গণহত্যার দায় অস্বীকার পাকিস্তানের, প্রতিবাদের ঝড়
2015.12.02
দুই যুদ্ধাপরাধী বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্পর্কে টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। দুই দেশই অপরের হাইকমিশনারকে তলব করে প্রতিবাদ জানিয়েছে।
৪৫ বছর পর পাকিস্তান মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশে গণহত্যার দায় অস্বীকার করার পাশাপাশি চলমান যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে ধৃষ্টতাপূর্ণ মন্তব্য করায় পুরানো এই ইস্যু নতুনভাবে চাঙ্গা হয়ে উঠেছে ।
১ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়েছে বিজয়ের মাস, যে মাসে ৩০ লাখ শহীদের এই দেশটি ক্ষোভ ও প্রতিবাদে মুখর থাকে।
এবার এই মাসে বাংলাদেশে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড় উঠেছে। দাবি উঠেছে ওই দেশটির সঙ্গে সব ধরনের বাণিজিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার।
বাংলাদেশের কয়েকজন বুদ্ধিজীবী গত কয়েক দিন ধরে পাকিস্তানের ভূমিকার নিন্দা জানাচ্ছেন।
“পাকিস্তানে যারা ক্ষমতায় আছে , তারা একাত্তরে গণহত্যার দায় অস্বীকার করে ইতিহাসের সত্যকে অস্বীকার করেছেন, যা তাদের সুস্থ ও মানবিক বোধের প্রকাশ নয়,“ বেনারকে জানান দেশের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।
সাম্প্রতিক সময়ে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এবং গণজাগরণ মঞ্চ বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের নিষ্ঠুর ভূমিকার বিষয়গুলো তুলে ধরছে।
এই পরিস্থিতির মধ্যে পাকিস্তান ঘেঁষা বলে পরিচিতি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিরোধী দল বিএনপি পাকিস্তানের বিপক্ষে বিবৃতি দেওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অনেকেই।
পাকিস্তানি দূতাবাস ঘেরাও করবে গণজাগরণ মঞ্চ
পাকিস্তানে নিযুক্ত বাংলাদেশী রাষ্ট্রদূতকে তলব করে গণহত্যার দায় অস্বীকার এবং চলমান যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে ধৃষ্টতাপূর্ণ মন্তব্য করার প্রেক্ষিতে পাকিস্তানি দূতাবাস ঘেরাওয়ের হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার।
ধৃষ্টতাপূর্ণ বক্তব্যের প্রতিবাদে পাকিস্তানের সাথে সব ধরণের সম্পর্ক স্থগিত করার দাবিতে গতকাল বুধবার বিকালে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ আয়োজিত বিক্ষোভ সমাবেশে এই হুঁশিয়ারি দেন তিনি।
বিক্ষোভ সমাবেশে ইমরান এইচ সরকার বলেন, “পাকিস্তান স্পষ্টভাবেই জানে, যুদ্ধাপরাধের দায়ে বাংলাদেশে তাদের দোসরদের বিচার শেষ হলে অবধারিতভাবেই পাকিস্তানের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নটি আসবে। সেকারণেই তারা এখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা করছে।”
ইমরান এইচ সরকার বলেন, “পাকিস্তান পরিকল্পিতভাবেই গোয়েবলসীয় কায়দায় গণহত্যার দায় অস্বীকার করে মিথ্যাচার করে যাচ্ছে। কিন্তু চোর যেমন চুরি করলে প্রমাণ রেখে যায়, তেমনি তাদের অপরাধেরও অসংখ্য প্রমাণ রয়ে গেছে।”
হত্যাযজ্ঞের কথা অস্বীকার পাকিস্তানের
একাত্তরে বাংলাদেশে চালানো হত্যাযজ্ঞসহ বিভিন্ন অন্যায়ের কথা অস্বীকার করেছে পাকিস্তান। ইসলামাবাদে নিযুক্ত বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনারকে পাল্টা তলব করে জানায় পাকিস্তান।
ঢাকায় শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকরের পর ‘উদ্বেগ ও ক্ষোভ’ জানাতে গত ৩০ নভেম্বর দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বাংলাদেশের হাইকমিশনারকে তলব করা হয়।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যম জানায়, একাত্তরে মানবতাবিরোধী ও গণহত্যায় পাকিস্তান জড়িত ছিল বলে বাংলাদেশ সরকার দাবি করছে। কিন্তু এসব দাবি ‘ভিত্তিহীন’ ও ‘অমূলক’ উল্লেখ করে তা প্রত্যাখ্যান করছে পাকিস্তান সরকার।
এর আগে ২৫ নভেম্বর পাকিস্তানের সংসদে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধের বিচারকে ‘ভ্রান্ত যুদ্ধাপরাধের বিচার’ বলে আখ্যায়িত করেন সংসদ সদস্যরা। একই সঙ্গে বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক আদালতে নিয়ে যেতে পাকিস্তান সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তারা।
এরপর দেশটির ক্ষমতাসীন দলের আইনপ্রণেতা এমএনএ শেখ আফতাব আহমেদ বাংলাদেশি হাইকমিশনারকে তলবের বিষয়টি জানান।
গত ২২ নভেম্বর দিনগত রাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বিএনপি নেতা সাকা চৌধুরী ও জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের রায় কার্যকর করা হয়।
২৩ নভেম্বর এ রায় কার্যকরের ঘটনায় ‘উদ্বেগ ও ক্ষোভ’ প্রকাশ করে বিবৃতি দেয় পাকিস্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
ঢাকায় নিযুক্ত হাইকমিশনারকে তলব
অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ‘অগ্রহণযোগ্য হস্তক্ষেপ’ করায় ২৩ নভেম্বর ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানের হাইকমিশনার সুজা আলমকে তলব করে জোর প্রতিবাদ জানায় বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিয়ে পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ার প্রতিবাদে ঢাকায় নিযুক্ত দেশটির হাইকমিশনার সুজা আলমকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করা হয়েছিল।
এদিকে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র কাজী এম খলিলুল্লাহ এক বিবৃতিতে বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াত নেতা আলী আহসান মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড নিয়েও প্রতিক্রিয়া জানান।
পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় কাজী এম খলিলুল্লাহ বিবৃতিতে বলেন, “আমরা গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভের সঙ্গে দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুদণ্ডের ঘটনা লক্ষ্য করেছি। এ ঘটনায় আমরা গভীরভাবে অসন্তুষ্ট।“
পাকিস্তানের মুখপাত্র বলেন, “বাংলাদেশে ১৯৭১ এর ঘটনাবলি নিয়ে ত্রুটিপূর্ণ বিচার প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যে প্রতিক্রিয়া আমরা লক্ষ্য করছি, তা নিয়ে আগের মতো আবার গুরুত্ব দিচ্ছি।“
পাকিস্তান অস্বীকার করতে পারে না: বিএনপি
যুদ্ধাপরাধ এবং মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা সত্য, পাকিস্তান এটিকে অস্বীকার করতে পারে না বলে জানিয়েছে বিএনপি। গত মঙ্গলবার নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের মুখপাত্র আসাদুজ্জামান রিপন এ কথা বলেন।
আসাদুজ্জামান বলেন, “পাকিস্তান এখন যাই বলুক না কেন, তারা সত্য লুকাতে পারবে না।“ তিনি বলেন, “আমি খুব সংক্ষেপে বলতে চাই পাকিস্তানি বাহিনী গণহত্যা এবং নৃশংসতা চালিয়েছে। এটি এখন কোনোভাবেই লুকানো সম্ভব নয়”।
বিএনপি বুদ্ধিমানের মতো কাজ করেছে: অ্যাটর্নি জেনারেল
বিএনপির এই বক্তব্যের জবাব দিয়েছেন সরকারের প্রধান আইন কর্মকর্তা মাহবুবে আলম। গতকাল বুধবার
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “পাকিস্তান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যেসব ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছে তার প্রতিবাদ জানিয়ে বিএনপি বুদ্ধিমানের মতো কাজ করেছে। যদি তারা না করত, তবে তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত। অন্তর থেকে না বললেও বিএনপি বাহ্যিকভাবে পাকিস্তানের বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য।”
কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করুন: সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম
যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে পাকিস্তানের বক্তব্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের শামিল মন্তব্য করে দেশটির সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবি জানিয়েছে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার চার দশকেরও বেশি সময় পরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর গণহত্যার বিষয়টি অস্বীকার ‘আরেকটি ঐতিহাসিক পাপ’ বলেও মন্তব্য এসেছে তাদের পক্ষ থেকে।
মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে সংগঠনের মহাসচিব হারুন হাবীব বলেন, “বাংলাদেশের ঐতিহাসিক যুদ্ধাপরাধ বিচার শুরু হওয়ার পর থেকেই পাকিস্তান সরকার ও দেশটির বিভিন্ন মহল বিরূপ সমালোচনা করে আসছে, যা শুধু নিন্দনীয়ই নয় একই সঙ্গে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সরাসরি হস্তক্ষেপের শামিল।"
“তাদের ধারাবাহিক বক্তব্য-বিবৃতিতে এটিই প্রমাণ করে যে, ৪৪ বছর পরও বাংলাদেশের স্বাধীন-সার্বভৌম অস্তিত্ব মেনে নিতে ব্যর্থ হয়েছে পাকিস্তান । কাজেই এমন একটি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক রাখার কোনো যৌক্তিকতা থাকতে পারে না।”
হারুন হাবীব বলেন, “পাকিস্তান সরকারের এই দায় অস্বীকারের ঘটনাটি এমন সময়ে ঘটেছে যখন সে দেশেরই বিবেকবান নাগরিকগণ বারংবার তাদের দেশের সেনাবাহিনীর হাতে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য পাকিস্তান সরকারকে বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা প্রার্থনার আহ্বান জানিয়েছেন।”
পাকিস্তানের গণহত্যার দায় অস্বীকার শুধু ইতিহাসের ‘চরম বিকৃতি নয়, নির্লজ্জ মিথ্যাচার’ বলেও মন্তব্য করেন সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের মহাসচিব।
তিনি বলেন, “১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে হানাদার পাকিস্তান বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা যে বর্বরতা চালিয়েছে, পাকিস্তান সরকার অস্বীকার করলেও তা সারা বিশ্বেই বিংশ শতাব্দীর নিকৃষ্টতম গণহত্যা ও নারী নির্যাতন হিসেবে স্বীকৃত ও গ্রন্থিত।”