রানা প্লাজার দুর্ঘটনায় সোহেল রানা সহ ৪২ জনের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ দায়ের
2015.06.01
ঢাকার অদূরে সাভারে দেশের ইতিহাসে ভয়াবহ শিল্প দুর্ঘটনার মামলায় ওই ভবনের মালিকসহ ৪২ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি। রানা প্লাজা ধসের দুই বছরের বেশি সময় পর ১ জুন দুটি মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হলো।
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ধসে পড়ে সাভারের রানা প্লাজা। ওই ঘটনায় ১ হাজার ১৩৪ জন নিহত হন। আহত ও পঙ্গু হয়ে যান প্রায় দুই হাজার মানুষ, যাঁদের প্রায় সবাই ওই ভবনের পাঁচটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন।
এই মামলার উল্লেখযোগ্য আসামিরা হলেন, রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানা ও তাঁর বাবা আবদুল খালেক, সাভার পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা উত্তম কুমার রায়, সাভার পৌরসভার সাবেক মেয়র রেফাত উল্লাহ প্রমুখ।
রানা প্লাজার ভবন ধসে হত্যা মামলায় ৪১ জনকে ও ইমারত নির্মাণ আইনে করা মামলায় ১৮ জনতে আসামি করা হয়েছে। এ হিসেবে দুই মামলার আসামি ৫৯ জন। কিন্তু তাঁদের মধ্যে ১৭ জনের নাম উভয় মামলার অভিযোগপত্রে থাকায় ব্যক্তি হিসেবে আসামি ৪২ জন।
“অভিযোগপত্র দুটি ঢাকার মুখ্য বিচারিক হাকিমের আদালতে জমা দিয়েছি। আগামী ২৮ জুন তা বিচারকের সামনে উপস্থাপন করা হবে,” বেনারকে জানান তদন্ত কর্মকর্তা ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সহকারী পুলিশ সুপার বিজয় কৃষ্ণ কর।
ইমরাত আইনের মামলাটির বিচার হবে মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে। আর ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে হবে হত্যা মামলার বিচার।
“২৩ এপ্রিল রানা প্লাজায় ফাটল ধরার পর ঝুঁকি জেনেও শ্রমিকদের কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। কাজ না করলে চাকরিচ্যুতির হুমকিও দেওয়া হয়েছিল বলে প্রমাণ পেয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা। এ কারণেই অভিযোগপত্রে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।” বেনারকে জানান অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর আনোয়ারুল কবির বাবুল। তাঁর মতে, অভিযোগ প্রমাণিত হলে এ মামলায় আসামিদের সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ড হতে পারে।
এ ছাড়া ইমারত বিধি না মেনে রানা প্লাজা নির্মাণের অভিযোগে রানাসহ ১৩ আসামির বিরুদ্ধে সাভার মডেল থানায় অন্য মামলাটি করেন রাজউকের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. হেলাল আহমেদ। ভবনের নকশায় ত্রুটি, অনুমোদন না নিয়ে ওপরের দিকে সম্প্রসারণ, নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহারের তথ্যও তদন্তে উঠে আসে।
মোট পাঁচ মামলা: মর্মান্তিক এ ঘটনা নিয়ে মোট পাঁচটি মামলা হয়। এর মধ্যে গত ২৫ এপ্রিল রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিন বাদী হয়ে ১৯৫২ সালের ইমারত নির্মাণ আইনের ১২ ধারায় সাভার থানায় একটি মামলা করেন।
একই দিন সাভার মডেল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ওয়ালি আশরাফ একই থানায় আরও একটি মামলা করেন। পুলিশের করা মামলায় রানা প্লাজার ধসকে অবহেলাজনিত মৃত্যু চিহ্নিত করে অভিযোগ আনা হয়। এ দুটি মামলা সিআইডি তদন্ত করছে।
এ ছাড়া পোশাকশ্রমিক জাহাঙ্গীর আলমের স্ত্রী শিউলী আক্তার বাদী হয়ে ঢাকা মহানগর মুখ্য বিচারিক হাকিমের আদালতে রানা প্লাজা ধসকে হত্যাকাণ্ড হিসেবে চিহ্নিত করে আরেকটি মামলা করেন। আদালত এই মামলাটিও তদন্ত করতে সিআইডিকে আদেশ দেন।
বিজয় কৃষ্ণ কর জানান, রাজউক ও পুলিশের করা মামলার তদন্তের সঙ্গে শিউলি আক্তারের অভিযোগেরও তদন্ত হচ্ছে।
এ ছাড়া ঢাকা জেলা গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক শাহিন শাহ পারভেজ ধামরাই থানায় অস্ত্র আইন ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে দুটি মামলা করেছিলেন। এ দুটি মামলার অভিযোগপত্র আগেই দেওয়া হয়েছে।
ওই ঘটনা সে সময় আন্তর্জাতিক সব গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়। দেশে কারখানার অবকাঠামোগত নিরাপত্তা ও কর্মপরিবেশের বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এলে সরকার ও মালিকেরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়।
দুই মামলা মিলিয়ে মোট ৪২ জন আসামির মধ্যে রানাসহ চারজন বর্তমানে কারাগারে। হত্যা মামলায় ২৫ জন এবং অন্য মামলায় সাতজন পলাতক রয়েছেন; বাকিরা জামিনে। অভিযোগপত্রে পলাতকদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন করেছেন তদন্ত কর্মকর্তা।
হত্যা মামলার অভিযোগপত্রে রাষ্ট্রপক্ষে ৫৯৪ জন এবং ইমারত বিধির মামলায় ১৩৫ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে।
যাঁরা বাদ পড়লেন: দুই মামলার এজাহারে সাভারের তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কবির হোসেন সরদারের নাম এলেও ‘সরকারের অনুমোদন না পাওয়ায়’ অভিযোগপত্রে তার নাম যুক্ত করা হয়নি বলে জানান মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বিজয় কৃষ্ণ কর।
এ ছাড়া ‘অভিযোগের প্রমাণ না পাওয়ায়’ প্রকৌশলী আবদুর রাজ্জাক, প্রকৌশলী এমতেমাম হোসেন, সহ প্রকৌশলী আলম মিয়া, আব্দুল মান্নান, রাসেল আহমেদ, আলমগীর হোসেন, রানা প্লাজায় থাকা ফ্যান্টম টেকের অন্যতম মালিক ডেভিড মেয়ের রেকো এবং তন্ময় হাউজিং কোম্পানির চেয়ারম্যান কাজী সাইফুল ইসলাম বাবুকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন করেছেন তদন্ত কর্মকর্তা।
উভয় মামলার ১৭ আসামী: উভয় মামলায় রয়েছে ১৭ আসামির নাম। এঁরা হলেন ভবন মালিক সোহেল রানা, তার বাবা আব্দুল খালেক ওরফে কুলু খালেক, সোহেল রানার মা মর্জিনা বেগম, সাভারের পৌর মেয়র রেফাত উল্লাহ, কাউন্সিলর মোহাম্মাদ আলী খান, প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম, উপ-সহকারী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান রাসেল, নিউওয়েব বাটন লিমিটেডের চেয়ারম্যান বজলুস সামাদ আদনান, নিউওয়েব স্ট্রাইপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদুর রহমান তাপস, ইথার টেক্সটাইলের চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান ওরফে আনিসুজ্জামান, আমিনুল ইসলাম, সাইট ইঞ্জিনিয়ার মো. সারোয়ার কামাল, সাভার পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কমকর্তা উত্তম কুমার রায়, সাবেক সহকারী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান, নগর পরিকল্পনাবিদ ফারজানা ইসলাম, রেজাউল ইসলাম ও নান্টু কন্ট্রাকটর।
দুই মামলার অন্যান্য আসামি: আবু বক্কর সিদ্দিক, মো. মধু, অনিল দাস, মো. শাহ আলম ওরফে মিঠু, মো. আবুল হাসান, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন বিভাগের সাবেক উপ-প্রধান পরিদর্শক মো. আব্দুস সামাদ, উপ-প্রধান পরিদর্শক মো. জামশেদুর রহমান, উপ-প্রধান পরিদর্শক বেলায়েত হোসেন, পরিদর্শক (প্রকৌশল) মো. ইউসুফ আলী, পরিদর্শক (প্রকৌশল) মো. মহিদুল ইসলাম, ইমারত পরিদর্শক মো. আওলাদ হোসেন, ইথার টেক্সটাইলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জান্নাতুল ফেরদৌস, মো. শফিকুল ইসলাম ভূঁইয়া, মনোয়ার হোসেন বিপ্লব, মো. আতাউর রহমান, মো. আব্দুস সালাম, বিদ্যুৎ মিয়া, সৈয়দ শফিকুল ইসলাম জনি, মো. আব্দুল হামিদ, আব্দুল মজিদ, মো. আমিনুল ইসলাম, নয়ন মিয়া, মো. ইউসুফ আলী, তসলিম ও মাহবুল আলম।
অ্যাকশন এইডের জরিপ : গত ২৩ এপ্রিল রানা প্লাজা ট্রাজেডি নিয়ে প্রকাশিত জরিপে বলা হয়, ওই ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের ৫৫ শতাংশই এখনও বেকার। ২২ শতাংশ এখনও গুরুতর অসুস্থ।
রানা প্লাজা নিয়ে ১ হাজার ৪১৪ ক্ষতিগ্রস্তের মধ্যে জরিপ চালায় বেসরকারি সংস্থা অ্যাকশন এইড। এর মধ্যে ৯১৫ জন নারী এবং ৪৯৯ জন পুরুষ।
ক্ষতিগ্রস্তরা বলছেন, তাদের ৭০ দশমিক ৬ শতাংশ মোটামুটি সুস্থ। আর ২২ দশমিক ৬ শতাংশের অবস্থা খারাপ। সুস্থদের ৫৫ শতাংশ শ্রমিক এখনও বেকার। ৪৪ শতাংশ অন্যান্য চাকরিতে গেছে। ৫৪ শতাংশ শ্রমিকের দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে কষ্ট হচ্ছে।
জরিপের সময়ে অ্যাকশন এইড ক্ষতিগ্রস্তদের পাশাপাশি তারা সরকারি, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার এবং এনজিও প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলেছে।
অনুষ্ঠানে আরও জানানো হয়, ক্ষতিপূরণের জন্য ডোনার ট্রাস্ট ফান্ডে প্রাথমিকভাবে ৪ কোটি ডলার তহবিলের আশা করা হয়েছিল। স্থানীয় মুদ্রায় যা ৩২০ কোটি টাকা। তবে শেষ পর্যন্ত তা ৩ কোটি ডলারে নামিয়ে আনা হয়। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে ১২৭ কোটি টাকা জমা হলেও বিতরণ হয়েছে ২২ কোটি ৯৩ লাখ টাকা।
ওই অনুষ্ঠানে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের উপপরিচালক ফিল রবার্টসন বলেছেন, “বাংলাদেশ যদি আরেকটি রানা প্লাজা এড়াতে চায়, তবে তাদের উচিত শ্রম আইনের প্রয়োগ করা। সংস্থাটি বলছে, শ্রমিকরা মারধরের শিকার, গালাগাল, ক্ষেত্রবিশেষে যৌন হয়রানির শিকার, মাতৃকালীন ছুটি না দেয়াসহ তাদের অধিকারবঞ্চিত করা হচ্ছে।”