আত্মহত্যা রোধে এক মায়ের প্রচার অভিযান
2015.05.29
আত্মহত্যা কোন সমাধান নয়। হতাশা কাটিয়ে উঠলেই সুন্দর জীবনের দেখা মিলবে। এমনই আলোকিত জীবনের ডাক নিয়ে বাংলাদেশে শুরু হল ‘ব্রাইটার টুমোরো’ নামের একটি ক্যাম্পেইন।
আত্মহত্যা প্রবণতায় ভুগতে থাকাদের সে পথ থেকে সরিয়ে আনাই এর মূল উদ্দেশ্য। এই ক্যাম্পেইনের উদ্যোক্তা জয়শ্রী জামান নামের একজন মা। যিনি সাংবাদিকতা পেশায় কর্মরত এবং যার নিজের দুই সন্তানই গত বছর আত্মহত্যা করেন।
গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর অন্যান্য দিনের মত অফিস থেকে বাসায় ফিরে ঘরের দরজায় কড়া নাড়লেও কোন সাড়া পাননি জয়শ্রী জামান। বাইরে থেকে দরজা খোলার পর আবিষ্কার করলেন দুই সন্তানের মরদেহ।
জয়শ্রী জামান বেনারকে বলেন, “আমার মেধাবী দুই বাচ্চা আমার সঙ্গে সঙ্গে জীবন যুদ্ধ করছিল। তাদের মধ্যে হতাশার ছিল কিন্তু তারা আত্মহত্যার করবে এমনটি কখনো আঁচ করতে পারিনি।”
তিনি বলেন, যখন ওরা আত্মহত্যার কথা বলেছে আমি হালকা ভাবে নিয়েছি। ভাল করে বুঝিয়ে কিছু বলিনি। জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে আমারও মাঝে মাঝে আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে হয়েছে। কিন্তু আমি সে চিন্তাকে তাড়াতে পারলেও আমার দুই শিশু সন্তান তা পারেনি।”
নিজের এমন অভিজ্ঞতা থেকে জয়শ্রী জামান অনুভব করেন আত্মহত্যা প্রবণতার লক্ষণ গুলো আঁচ করতে পরিবারের দায়িত্ব খুবই জরুরী। কথা বলে এসব হতাশা মানুষকে থেকে বের করা সম্ভব। পরিবারের পাশাপাশি সমাজে বা রাষ্ট্রেও এমন একটি জায়গা থাকা উচিত যেখান থেকে হতাশা কাটাতে সহায়তা পাওয়া যায়।
“বিষয়টি হৃদয় দিয়ে অনুভব করেই যারা আত্মহত্যার প্রবণতায় ভুগছেন, তা থেকে তাদের সরে আসতে সহায়তার জন্য এই ক্যাম্পেইনের উদ্যোগ নিয়েছি।” জানান জয়শ্রী জামান।
‘ব্রাইটার টুমোরো’ ক্যাম্পেইনের অংশ হিসেবে হতাশা কাটাতে বিভিন্ন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জরীপ চালাবে। সেসব স্কুলে আলোচনার ব্যবস্থা করা হবে। এমনকি বাবা মায়ের জন্যেও কাউন্সেলিং এর ব্যবস্থা করা হবে।
জয়শ্রী বলেন, আমরা আত্মহত্যা শব্দটিকে এড়িয়ে হতাশা কাটিয়ে ওঠার কাটাতে ব্যাপকভাবে ক্যাম্পেইন চালাতে চাই। ঢাকা থেকে শুরু হলেও দেশব্যাপী এ ক্যাম্পেইন ছড়ানোর ইচ্ছে রয়েছে।
কারা আছেন এর সঙ্গে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সব ধরনের আগ্রহী মানুষ এ ক্যামেইনে যোগ দিতে পারবেন। দায়িত্ব নিতে পারবেন। তবে এই মুহুর্তে সঙ্গী হয়েছেন বন্ধু বান্ধব এবং আত্মীয় স্বজন। এদের মধ্যে ডাক্তার ও সাংবাদিকদের সংখ্যাই বেশি। ক্যাম্পেইনের অর্থের যোগানও তাদের কাছ থেকেই আসবে।
ভবিষ্যতে এ নিয়ে কোন সংগঠন গড়ে তোলার বিষয়টিও তাদের মাথায় আছে বলে জানান তিনি। এছাড়া সারা বিশ্বে এ ক্যাম্পেইন ছড়িয়ে পড়ুক সে প্রত্যাশাও ব্যক্ত করেন তিনি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে প্রতিদিন ২৮ জন করে বছরে ১০ হাজার মানুষ বাংলাদেশে আত্মহত্যা করে। যাদের বেশিরভাগই নারী। অথচ বাংলাদেশে আত্মহত্যার প্রবণতায় ভোগা মানুষদের কাউন্সেলিং এর জন্যে কোন ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। বড় শহরের হাসপাতালে মানসিক রোগের আলাদা বিভাগ থাকলেও জেলা শহর বা প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষজন এরকম কোন সুবিধাই পান না। আবার মানসিক রোগ বিভাগে যেতেও অনেকে অসস্তিতে ভোগেন। কারণ, সাধারণ মানুষ তাদেরকে পাগল মনে থাকে।
এমন অবস্থায় জয়শ্রী জামানের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে মনোচিকিৎসরা।
এ বিষয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ডা. হেলাল উদ্দিন বেনারকে বলেন, বাংলাদেশে প্রতি লাখে ৭ দশমিক ৮ জন আত্মহত্যায় মারা যায়। বর্তমানে সারাদেশে প্রায় ৬৫ লাখ মানুষ আত্মহত্যার ঝুঁকিতে রয়েছে। এ ধরনের ক্যাম্পেইন সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করবে। হতাশাগ্রস্ততা থেকে মানুষকে উত্তরণ করবে।
তিনি বলেন, যৌতুক, দাম্পত্য কলহ, সম্পর্কে জটিলতা, অনাকাঙ্খিত গর্ভধারণ, প্রেম ও পরীক্ষায় ব্যর্থতা, অর্থনৈতিক সংকট আত্মহত্যার প্রধান কারণ। ১৫-৩০ বয়সীদের মধ্যেই আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। এ থেকে বাঁচাতে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তির উপর নজরদারি বৃদ্ধি, সামাজিক বন্ধনকে দৃঢ় করতে হবে। প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ বিষয়ে শিক্ষা দেওয়াসহ আত্মহত্যা প্রতিরোধে সহযোগীতা চাওয়ার জন্য জাতীয় পর্যায়ে হেল্পলাইন চালু করাও প্রয়োজন।
মনোচিকিৎসক ডা. সালাহউদ্দিন কায়সার এ উদ্যোগকে‘ স্বাগত’ জানিয়ে বেনারকে বলেন, আত্মহত্যার প্রবণতা প্রতিরোধযোগ্য। সে বিষয়টি সমাজের সকল স্তরের মানুষকে জানানো প্রয়োজন। এ ক্যাম্পেইন সে কাজটি করতে সক্ষম হবে আশা করি। শতকরা ৯০ ভাগ ক্ষেত্রেই আত্মহত্যার প্রবণতা কোন না কোন মানসিক রোগের লক্ষণ যেগুলোর চিকিৎসাও সম্ভব।
তবে খেয়াল রাখতে হবে যাতে এ ক্যাম্পেইনের ফলে এ আত্মহত্যা প্রবতায় ভোগারা আরো উৎসাহী হয়ে না পড়ে।
ক্যাম্পেইনে সে বিষয়টি মাথায় রেখে আত্মহত্যা শব্দটির পরিবর্তে হতাশা থেকে বেরিয়ে আসার উপর জোর দেওয়া হয়েছে বলে জানান জয়শ্রী জামান।
মনরোগ বিশেষজ্ঞ ড. ফারুক হোসেন বলেন, মনরোগ নিয়ে আমাদের অঞ্চলে ধারনার খুব অভাব রয়েছে। এ ধরনের অুসখে মানুষ পীর বা ইমামদের কাছে ঝাড়ফুঁক নিতে অভ্যস্ত।
তিনি জেলা পর্যায়ে বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা বাড়ানোর পাশাপাশি আত্মহত্যা প্রবণতার জন্য দায়ী অসুখগুলোর প্রাথমিক লক্ষণ বোঝার উপায় কি, সেই বিষয়ে সাধারণকে জানানোর উদ্যোগও দরকার।
জয়শ্রী জামানের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানান আঙ্গুর নাহার মন্টি নামের একজন মা।
তিনি বলেন, নানা পারিপার্শ্বিক কারণে সন্তানরা হতাশায় ভুগতে পারে। জয়শ্রী জামানের দুই সন্তান হারানোর বেদনা আমরা অনুভব করি। তাই তার এ ক্যাম্পেইনের সঙ্গে আমরা আছি। সমাজের সব স্তরের মানুষেরই এ বিষয়ে বিশদ ধারনা পাওয়া জরুরি।