারে বসে ফরজ, ওয়াজিব ও মুয়াক্কাদা নামাজ আদায়ের বৈধতা বের করা যায় না।
চেয়ারে বসে নামাজ আদায়কে নতুন বিকল্প পন্থা হিসেবে উল্লেখ করে বলা হয়, ‘চেয়ারে বসে নামাজ আদায়ে ইবাদতের প্রাণ রূপ সর্বোচ্চ দীনতা-হীনতা প্রকাশের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন হয় না। তাই চেয়ারে বসে নামাজ আদায় সঠিক নয়।’
এ প্রসঙ্গে আরও বলা হয়, চেয়ার ঢুকলে মসজিদে জামাতের কাতারের ও সবার বিনয়ী অবস্থানে বিঘ্ন ঘটে। বিতর্কের খাতিরে বাসা বা অফিসে চেয়ারে বসে নামাজ পড়া মেনে নেওয়া হলেও তা মসজিদের বেলায় প্রযোজ্য নয়।
অবশ্য মুফতি আবদুল্লাহ তাঁদের এ ফতোয়া সম্পর্কে দেশের বিজ্ঞ মুফতিদের আরও গভীরে যাওয়ার আহ্বান জানান।
“মসজিদে জামাতে নামাজ বা জুমার নামাজ পড়া হয়। সেখানে অসুস্থ লোক চেয়ার ব্যবহার করলে আপত্তি কোথায় বুঝতে পারছি না। এমন অসুস্থ লোক আছেন যাঁদের হার্টে সমস্যা, কোমর ব্যথা বা পা মুড়ে বসতে পারেন না,” বেনারকে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক মুহম্মদ শফিকুর রহমান।
তিনি প্রশ্ন রাখেন, অসুস্থ মুসল্লীরা কী তাহলে মসজিদে যাবেন না? এ বিষয়টি নিয়ে আরও গবেষণার পক্ষে মত দেন ওই অধ্যাপক।
ড. শফিক বলেন, “এই ফতোয়া সরাসরি মেনে নেওয়া যায় না। আকস্মিক কেন এ ধরনের ফতোয়া সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করা হলো, এটা আমার বোধগম্য নয়।”
“বিদেশে এমনকি সৌদি আরবে দেখা যায় অসুস্থ মুসল্লীরা মসজিদে চেয়ারে বসে নামাজ আদায় করছেন। আমাদের এখানে এটা নিয়ে আপত্তির কারণ বুঝতে পারছি না,” বেনারকে জানান মন্ত্রিসভার অন্যতম জ্যেষ্ঠ সদস্য এবং বেসামরিক বিমান ও পরিবহন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন।
বামপন্থী এ প্রবীণ নেতা বলেন, গত বছর সৌদি আরবে হজ করতে গিয়ে মসজিদে নববীতে (ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হজরত মুহাম্মদ (সা:) কর্তৃক নির্মিত মদিনা মসজিদ, যার শাব্দিক অর্থ নবীর মসজিদ) তিনি দেখেছেন, চেয়ারে বসে অসুস্থ ব্যক্তিরা নামাজ পড়ছেন।