ইন্দোনেশিয়া নৌকায় উদ্ধার করা বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠাবে
2015.06.01
ইন্দোনেশিয়া তার আচেহ প্রদেশের উপকূলে আশ্রিত ৮০০ বাংলাদেশিকে দেশে ফেরত পাঠানোর পরিকল্পনা করছে।
কিন্ত অনেকেই দেশে ফিরে যেতে চাইছে না।
তারা বলছে, তারা মালয়েশিয়া যেতে চায়, অথবা যেখানে তারা কাজ করে খেতে পারবে সেখানে যেতে চায়। মাসাধিক কাল সাগরে ভেসে থেকে পাচারকারীদের হাতে নির্যাতন ও পণ আদায়ের চাপ সহ্য করে অবশেষে তারা এই উপকূলে এসে ভিড়ে।
প্রাদেশিক সরকারের সামাজিক বিভাগের পরিচালক আল হুদরি বলেন, বাংলাদেশি অভিবাসীরা এখন আচেহ’র বিভিন্ন স্থানে ঠাই পেয়েছে, তাদেরকে পর্যায়ক্রমে ফেরত পাঠানো হবে।
শুক্রবার বেনার নিউজকে তিনি বলেন, “তাদেরকে শিঘ্রই উত্তর সুমাত্রার রাজধানী মেদানে নেয়া হবে, বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর জন্য সেখানে রাখা হবে”।
হুদরি জানান, ইন্দোনেশিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত নাজমুল কাউনাইন ইন্দোনেশিয়ার পশ্চিম প্রদেশের উপকূলে উদ্ধারকৃত স্বদেশীদের দেখতে এসেছিলেন।
“তবে এখন পর্যন্ত তাদেরকে ফেরত পাঠানোর দিনক্ষণ ঠিক হয় নাই। ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা ও কেন্দ্রীয় সরকার সিদ্ধান্ত নেবে কবে তারা দেশে ফিরবে। তাদেরকে ফেরত না পাঠানোর কোনো কারণ নাই, যেহেতু তারা অর্থনৈতিক স্বার্থে অভিবাসী হয়েছে,” জানান তিনি।
সব কিছু বিক্রি করে এসেছে
বাংলাদেশ থেকে আসা বেশকিছু অভিবাসী বেনার নিউজকে জানায়, দেশে ফিরে গিয়ে তাদের ভালো কিছুর আশা নেই। তারা চায়, ইন্দোনেশিয়ার সরকার যেন তাদের জন্য কাজ খুজে দেয় অথবা তাদেরকে মালয়েশিয়া যাবার সুযোগ করে দেয়।
মুহাম্মদ তৌরিজার রহমান(২৫) জানায়, মালয়েশিয়া যাবার জন্য সে তার নিজস্ব সবকিছু বিক্রি করে দালালের হাতে ৩ হাজার মার্কিন ডলার তুলে দিয়েছে।
সে এবং আরো ২৪৬ জন অভিবাসী পুনতেউত গ্রামে লোকসেউমাভি ইমিগ্রেশন অফিসের শেল্টারে আশ্রয় নিয়েছে।
সে আরো বলে, “ আমি বাংলাদেশে ফিরে যেতে চাই না, কারণ আমি সেখানে টাকা রোজগার করতে পারবো না। আমি কাজের জন্য যে কোনো দেশে যেতে চাই”।
ঢাকা ত্যাগ করার আগে তাকে এক দালাল প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো মালয়েশিয়ায় সে প্লানটেশন কাজে মাসে ৬৪০ ডলার করে পাবে। বাংলাদেশে পরিচ্ছন্ন কর্মি হিসেবে সে মাসে ৬৪ ডলার মাত্র পেতো।
বাংলাদেশি অনেক অভিবাসী বলছে যে, দালালরা তাদেরকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে বিদেশে কাজ পাইয়ে দেয়ার কথা বলেছে।
আব্দুল মতিন (৪২) বিয়ের আগে ৮ বছর ধরে সৌদি আরবে এবং দুবাইতে ৩ বছর কাজ করেছে। এখন সে মালয়েশিয়ায় যাবার ভাগ্য খুজেছে। সে তার ৩ সন্তান ও স্ত্রীকে সিলেটে রেখে এসেছে।
নৌকায় পাচারকারীরা তার পিঠে প্রচন্ড মারধর করেছে জানায় এবং বলে, “দালালরা আমার সব টাকা নিয়ে নিয়েছে। তারা আমার সাথে প্রতাড়ণা করেছে। আমি এখন আমার স্ত্রী ও সন্তানদের কাছে ফিরে যেতে চাই। অবৈধভাবে বিদেশ যাবার শিক্ষা আমার হয়ে গেছে”।
দালালরা তাকে বলেছিলো, ৪ দিনের মধ্যে মালয়শিয়া পৌছাবে। কিন্তু, ২ মাস ধরে সাগরে ভাসার পর অবশেষে আচেহ’তে এসে পৌছেছে।
অস্ত্রের মুখে বাড়িতে ফোন করাতো
বেশ কিছু অভিবাসী স্বেচ্ছায় এই যাত্রায় শামিল হয় নি। তাদেরকে অপহরণ করা হয়েছে অথবা মুক্তি পণের টাকা আদায় করা হয়েছে।
মুহাম্মদ মালিক(৪৫) বাংলাদেশের কৃষক। ৩০ বর্গ মিটার জমিতে ধান চাষ করে পরিবারের খোরাক যোগাতো। ফেব্রুয়ারিতে একলোক তাকে বলে বাংলাদেশে টাকা কামাই করা খুব কঠিন। বলে আমার এক বন্ধু আছে সে মালয়েশিয়ায় লোক নিতে পারে।
আরো টাকা রোজগারের স্বপ্ন তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। ১৫ বছর আগে যখন সে বিয়ে করেনি,তখন মালয়েশিয়ায় নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে ৮ বছর কাজ করে গেছে।
মালিককে উপকুলের কাছে একটি গুদাম ঘরে নেয়া হয়। সেখানে সে আরো ১৪ জন অভিবাসীকে দেখতে পায়। তাদেরকে জোর করে ছোট নৌকায় তোলা হয়।এরপর ২ ঘন্টা পর সাগরে বড় নৌকায় তুলে দেয়।
ইন্দোনেশিয়ার উপকূলে ভেরানোর ১ সপ্তাহ আগে নৌকার ক্যাপ্টেন তার দিকে বন্দুক তাক করে ফোনে তার স্ত্রী রুনা বেগমকে ৩,০০০ ডলার একটা একাউন্টে ট্রান্সফার করতে বলায়।
মালিক জানায়, “ আমি কান্নাকাটি করে ফোনে বৌকে বলি, আমাকে যদি ভালোবাসো, আমাকে যদি আর দেখতে চাও তাহলে জলদি গরু ২ টা বেচে দাও, আর টাকা না কুলালে আত্নীয়দের কাছে ধার করে টাকা জোগাড় করো”।
২দিন পর তার স্ত্রীর ভাই পাচারকারীদের দেয়া একাউন্ট নাম্বারে টাকা ট্রান্সফার করে দেয়।
আচেহ’র মাঝিরা উদ্ধার করার পর ১৫ মে আবসারুদ্দিন(১৪) আচেহ’র কুয়ালা লাংসাতে আশ্রয় পায়।
সে টেকনাফের একটা মাদ্রাসায় পড়তো। তাকে অপহরণ করা হয়, যখন সে ও তার ৩ বন্ধু মিলে খেলছিলো।তাদেরকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়, যদি চিৎকার করে।
“তারা আমাদেরকে দড়ি দিয়ে বাধে, মারধর করে।তারপর তারা একটা নৌকায় তোলে। মাঝ সমুদ্রে একটা বড় নৌকায় তুলে দেয়। সেখানে দেখি শত শত মানুষ, রোহিঙ্গা আর বাংলাদেশি”, আবসারুদ্দিন আচেহ’র শেল্টারে বসে কথাগুলো বলছিলো।
আবসার আরো জানায়, তার দুই বন্ধু বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গাদের মধ্যে খাবার নিয়ে মারামারির সময় চোট পেয়ে মারা গেছে। তাদের মরদেহ পানিতে ফেলে দেয়া হয়। অনেক লোক ওই দাঙ্গায় মারা গেছে।
আবসারুদ্দিন দেশে ফিরতে চায় বাবা-মার কাছে এবং আবার স্কুলে ফিরতে চায়।
“ আমার মাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে, এখনো তার সাথে আমার কথা হয় নাই” সে জানায় বেনারকে।