পোশাক খাতে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ টিআইবি’র

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2016.01.14
BD-tib পোশাক খাতে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ তুলেছে দুর্নীতি পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
বেনার নিউজ

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ তুলেছে দুর্নীতি পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। কার্যাদেশ পাওয়া থেকে শুরু করে উৎপাদন ও সরবরাহ পর্যায় পর্যন্ত  ১৬ ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়ম খুঁজে পাওয়ার কথা বলছে প্রতিষ্ঠানটি। যার সঙ্গে কারখানার মালিক, মার্চেন্ডাইজার ও বিদেশি ক্রেতাদের পর্যবন্ত জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার প্রকাশিত সংস্থাটির এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে। এক সংবাদ সম্মেলনে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের জার্মানি চ্যাপ্টারের সহায়তায় করা গবেষণাটির ফলাফল তুলে ধরেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ ইফতেখারুজ্জামান। তিনি জানান, ২০১৪ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সংগ্রহ করা তথ্যের ভিত্তিতেই এই গবেষণা করা হয়েছে।

পোশাক খাত সংশ্ষ্টিরা কিছু কিছু কাজ ‘অর্থের বিনিময়ে’ করা হয় স্বীকার করলেও তাকে ঘুষ বলতে নারাজ। তাদের মতে, কাজের গতি বৃদ্ধির লক্ষ্যেই সামান্য কিছু ক্ষেত্রে এটা হয়ে থাকে। তবে তাকে সাধারণীকরণ করে সকল ক্ষেত্রে বলা ঠিক হবে না। এ ধরনের প্রতিবেদন দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করবে বলে মন্তব্য করেন তারা।


যে ১৬টি ধাপে দুর্নীতি

টিআইবি জানায়, তৈরি পোশাক খাতের সরবরাহ ব্যবস্থার (সাপ্লাই চেইন) তিনটি পর্যায় হল- কার্যাদেশ, উৎপাদন ও সরবরাহ। এসব পর্যাঠয়ের অন্তত ১৬টি ধাপে দুর্নীতি চিহ্ন বিদ্যমান।

এরমধ্যে কার্যাদেশ পর্যায়ে চার ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়মের কথা জানান টিআইবির সিনিয়র কর্মসূচি ব্যবস্থাপক শাহজাদা এম আকরাম। এগুলো হলো: কমপ্লায়েন্স নিরীক্ষককে ঘুষ দেওয়া, যার ফলে ক্রেতার নির্ধারিত কমপ্লায়েন্স চাহিদা সম্পর্কে সন্তোষজনক প্রতিবেদন পাওয়া যায়। ছোট আকারের কারখানা কর্তৃপক্ষের মার্চেন্ডাইজারকে ঘুষ দেওয়া, যাতে কার্যাদেশ পাওয়া সহজ হয়। কারখানার পক্ষ থেকে নকল কাগজপত্র তৈরি করা,  অথবা বিভিন্ন কাগজপত্র প্রয়োজন অনুযায়ী পরিবর্তন করা। আর পছন্দ অনুযায়ী কার্যাদেশ পেতে কারখানার মালিক বা সরবরাহকারী ঘুষের বিনিময়ে ক্রেতা বা এর এজেন্টের ক্রয়ের সিদ্ধান্তে প্রভাব বিস্তার করা।

টিআইবির গবেষণা ফলাফলে উৎপাদন পর্যায়ে নয় ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়মের কথা উঠে আসে। যেগুলো হলো: তৈরি পোশাক কারখানার উপকরণ নির্দিষ্ট এক্সেসরিজ কারখানা থেকে কিনতে মার্চেন্ডাইজারের পক্ষ থেকে বাধ্য করা; কারখানার সে উপকরণ প্রয়োজনের তুলনায় বেশি আমদানি করা এবং সে বাড়িতি উপকরণ পরে খোলা বাজারে বিক্রি করা; অবৈধভাবে কারখানার পক্ষ থেকে ব্যাক টু ব্যাক এলসি ভাঙানো;  কর্মঘণ্টা, ন্যূনতম মজুরি, এমনকি শ্রমিক অধিকার-সংক্রান্ত আইন লঙ্ঘন; চুক্তিবহির্ভূতভাবে বিভিন্ন কারখানাকে সাব-কন্ট্রাক্ট দেওয়া; চুক্তিবহির্ভূতভাবে ক্রেতাদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন চাহিদা পূরণে কারখানাকে বাধ্য করা;  প্রাপ্ত তথ্য গোপন করার জন্য নিরীক্ষককে কারখানা মালিকদের ঘুষ দেওয়া; ক্রেতাদের পরিদর্শন কিংবা কমপ্লায়েন্স প্রতিবেদন পরিবর্তন করা ও ক্রেতাদের ইচ্ছেমতো কার্যাদেশ বাতিল করা।

সর্বশেষ সরবরাহ পর্যায়েও তিন ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়ম হয় বলে উল্লেখ করে টিআইবি। এগুলো হলো: মানের ঘাটতি ও নিম্নমানের পণ্যের বিষয়টি গোপন করতে কারখানার পক্ষ থেকে মান নিয়ন্ত্রককে ঘুষ দেওয়া; আবার মান নিয়ন্ত্রকের পক্ষ থেকে কারখানার কাছে  নিয়মবহির্ভূতভাবে অর্থ দাবি করা এবং গন্তব্য দেশের বন্দর পরিদর্শনের সময় ন্যূনতম মূল্য প্রদানের উদ্দেশ্যে ক্রেতার মিথ্যা অভিযোগ উত্থাপন করা।

এ প্রতিবেদন নিয়ে টিআইবি অংশীদারদের সঙ্গে আলোচনা করবে বলে জানান ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘সুশাসনের দায় আমাদের। মুনাফা স্বচ্ছ করার জন্য সুশাসন দরকার।’


টিআইবির সুপারিশ

গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে আসা অনিয়ম ও দুর্নীতি রোধে পোশাক খাতের অনিয়ম ও দুর্নীতি রোধে ২৭ দফা করণীয় ও সুপারিশ করা হয়েছে টিআইবির এই প্রতিবেদনে।

তৈরী পোশাক খাতের সাপ্লাই চেইনে দুর্নীতি মোকাবেলায় বায়ার, বিজিএমইএ, সরকার, সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমের উদ্দেশ্যে টিআইবির পক্ষ থেকে ২৭ দফা করণীয় ও সুপারিশ করা হয়। এর মধ্যে ১৩ দফা তাৎক্ষণিক করণীয় ও ১৪ দফা কাঠামোগত সুপারিশ।

তাৎক্ষণিক করণীয়গুলোর মধ্যে টিআইবি উল্লেখ করে -দুর্নীতির ঘটনা বিজিএমইএ’কে জানিয়ে ‘সালিশ সেল’ কর্তৃক বিষয়টি সুরাহা করার পাশাপাশি তদারকি ক্ষমতাসম্পন্ন কর্তৃপক্ষকে (যেমন বিজিএমইএ) সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্তির জন্য জানানো; ক্রেতা কর্তৃক পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই আকস্মিক কারখানা নিরীক্ষণ বা পরিদর্শন করা, প্রয়োজনে বায়ার কার্যাদেশ বাতিল এবং কারখানার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা ইত্যাদি।

টিআইবির করা কাঠামোগত সুপারিশগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: বায়ারদের সঙ্গে সমন্বিতভাবে একটি অনুসরণযোগ্য ‘মডেল চুক্তিপত্র’ তৈরি করা; যেখানে পুরো প্রক্রিয়া দেওয়া থাকবে। চুক্তি করার সময় কারখানার সকল নিয়ম ও শর্ত পরিষ্কারভাবে নির্দেশিত চুক্তিপত্রে প্রদর্শন করা,  বিজিএমই ও বায়ার’র যৌথ উদ্যোগে বায়ারদের কমপ্লায়েন্স চাহিদা মেনে চলে এমন কারখানার একটি সমন্বিত তালিকা তৈরি করা ও তা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা। বিজিএমইএ কর্তৃক সংশোধিত শ্রম আইন ও এর প্রয়োগ সম্পর্কে সদস্যদের তথ্য ও প্রশিক্ষণ দেয়া। সনদপ্রাপ্ত তৃতীয় পক্ষ নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠানের তালিকা তৈরি ও প্রকাশ করা।

এছাড়াও অন্যান্য সুপারিশগুলোর মধ্যে বায়ার বা ভোক্তা কর্তৃক (অনৈতিক, অসাধু ও অন্যায্য আচরণ সংক্রান্ত) অভিযোগ দেওয়ার জন্য সহজে ও বিনামূল্যে প্রবেশযোগ্য সতর্কীকরণ হটলাইন স্থাপন, সরকারিভাবে সকল কারখানার জন্য এমন একটি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা যেখানে প্রত্যেক কারখানার জন্য আলাদা শনাক্তকারী নম্বর থাকবে, যেন তথ্যের কোনো ধরনের কারসাজি, নকল করা অথবা সংশোধন করা না যায়, কারখানার ন্যূনতম মজুরি সময়মতো পরিশোধ নিশ্চিত করার জন্য সরকারি উদ্যোগে তদারকি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

সুপারিশগুলোর বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করার ভিত্তিতে প্রতিবেদন প্রণয়ন ও অ্যাডভোকেসি করার জন্য নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমকে সক্রিয়ভাবে কাজ করার আহ্বান জানায় টিআইবি।


‘ঘুষ নয় স্পিড মানি’

টিআইবির আনা অভিযোগকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেনি পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা। তবে এ ধরনের অর্থ লেনদেনকে ঘুষ না বলে ‘স্পিড মানি’ বলে মন্তব্য করেছেন তারা।

তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র প্রথম সহসভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বেনারকে বলেন, এ খাতে অর্থ লেনদেন একেবারেই হয় না তা ঠিক নয়। তবে একটা সেক্টরকে নিয়ে যখন কথা বলতে হয়, তখন আরো সতর্ক থাকা দরকার বলে আমি মনে করি। পৃথিবীর সব জায়গায় দুর্নীতি আছে। তবে সবাই দুর্নীতি করে না।

ঘুষকে তিনি ‘স্পিড মানি’ উল্লেখ করে বলেন, কাজকে ত্বরান্বিত করতে কিছু ক্ষেত্রে অর্থ লেনদেন করা হয়, তবে সেটা সবাই করেন না। তাই টিআইবির প্রতিবেদনে এভাবে সাধারণীকরণ করা ঠিক হয়নি।  একটা কাজের  ক্ষেত্রে দ্রুততা গুরুত্বপূর্ণ। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গার্মেন্টস সেক্টরকে চলতে হয়। সেক্ষেত্রে কাজগুলো দ্রুত করতে কিছু কিছু সময় নিয়মের ব্যত্যয় হতে পারে।

এই স্পিড মানির বিষয়টিও যাতে সহনীয় পর্যায়ের বাইরে না যায়, সে বিষয়ে তৎপর হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন এই ব্যবসায়ী নেতা।

তবে দেশের পোশাকখাতের জন্য টিআইবি’র এ প্রতিবেদন হুমকি হয়ে দাঁড়াবেনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রতিদিনই এ ধরনের নতুন নতুন ‘হুমকি’ আসছে। এমন হুমকি মোকাবেলা করেই এগিয়ে চলছি আমরা।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।