কফিন মিছিলে আরো প্রতিবাদ, পুলিশ গুলি করার নির্দেশ পেলো

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2015.11.05
BD-protest গণজাগরণ মঞ্চের প্রতিকী কফিন মিছিল বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর কার্যালয়ের দিকে যাত্রা করে। ৫ নভেম্বর, ২০১৫
বেনার নিউজ

একের পর এক চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ড ঘটছে, পুলিশ আসামি গ্রেপ্তার করছে ও রিমান্ডে নিচ্ছে, কিন্তু কোনো ঘটনারই কূলকিনারা হচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে সম্ভাব্য হামলার আশঙ্কা রয়েছে, কিন্তু সেই হামলা ঠেকানোর প্রস্তুতি যথেষ্ট নয়।

এদিকে ১৫ দিনের ব্যবধানে ঢাকায় দুটি তল্লাশি চৌকিতে দুই পুলিশ সদস্য খুনের পর এখন আক্রান্ত হলে গুলি ছোড়ার নির্দেশনা এসেছে পুলিশ বাহিনীর সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে ।

বৃহস্পতিবার পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (কনফিডেনশিয়াল) মো. মনিরুজ্জামানের স্বাক্ষরে ছয়টি বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়, যার মধ্যে এই বিষয়টিও উল্লেখ রয়েছে ।

“দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো পুলিশ সদস্যদের ওপর কোনো আক্রমণ হলে বিধি মোতাবেক বলপ্রয়োগ করবেন এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করবেন,” বলা হয়েছে নির্দেশনায় ।

“পুলিশ একটি পেশাদার বাহিনী। আক্রমণের শিকার হলে তারা আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে,” বেনারকে জানান ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার মুনতাসিরুল ইসলাম।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশের ভূমিকার সমালোচনা হচ্ছে বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষের মধ্যে। তাঁরা বলছেন, গাবতলীতে একজন পুলিশ সদস্যকে যখন হত্যা করা হয়, তখন তাঁর সঙ্গে আরও সাত জন সশস্ত্র পুলিশ ছিল।

আবার গত বুধবার আশুলিয়ায় একজন পুলিশ সদস্যকে হত্যার সময় সেখানে দায়িত্বে থাকা পাঁচ পুলিশের সবার কাছে রাইফেল ছিল। কিন্তু তারা একটি গুলিও ছোড়েনি।

গতকাল বৃহস্পতিবার আশুলিয়া ও ঢাকা জেলা পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আশুলিয়ার বাড়ইপাড়ায় কর্তব্যরত পাঁচ পুলিশ সদস্যের কারও রাইফেলেই গুলি ভরা ছিল না। তাই হামলার শিকার হওয়ার পরে তাঁরা কোনো পাল্টা প্রতিরোধ গড়তে পারেননি। তিনজন শালবনের দিকে দৌড়ে পালিয়েই গেছেন।

“আমরা অবাক বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, কোনো জঙ্গি র‍্যাব–পুলিশের ক্রসফায়ারে পড়ে না। এখন দেখছি, পুলিশকেই জঙ্গিরা মেরে যাচ্ছে, কিন্তু তাদের বন্দুক দিয়ে গুলি বের হচ্ছে না,” ক্ষোভের সঙ্গে জানান ইতিহাসবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন।   


কফিন মিছিল

প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনকে হত্যা এবং প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুল ও দুই লেখক-ব্লগারের ওপর হামলার বিচারের দাবিতে গতকাল বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অভিমুখে গণজাগরণ মঞ্চ প্রতীকী কফিন মিছিল বের করে।

শাহবাগ মোড় থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অভিমুখে যাওয়ার সময় জাতীয় প্রেসক্লাবের পূর্বদিকে সচিবালয়-সংলগ্ন সড়কে মিছিলটি আটকে দেয় পুলিশ। সেখানেই বক্তব্য দেন গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার।

“রাজনীতিবিদ ও প্রশাসনের মধ্যে জঙ্গিবাদীদের ভূত ঢুকেছে । এই ভূত তাড়াতে হবে। তা না হলে এ দেশকে জঙ্গিবাদীদের হাত থেকে, জামায়াত-শিবিরের হাত থেকে রক্ষা করা যাবে না,” বলেন ইমরান।

গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র বলেন, “কোনো ঘটনা ঘটলেই তাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে হালকা করে দেওয়া হয়, অস্বীকার করা হয়, অন্য কারও ওপর দায় চাপানো হয়। দায় চাপানোর মধ্য দিয়ে হত্যাকাণ্ডগুলোকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। এ কারণে হত্যাকারীরা নির্বিঘ্নে থাকছে।”

ইমরান বলেন, “এ হামলা কোনো বিশ্বাস ও সুনির্দিষ্ট গোষ্ঠীর ওপর নয়, বরং এ হামলা দেশের ১৬ কোটি মানুষের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশকে সিরিয়া ও আফগানিস্তান বানানোর জন্য পরিকল্পিতভাবে এ হামলা চালানো হচ্ছে।”


ফের আইএসের দায় স্বীকার

দুই বিদেশি হত্যা ও শিয়া সমাবেশে হামলার পর আশুলিয়ায় তল্লাশি চৌকিতে পুলিশ হত্যার দায়ও মধ্যপ্রাচ্যের জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস) স্বীকার করেছে বলে দাবি করেছে জঙ্গি তৎপরতা পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ ।

তবে বরাবরের মতোই তাদের এ দাবি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে পুলিশ কর্মকর্তারা বলেছেন, বাংলাদেশে আইএসের তৎপরতার কোনো তথ্য তারা পাননি।

কোনো গোষ্ঠী মানুষকে বিভ্রান্ত করতেই ‘ভুয়া পরিচয়ে’ আইএস-এর নাম ব্যবহার করে দায় স্বীকার করছে বলে ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি মাহফুজুল হক নুরুজ্জামানের ধারণা।

গত বুধবার সকালে সাভারের আশুলিয়ায় ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের বাড়ইপাড়া এলাকায় পুলিশের একটি তল্লাশি চৌকিতে হামলা হয়। মুকুল হোসেন নামের এক কনস্টেবলকে কুপিয়ে হত্যা করে এবং আরও একজনকে জখম করে মোটর সাইকেলে করে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।

বৃহস্পতিবার সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপের ওয়েবসাইট ও টুইটার অ্যাকাউন্টে এক বার্তায় বলা হয়, “বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় তল্লাশি চৌকিতে হামলা চালিয়ে পুলিশ হত্যার দায় স্বীকার করেছে আইএস।”

ঠিক কোন তথ্যের ভিত্তিতে আইএসএর দায় স্বীকারের বিষয়ে সাইট নিশ্চিত হল, সে বিষয়ে এবারও কিছু বলা হয়নি তাদের খবরে।

এর আগে ঢাকায় ইতালীয় নাগরিক তাবেলা সিজার ও রংপুরে জাপানি নাগরিক হোশিও কুনি খুন হওয়ার পরও আইএসের দায় স্বীকারের খবর দিয়েছিল সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ।

এরপর পুরান ঢাকার ইমামবাড়ায় আশুরার তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতির মধ্যে বোমা হামলায় দুজন নিহত হওয়ার ঘটনাতেও আইএস দায় স্বীকার করেছে বলে সাইট দাবি করে।

সর্বশেষ গত ৩১ অক্টোবর এক প্রকাশককে হত্যা এবং আরেক প্রকাশকসহ তিনজনকে হত্যা চেষ্টার পর আল কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখার নামে দায় স্বীকার করা হয়, যে খবর সাইটেও আসে।

বাংলাদেশ সরকার বলে আসছে, এসব ঘটনার সঙ্গে আইএস বা এ ধরনের কোনো জঙ্গি গোষ্ঠীর সংশ্লিষ্টতা বা দায় স্বীকারের দাবির কোনো ভিত্তি গোয়েন্দারা খুঁজে পাননি।  

ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মুনিরুল গত ২৬ অক্টোবর এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেন, তাবেলা হত্যার বিষয়ে কোনো তথ্য আইএসের ওয়েবসাইটে নেই। ‘এসব বার্তা’ তারা কখনো গোপনেও দেয় না।

“এ বিষয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে সাইট ইন্টেলিজেন্সের পরিচালক রিটা কাতজের সঙ্গে মেইলে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার কোনো উত্তর আমরা পাইনি।”


তাবেলা হত্যার আসামি গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে

ঢাকায় ইতালির নাগরিক তাবেলা সিজার হত্যা মামলায় বিএনপি নেতা এম এ কাইয়ুমের ভাই আব্দুল মতিনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আট দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছে আদালত ।

বৃহস্পতিবার ঢাকার মহানগর হাকিম শাহরিয়ার মাহমুদ আদনান তদন্ত কর্মকর্তার ১০ দিন রিমান্ড আবেদনে এই আদেশ দেন বলে জানান আদালত পুলিশের সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা উপপরিদর্শক ফরিদ মিয়া ।

ভারতে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টাকালে বুধবার রাত ১১টার দিকে যশোরের বেনাপোল থেকে মতিনকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে ঢাকা মহানগর পুলিশ জানিয়েছে।

তবে তাকে বেশ কয়েক দিন আগেই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ধরে নিয়ে যায় বলে পরিবারের অভিযোগ।

ফরিদ মিয়া বলেন, “বিএনপিপন্থী আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়ার সহকারী আইনজীবীরা রিমান্ড বাতিলের আবেদন করেছিলেন। আদালত তা নাকচ করেছেন।”

গত ২৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর গুলশানে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন ইতালির ত্রাণকর্মী সিজার তাবেলা।

প্রায় এক মাস পর গত ২৬ অক্টোবর এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত অভিযোগে চারজনকে গ্রেপ্তারের কথা জানায় গোয়েন্দা পুলিশ। এরা হলেন; মিনহাজুল আরেফিন রাসেল ওরফে ‘ভাগ্নে রাসেল’, রাসেল চৌধুরী ওরফে ‘চাকতি রাসেল’, ‘শুটার রুবেল’ এবং শাখাওয়াত হোসেন ওরফে শরীফ।

গত মঙ্গলবার ‘চাকতি রাসেল’কে রিমান্ডে নেওয়া হয়। তার আগে মামলায় গ্রেপ্তার অপর তিনজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।


অভিজিৎ হত্যা মামলার আসামি রিমান্ডে

বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায় হত্যা মামলার আসামি জাফরান হাসানকে আবার পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আদেশ দিয়েছেন আদালত। গতকাল ঢাকার মহানগর হাকিম আমিনুল হক এ রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

এর আগে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) পরিদর্শক মোহাম্মদ ফজলুর রহমান গত ২৭ অক্টোবর জাফরান হাসানকে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন। আদাগতকাল শুনানি শেষে আদালত পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

আদালতে দেওয়া রিমান্ড প্রতিবেদনে বলা হয়, এ মামলায় আসামি জাফরান হাসানকে এর আগে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ওই সময় জিজ্ঞাসাবাদে জঙ্গি সংগঠনের বিষয়ে তথ্য দিয়েছিলেন। কিন্তু যাচাই-বাছাই করে দেখা যায়, সেখানে অনেক তথ্য মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর।

এ মামলায় গ্রেপ্তার অপর আসামি শফিউর রহমান ফারাবি রিমান্ডে জঙ্গিদের বিষয়ে তথ্য দিয়েছেন। আসামিদের দেওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই ও প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটনে আসামিকে রিমান্ডে নেওয়া প্রয়োজন। শুনানি শেষে আদালত রিমান্ডের আদেশ মঞ্জুর করেন। এ মামলায় এখন পর্যন্ত মোট আটজন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে বইমেলা থেকে বের হওয়ার পর টিএসসির কাছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান-সংলগ্ন ফুটপাতে খুন হন অভিজিৎ রায়। আহত হন তাঁর স্ত্রী রাফিদা আহমেদ।  

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।