আনন্দঘন পরিবেশে দুর্গা উৎসব, বিদায়ের বেলা ছিল বিষাদের সুর

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2015.10.22
BD-puja মঙ্গলবার ঢাকেশ্বরী মন্দিরে ভক্তদের পূজা।
বেনার নিউজ

ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির মেলাঙ্গনে ছিল হাসি-উচ্ছলতায় ভরা আনন্দঘন পরিবেশ। অথচ কোথায় যেন বেজে চলেছে বিষাদের সুর। কারণ মা দুর্গা চলে যাবেন।

শুভ বিজয়া দশমী তিথিতে মা দুর্গাকে বিদায় জানানোর মধ্য দিয়ে বৃহস্পতিবার শেষ হয়েছে বাঙালি হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা।

মহালয়ার দিন ঘোড়ায় চেপে সন্তানদের নিয়ে মর্ত্যের দিকে যাত্রা করেছিলেন মা দুর্গা। চার সন্তান লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক ও গণেশকে নিয়ে পাঁচ দিন মর্ত্যে ভক্তদের মাঝে কাটালেন, পূজা নিলেন।

সরেজমিন ঢাকার কয়েকটি পূজামণ্ডপে গিয়ে দেখা যায়, অবিরাম ঢাকের বাদ্য, শঙ্খ আর উলুধ্বনির মধ্যে চলছে সিঁদুর উৎসব। হিন্দু নারীদের ভিড় উপচে পড়ছে মণ্ডপে। মা দুর্গার চরণে ভক্তি নিবেদন শেষে তাঁরা একে অন্যকে সিঁদুর দিচ্ছেন।

বিজয়া দশমী হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য যেমন এক বাঁধভাঙা উৎসবের দিন, তেমনি মায়ের প্রস্থানে এক ধরনের মন খারাপ করা ভর করে সবার মাঝে।

শাস্ত্র অনুসারে দুর্গাপূজার সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়ে গেলেও অবশ্য প্রতিমা বিসর্জন হচ্ছে আজ শুক্রবার। মহানবমী ও বিজয়া দশমী তিথি একই দিনে হওয়ায় ভক্ত ও দর্শনার্থীরা যেন প্রতিমা দর্শনে বঞ্চিত না হন, এ জন্য পূজা উদ্যাপন পরিষদ এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

“মা দুর্গার ঘোড়ায় চড়ে মর্ত্যে আগমন ও দোলায় চড়ে গমন অশুভ শক্তির ইঙ্গিত দেয়। তাই মায়ের চরণে পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে আমরা প্রার্থনা করেছি, তিনি যেন জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের মঙ্গল করেন,” বেনারকে জানান ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরের প্রধান পুরোহিত রণজিৎ চক্রবর্তী।

ঢাকেশ্বরী মন্দিরের মতো রাজধানী ঢাকার অন্য মণ্ডপগুলো ও সারা দেশে একইভাবে গতকাল দুর্গাপূজার সব শাস্ত্রীয় আচার শেষ হয়েছে। পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর শক্ত অবস্থানের জন্য সারা দেশে দুএকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া শান্তিপূর্ণভাবে দুর্গাপূজা উদ্যাপিত হয়েছে।

“নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে কোনো অঘটন ছাড়াই উৎসবমুখর পরিবেশে রাজধানীতে দুর্গাপূজা হয়েছে, জানান মহানগর সর্বজনীন পূজা কমিটির সাধারণ সম্পাদক নারায়ণ সাহা মনি।

বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর সারা দেশেও দুর্গাপূজার সংখ্যা বেড়েছে। গত বছরের চেয়ে ৬৮৭টি বেড়ে এবার সারা দেশে ২৯ হাজার ৭৪ মণ্ডপে দুর্গাপূজা হয়েছে।

১২ অক্টোবর শুভ মহালয়ার মধ্য দিয়ে দেবীপক্ষের শুরু হয়েছিল। এরপর ১৯ অক্টোবর ষষ্ঠী, ২০ অক্টোবর মহাসপ্তমী ও ২১ অক্টোবর মহাষ্টমী পূজা হয়। মহাষ্টমীর দিন রাজধানীর রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনে অনুষ্ঠিত হয় ‘কুমারী পূজা’।


নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন নেই, আছে হতাশা অতীত নিয়ে

দুই বিদেশি হত্যাসহ এক ধরনের অস্থির পরিবেশের মধ্য দিয়ে শেষ হলো শারদীয় দুর্গোৎসব। এবারের নিরাপত্তা নিয়ে সংখ্যালঘুদের মধ্যে সেই অর্থে প্রশ্ন নেই। কিন্তু অতীতের কিছু বিষয় নিয়ে ক্ষোভ ও হতাশা রয়ে গেছে।

“যথেষ্ট নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছে। আমরা শঙ্কিত না। তবে অধিকতর সজাগ,” বেনারকে জানান পূজা উদ্যাপন পরিষদের সভাপতি কাজল দেবনাথ।

তবে উৎসবমুখর পরিবেশ থাকলেও পুরোনো স্মৃতি এবং অজানা আশঙ্কা থেকে বের হতে পারেননি সংখ্যালঘুদের অনেকেই।

“যেকোনো ধরনের নির্বাচন ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অন্যায়ের প্রথম শিকার হয় সংখ্যালঘুরা। কিন্তু বিচার পায় না। বিচারহীনতার এই সংস্কৃতি দূর করতে হবে,” বেনারকে জানান বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ও নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে এবং ১৯৯০ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙার গুজব ছড়িয়ে, ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙার পর, সর্বশেষ দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায় ঘোষণার পর সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের ঘটনা ঘটে।

২০০১ সালের নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার পরের বছর তারা শারদীয় দুর্গাপূজা উৎসব বর্জন করেছিল। ওই ঘটনা তদন্তে গঠিত বিচার বিভাগীয় কমিশন পাঁচ হাজার ঘটনা আমলে নিয়ে এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে ২০১১ সালের ২৪ এপ্রিল প্রতিবেদন জমা দেয়।

রানা দাশগুপ্ত বলেন, ‘সাবেক দুই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টার সঙ্গে আমরা বিষয়টি নিয়ে কয়েক দফা কথা বললেও ফলাফল শূন্য।’

এদিকে তিন বছর আগে ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রামু, উখিয়া ও টেকনাফের ঘটনায় ১৯টি মামলা হয়, অভিযোগ দেওয়া হয় ৯৫৯ জনের বিরুদ্ধে। কিন্তু ওই ঘটনায় জড়িত অপরাধীদের অনেকেরই নাম বাদ দিয়ে অভিযোগপত্র দেওয়া এবং নির্দোষ অনেকের নাম অন্তর্ভুক্ত করার অভিযোগ ওঠে। ওই বিচারও আটকে আছে।

“যদি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এভাবে চলতে থাকে, তাহলে ২০-২৫ বছরের মধ্যে সংখ্যালঘুরা নৃগোষ্ঠীতে পরিণত হতে পারে। এমনকি অবস্থাটা পাকিস্তানের মতো হতে পারে, যেখানে সংখ্যালঘু এখন ১ শতাংশের কম,” বেনারকে জানান বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সুধাংশু কে দাস।


আদমশুমারির হিসাব

আদমশুমারির তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, হিন্দুধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা ক্রমাগত কমছে। স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালের প্রথম আদমশুমারি অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ ছিল। ২০০১ সালে তা ৯ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে আসে। আর ২০১১ সালে এই সংখ্যা দাঁড়ায় সাড়ে ৮ শতাংশ।

অবশ্য সুধাংশু কে দাস মনে করেন, আদমশুমারিতে যে সংখ্যা দেখানো হয়, হিন্দুদের কমে যাওয়ার সংখ্যা তার চেয়ে বেশি।

সংখ্যালঘু নেতাদের মতে, মূলত দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার কারণেই হিন্দুধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা কমছে। এর পেছনে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য এবং বিদেশে সামাজিক মর্যাদা ও উন্নততর জীবন পাওয়ার সুযোগ বড় ভূমিকা রাখছে।

তাঁরা বলেন, হিন্দুরা দেশ ছাড়লে মৌলবাদী রাজনৈতিক দলগুলোর দুই দিক থেকে লাভ। প্রথমত, ভোটের হিসাবে যারা নিশ্চিত বিপক্ষে অবস্থান করবে, তারা দেশ ছাড়লে ভোটের হিসাবে লাভ হয়। দ্বিতীয়ত, হিন্দুরা দেশছাড়া মানেই তাদের বাড়িঘর-সম্পত্তি বিনা টাকায় অথবা কম টাকায় পাওয়া যায়।

এ প্রসঙ্গে যুগ যুগ ধরে আটকে থাকা অর্পিত সম্পত্তি আইন নিয়ে জটিলতার অবসান চায় সংখ্যালঘুরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ অসীম সরকার বলেন, “সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, অর্পিত সম্পত্তি আইন নিয়ে এ পর্যন্ত যতটুকু অগ্রগতি হয়েছে, তার মূল কারণ প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ। তবে আমরা মনে করি, প্রধানমন্ত্রী অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতীক।”


পূজামণ্ডপে রাজনৈতিক নেতারা

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত মঙ্গলবার রাজধানীর বিভিন্ন পূজামণ্ডপ পরিদর্শনে গিয়ে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষকে বসবাসের আহ্বান জানান। প্রায় সব মন্ত্রী ও সাংসদ নিজ এলাকার পূজামণ্ডপ পরিদর্শন করেছেন।

গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে রাজধানীর ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে হিন্দু সম্প্রদায়ের দুর্গা পূজা পরিদর্শনে যান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানসহ দলের অন্য কয়েকজন নেতা।

“বিএনপি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে, হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান—এ দেশ আমাদের সবার। আমরা মনে করি, কোনো ভালো মানুষ, কোনো ভালো মুসলমান সাম্প্রদায়িক হতে পারে না। তেমনি কোনো ভালো হিন্দু, বৌদ্ধ বা খ্রিষ্টানও সাম্প্রদায়িক হতে পারে না,” সাংবাদিকদের জানান নজরুল ইসলাম খান।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।