দু'বছর পর কক্ষপথে উড়বে বাংলাদেশের স্যাটেলাইট

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2015.11.11
BD-satellite বুধবার ঢাকায় বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) এবং ফ্রান্সের মহাকাশ সংস্থা থ্যালেস এলনিয়ার মধ্যে সিস্টেম ক্রয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১১ নভেম্বর, ২০১৫
বেনার নিউজ

পৃথিবীর কক্ষপথে প্রথম স্যাটেলাইট (কৃত্রিম উপগ্রহ) উৎক্ষেপণ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ২ হাজার ৯৬৭ কোটি টাকা ব্যয়ে আগামী ২০১৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে ‘বঙ্গবন্ধু’ নামের এই স্যাটেলাইটটি উৎক্ষেপণের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

এটি মূলত একটি সম্প্রচার এবং যোগাযোগ স্যাটেলাইট। বর্তমানে বিরাট অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে ভাড়ায় বিদেশী কোম্পানির স্যাটেলাইট ট্রান্সপন্ডার ব্যবহার করছে বাংলাদেশ। নিজস্ব স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের পর নির্বিঘ্ন সম্প্রচারের পাশাপাশি ভাড়া বাবদ খরচ হওয়া বিপুল অর্থের সাশ্রয় হবে। এছাড়া অন্যান্য দেশও এই স্যাটেলাইট ব্যবহার করার সুযোগ পাবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।


ফ্রান্সের সঙ্গে স্যাটেলাইট সিস্টেম ক্রয় চুক্তি সম্পন্ন

‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট’ উৎক্ষেপণে বুধবার ঢাকায় বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) এবং ফ্রান্সের মহাকাশ সংস্থা থ্যালেস এলনিয়ার মধ্যে সিস্টেম ক্রয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এ চুক্তি অনুযায়ী, ফরাসি প্রতিষ্ঠানটি বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের কাঠামো, উৎক্ষেপণ ব্যবস্থা, ভূমি ও মহাকাশের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, ভূ-স্তরে দুটি স্টেশন পরিচালনা ও ঋণের ব্যবস্থা করবে।

উপগ্রহ উৎক্ষেপণের মূল কাজ স্যাটেলাইট সিস্টেম কেনার জন্য খরচ হবে এক হাজার ৯৫১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। বিটিআরসির চেয়ারম্যান ড. শাহজাহান মাহমুদ ও ফ্রান্সের থ্যালেস এলেনিয়া স্পেসের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী জ্যঁ লইক গ্যাল নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এই চুক্তিতে সই করেন।

পুরো প্রকল্পটিতে খরচ (প্রায় ২ হাজার ৯৬৭ কোটি টাকা) সরকারি-বেসরকারি তহবিল ব্যবস্থাপনায় যোগাড় করার কথা জানিয়েছে সরকার।

জানা যায়, সম্প্রচারের পাশাপাশি নির্বিঘ্ন যোগাযোগের ব্যবস্থা করতে গাজীপুরের জয়দেবপুর ও রাঙ্গামাটির বেতবুনিয়ায় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট চ্যানেলের গ্রাউন্ড স্টেশন বসছে। এই স্যাটেলাইটের ৪০টি ট্রান্সপন্ডার ক্যাপাসিটির ২০টি থাকবে বাংলাদেশে।


কয়েক বছরেই উঠে আসবে পুরো বিনিয়োগ

বিরাট অর্থ বিনিয়োগ করে স্যাটেলাইটটি উৎক্ষেপনের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। তবে সরকার মনে করছে কয়েক বছরেই এ বিনিয়োগের অর্থ উঠে আসবে।

এ বিষয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম বলেন, “বর্তমানে দেশের স্যাটেলাইট চ্যানেল, ইন্টারনেট প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ট্রান্সপন্ডার ভাড়া বাবদ প্রায় ১৪ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়। এই স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের পর আমাদের আর কোনো খরচ হবে না। স্যাটেলাইটের বর্ধিত ফ্রিকোয়েন্সি ভাড়া দিয়ে ২৫০ থেকে ৩০০ কোটি টাকা আয় করেত পারব। এর ফলে মাত্র ছয় থেকে সাত বছরের মধ্যে আমরা যে ব্যয় করছি তা তুলে আনতে সক্ষম হব এবং আমরা লভ্যাংশের দিকে অগ্রসর হব।”


যোগাযোগ ও সম্প্রচারের আওতায় আসবে পুরো দেশ

প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম বলেন, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ হলে দেশের সব মানুষকে যোগাযোগ ও সম্প্রচার সুবিধার আওতায় আনতে সরকারের লক্ষ্য পূরণ হবে। একই সঙ্গে দুর্যোগপ্রবণ বাংলাদেশে নিরবচ্ছিন্ন টেলিযোগাযোগ সেবা নিশ্চিত হবে।

বাংলাদেশ টেলিকম রেগুলেটরি কমিশনের সচিব মোহাম্মদ সারোয়ার আলম বেনারকে বলেন, “স্যাটেলাইটটির আওতায় আসবে পুরো বাংলাদেশ। ফলে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেয়া সহজ হবে। ইন্টারনেট যোগাযোগও আরো সহজ হয়ে উঠবে। আঞ্চলিক স্যাটেলাইট হিসেবে সার্কভুক্ত দেশগুলো ছাড়াও ইন্দোনেশিয়া থেকে তাজিকিস্তান পর্যন্ত এই স্যাটেলাইটটির আওতা থাকবে। এসব দেশের বেশিরভাগেরই নিজস্ব স্যাটেলাইট নেই। তারা আমাদের স্যাটেলাইট থেকে সেবা নিতে পারবে।”


আছে ভিন্নমতও

প্রস্তাবিত স্যাটেলাইটটি বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক হবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে আশা করা হলেও সংশ্লিষ্ট অনেকেই এ বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেছেন। দূর দেশের ওপর স্যাটেলাইট বসিয়ে দেশের প্রয়োজনীয় কাজ মেটোনো গেলেও দূরত্বের কারণে অন্যান্য দেশ 'বঙ্গবন্ধু’ স্যাটেলাইটের প্রতি আগ্রহী হবে এমন শঙ্কা তাদের।

জানা যায়, ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নে (আইটিইউ) বাংলাদেশের নিজস্ব অরবিটাল পজিশন ১০২ ডিগ্রি স্লট  পাওয়ার জন্য আবেদন করা হয়েছিল। কারণ, এ স্লট দেয়ার কর্তৃপক্ষ হচ্ছে আইটিইউ। বাংলাদেশের স্যাটেলাইট ১০২ ডিগ্রিতে উৎক্ষেপণ করা হলে ফ্রিকোয়েন্সি পেতে সমস্যা তৈরি হতে পারে বলে আপত্তি জানায় যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, রাশিয়া, অষ্ট্রেলিয়াসহ এশিয়া মহাদেশ ও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ।

১০২ ডিগ্রিতে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের অনুমোদন না পেয়ে, বিকল্প প্রস্তাব দেয়া হয় ৬৯ ডিগ্রি পূর্বে। তবে এতে একই কারণ দেখিয়ে আপত্তি জানায় মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও চীন। সবশেষে নিরক্ষরেখার ১১৯ দশমিক ১ ডিগ্রিতে(পূর্ব) ২ কোটি ৮০ লাখ মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ প্রায় ২১৯ কোটি টাকায় রাশিয়ার ইন্টারস্পুটনিক ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অব স্পেস কমিউনিকেশনের কাছ থেকে স্লট  লিজ নিয়েছে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাই‌‌টির সাধারণ সম্পাদক এফ আর সরকার মনে করেন, ১১৯.১ ডিগ্রির অরবিটাল স্লটে (নিরক্ষরেখা) পাঠানো স্যাটেলাইটে মায়ানমার, লাওস, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, অস্ট্রেলিয়া, তাইওয়ান, জাপান, কোরিয়া, চীন ও মঙ্গোলিয়ার ফুটপ্রিন্ট ভাল পাওয়া যাবে। এসব দেশগুলোর অনেকেরই নিজস্ব স্যাটেলাইট রয়েছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের স্যাটেলাইট ব্যবহারে আগ্রহী হবে না।

তার মতে, বাংলাদেশের স্যাটেলাইটটি ৭০ বা ১০০ ডিগ্রি অরবিটাল স্লটে পাঠানো গেলে ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান, নেপাল, ভূটানের মত দেশগুলোর পরিস্কার ফুট প্রিন্ট পাওয়া যেত। কিন্তু ১১৯.১ ডিগ্রিতে পাঠানোয় এসব দেশগুলোর আগ্রহ না থাকতে পারে। তাই প্রকল্পটি বাণিজ্যিকভা্বে সফলতার মুখ না দেখার আশঙ্কা রয়েছে বলে তিনি মনে করেন।

বর্তমানে বিশ্বে প্রায় ৬০টির মতো দেশের নিজস্ব উপগ্রহ রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে নিজস্ব স্যাটেলাইট রয়েছে ভারত (১৯৭৫), পাকিস্তান (১৯৯০) ও শ্রীলঙ্কার (২০১২)।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।