পাকিস্তানকে কড়া জবাব দিলো বাংলাদেশ

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2015.11.23
BD-protest দুই যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির ব্যাপারে পাকিস্তানের কটু মন্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে ঢাকার রাস্তায় নেমে আসে অনেকে।
বেনার নিউজ

আবারো বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে নাক গলালো পাকিস্তান সরকার। তবে বিষয়টির কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ।  

গত শনিবার রাতে স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অপরাধে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। পরদিন এঘটনার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। যার কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ সরকার।

পাকিস্তান সরকারের এ ধরণের মন্তব্যকে কুটনৈতিক শিষ্টাচার লংঘন বলে মনে করছে বাংলাদেশের সুধী সমাজ।

এর আগে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মৃতুদণ্ড কার্যকর করা প্রসঙ্গে পাকিস্তানের দেওয়া বিবৃতিতে সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

সুত্র জানায়, মন্ত্রিসভার বৈঠকের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ প্রসঙ্গ তুলে পাকিস্তানের বক্তব্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এরা এর আগেও এ ধরনের ঔদ্ধত্য দেখিয়েছিলো। এর কড়া প্রতিবাদ জানাতে হবে। ভালো করে ছবক দিতে হবে।

রোববার দেওয়া পাকিস্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, আমরা গভীর উদ্বেগ ও বেদনার সঙ্গে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মুজাহিদের দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুদণ্ড কার্যকর লক্ষ্য করলাম।

বিবৃতিতে যুদ্ধাপরাধের বিচারকে ‘প্রহসন’ আখ্যা দেয় পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চৌধুরী নিসার আলী খান রোববার বলেন, ১৯৭১ সালে কেউ পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করলে তার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়া বন্ধ করার এখনই উপযুক্ত সময়।

পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রোববার বলেন, ১৯৭১ সালে কেউ পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করলে তার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়া বন্ধ করার এখনই উপযুক্ত সময়।  ( পাকিস্তানের জিয়ো টেলিভিশন)। আর মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ডে উদ্বেগ প্রকাশ করে পাকিস্তান জামায়াত-ই-ইসলামির সিরাজুল হক বলেন, পাকিস্তানের আদর্শের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করার কারণেই মুজাহিদকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে।


ক্ষোভে ফেটে পড়েছে বাংলাদেশ

পাকিস্তানের এ বিবৃতির পর বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেয়। এ নিয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চ বিক্ষ‍াভ প্রদর্শন করে।

অপরদিকে ঢাকায় দেশটির হাই কমিশনার সুজা আলমকে তলব করে ‘কড়া প্রতিবাদ’ জানায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় হাজির হয়ে সুজা আলম ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব মিজানুর রহমানের সঙ্গে দেখা করেন।

এ সময় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কড়া প্রতিবাদ জানিয়ে হাইকমিশনারকে বলা হয়, এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ বিচার নিয়ে মন্তব্য করা নাক গলানোর শামিল। এটা দুঃখজনক।

এর আগেও ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধী আবদুল কাদের মোল্লার রায় কার্যকরের পর একই ধরণের আচরণ করেছিলো পাকিস্তান সরকার। তখনও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কড়া প্রতিবাদ জানানো হয়।  

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মুক্তিযোদ্ধা জাদুঘরের ট্রাস্ট্রি মফিদুল হক বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশের অভ্যন্তরীন বিচার নিয়ে এ ধরণের মন্তব্য পাকিস্তান করতে পারে না। এটা আমাদের সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন। এ মন্তব্য করে তারা কুটনৈতিক শিষ্টাচার লংঘন করেছেন”।

বেনারে সঙ্গে আলাপকালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ  বলেন, "আমি ব্যথিত হইনি। কারণ সে (সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী) তাদের লোক। তবে তাদেরকে বুঝতে হবে আমরা এখন স্বাধীন দেশ। আমরা তাদের অংশ নয়। পাকিস্তানের এ ধরণের মন্তব্য ভিয়েনা কনভেনশনের পরিষ্কার লংঘন।"

ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নির্বাহী সম্পাদক ও বিশিষ্ট সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির বেনারকে বলেন, “যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসিতে তাদের (পাকিস্তানের) জ্বলে কেন?  ১৯৭১ সালে তারা সেনাবাহিনী নিয়ে পরাজিত হয়েছিলো। এখন তারা  রাজনৈতিকভাবে পরাজিত হচ্ছে।"


আগেও প্রতিবাদ জানিয়েছিলো বাংলাদেশ

শুধু সালাউদ্দিন ও মুজাহিদের সময়ে নয়, আরেক যুদ্ধাপরাধী আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের পরও একই ধরনের মন্তব্য করেছিলো পাকিস্তান ।

২০১৩ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তানের পার্লামেন্টে দেশটির  স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চৌধুরী নিসার আলী খান বলেন, “বাংলাদেশ হওয়ার আগ পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের একজন অকুণ্ঠ সমর্থক ছিলেন কাদের মোল্লা। তার মৃত্যুতে প্রতিটি পাকিস্তানি শোকার্ত ও মর্মাহত।”

এরপর ‘ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের’ একনিষ্ঠ সমর্থক হিসেবে কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ডে উদ্বেগ প্রকাশ করে পাকিস্তানের পার্লামেন্টে একটি প্রস্তাব পাস হয়।

তখন  আব্দুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড নিয়ে পাকিস্তান পার্লামেন্টের পদক্ষেপকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ‘নাক গলানোর শামিল’ বিবেচনা করে তার কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছিলো বাংলাদেশ সরকার।

ওই সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী সাংবাদিকদের বলেন, "একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচার বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। পাকিস্তান পার্লামেন্টে এই ধরনের প্রস্তাব গ্রহণ ঠিক হয়নি। বাংলাদেশ এখন এমন অবস্থানে পৌঁছেছে যে আমরা কাউকে ভয় পাই না।"

ওই সময়েও ঢাকার প্রতিবাদ ইসলামাবাদকে জানাতে হাইকমিশনার আফরাসিয়াব মেহেদী হাশমী কুরেশীকে তলব করা হয়েছিলো। তলব করে কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড নিয়ে পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চৌধুরী নিসার আলী খানের বক্তব্যের প্রতিবাদও জানিয়েছে ঢাকা।

এছাড়াও একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থানও পাকিস্তানের হাইকমিশনারের কাছে তুলে ধরা হয়।

তখন শুধু আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদই নয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এর বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়েছেন।

শেখ হাসিনা বলেছিলেন, "আমার দেশের যুদ্ধের সময় যারা অপরাধী, তারা আমার দেশের নাগরিক। তারা জনবিরোধী কাজ করেছে। আমরা বিচার করেছি, এখানে পাকিস্তান পার্লামেন্ট নিন্দা প্রস্তাব নেয়ার কে? তারাও (পাকিস্তান) তো অপরাধী। তাদের সেনাবাহিনী এদেশের জনগণকে হত্যা করেছে, নারী ধর্ষণ করেছে, নির্যাতন চালিয়েছে। আর তারা (জামায়াত নেতা) ছিল তাদের দোসর। পাকিস্তানের পার্লামেন্ট যে প্রস্তাব নিয়েছে, তার তীব্র নিন্দা জানাই। তাদেরকে আমি বলব, বাংলাদেশ এখন স্বাধীন দেশ।"

এসব প্রতিবাদের পরও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে অবস্থান পরিবর্তন করেনি পাকিস্তান সরকার। তারা দুই বছরের মাথায় এসে আবারো যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে মন্তব্য করেছে।


পাকিস্তানের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নয়: ইমরান

সংসদের চলমান অধিবেশনে পাকিস্তানের বিবৃতির বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব এবং ক্ষমা না চাওয়া পর্যন্ত দেশটির সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক স্থগিত রাখতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার।

মঞ্চের নেতাকর্মীরা হরতাল প্রত্যাখ্যান করে সোমবার সকাল ১০টা থেকে শাহবাগে অবস্থান নেয়। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সেখান থেকে বের করা হয় হরতালবিরোধী মিছিল। মিছিলটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি ঘুরে পুনরায় শাহবাগে এসে শেষ হয়।

সমাবেশে ইমরান বলেন, “যুদ্ধাপরাধীদের রায় কার্যকর হলেই পাকিস্তানের বক্তব্য-বিবৃতি থেকে বোঝা যায়, এই যুদ্ধাপরাধীরা মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে আজীবন পাকিস্তানের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে গেছে।”

“যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে নাক গলানো বন্ধ না হলে কাদের মোল্লার রায়ের পর যেভাবে মানুষ পাকিস্তানের বক্তব্যের প্রতিবাদে দূতাবাস ঘেরাওয়ে রাজপথে নেমে এসেছিল, সেভাবে প্রয়োজনে আবারও বাংলাদেশের জনগণ পাকিস্তানের ধৃষ্টতার জবাব দেবে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।