মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব, ৬ মানবপাচারকারীকে গ্রেপ্তার
2015.06.05
‘বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক দুরবস্থার কারণে মানুষ অবৈধভাবে দেশান্তরিত হতে বাধ্য হচ্ছে’—কূটনৈতিক ব্রিফিংয়ে রাখাইন রাজ্যের এক মন্ত্রীর এই বক্তব্যের জের ধরে শুক্রবার বিকেলে ঢাকায় দেশটির রাষ্ট্রদূতকে তলব করা হয়েছে।
মিয়ানমারের রাজধানী নে পি দোতে কর্তব্যরত কূটনৈতিকদের জন্য আয়োজিত ওই ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সুফিউর রহমান উপস্থিত ছিলেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রলায় সূত্র জানায়, মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত মিয়ো মিন্ট থানের সঙ্গে অভিভাসন সঙ্কটসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মিজানুর রহমান। এর পাশাপাশি দেশটির এ ধরনের মন্তব্য অভিবাসন সঙ্কট নিরসনে দুই দেশের সমন্বিত প্রচেষ্টাকে বানচাল করতে পারে বলেও তাঁকে জানানো হয়েছে।
ররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, মিয়ানামারের জলসীমায় আটকে পড়াদের মধ্যে বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনতে সম্মত হয়েছে বাংলাদেশ।
আগামী ৮ জুন প্রায় ১৫০ জন বাংলাদেশিকে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু হবে।
এরই মধ্যে এ ধরনের মন্তব্যকে ‘মর্যাদাহানিকর’ এবং অপ্রতিবেশীসূলভ মনোভাব হিসেবে দেখছে ঢাকা।
পররাষ্ট্র মন্ত্রলায় এ বিষয়ে কোনো বিবৃতি বা বক্তব্য দেয়নি। তবে একাধিক কর্মকর্তা তলবের বিষয়টি শিকার করেছেন।
মানবাপাচার ইস্যুকে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে বাংলাদেশ। গতকাল শুক্রবারও ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার থেকে মোট ছয়জন মানবপাচারকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানবপাচারকারি ও পাচারের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন।
অভিযোগ রয়েছে, মানবপাচার ইস্যুতে মিয়ানমার ঢিমেতালে গতিতে এগোতে চায়। গত ৩০ মে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে মানব পাচার ও অভিবাসী ইস্যুতে সম্ভাব্য সমাধান খোঁজার লক্ষ্যে আঞ্চলিক সম্মেলনে দেশটির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। ওই সম্মেলনে শুরুতেই পাল্টা আঘাত করে মিয়ানমার।
সবাই যখন এশিয়ার অভিবাসন সমস্যার জন্য মিয়ানমারের দিকে আঙুল তুলছিল, তখন মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রধান হিটিন লিন বলেন, তার দেশ মানবপাচার রোধে সবার সঙ্গে কাজ করবে। তবে এজন্য শুধুমাত্র মায়ানমারকে দোষ দেয়া যাবে না।
মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নিজেদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি না দেওয়ায় শরণার্থী সমস্যা দুদেশের সম্পর্কের ‘কাঁটা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মাতৃভূমি রাখাইনে জাতিগত সহিংসতার পর পালিয়ে আসা হাজার হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। নৌকায় করে পাড়ি দেওয়া হাজার হাজার বর্মী ও বাংলাদেশিরা ভারত মহাসাগরে আটকে পড়ার পর এই সঙ্কট সমাধানে মিয়ানমারের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে কাজ করছে বাংলাদেশ।
সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের অবৈধভাবে নৌ-পথে থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়া যাওয়ার বিষয়টি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজরে আসে। থাইল্যান্ডের গহীন অরণ্যে শত শত গণকবর পাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘের পক্ষ থেকে অভিবাসন সমস্যা সমাধানে চাপ আসে।
কিন্তু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অভিবাসী সমস্যার দায় নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে মিয়ানমার সরকার। যদিও সেখানে বছরের পর বছর ধরে রোহিঙ্গা মুসলিমরা নির্যাতিত হচ্ছে।
ওই বৈঠকে লিন জানান, রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিষয়ে তার দেশ কোনো দায়-দায়িত্ব নেবে না। এমনকি এ বিষয় তাদের কেউ দোষ দিলে তা তারা স্বীকারও করবে না। সেখানে পুরো এশিয়া অঞ্চলের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করবেন তারা।
ব্যাংকক সম্মেলন ছাড়াও সম্প্রতি নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের রুদ্ধদ্বার বৈঠকে মায়ানমারের মানবাধিকার বিষয়ে আলোচনা হয়।
চার মানবপাচারকারী গ্রেফতার
কক্সবাজারের রামু, উখিয়া ও মহেশখালী এলাকায় অভিযান চালিয়ে চার মানবপাচারকারীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। শুক্রবার ভোর থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত জেলার বিভিন্ন স্থানে পৃথক অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়। তারা হলো- উখিয়ার জালিয়াপালং ইউনিয়নের মাদারবুনিয়া এলাকার শফিকুর রহমানের ছেলে আব্দুল জলিল (৩০), মহেশখালীর কুতুবজোম ইউনয়নের খোন্দকার পাড়ার আলী আকবরের স্ত্রী হোসনে আরা বেগম রেশমী (৩৩) ও রামুর কুতুবপালং গ্রামের মৃত ফজল আহমদের ছেলে মোহাম্মদ মোস্তফা (২৭) ও মোহাম্মদ ইসতিয়াকের ছেলে মোহাম্মদ আলম (৩১)।
উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জহিরুল ইসলাম জানান, শুক্রবার বেলা ১১ টার দিকে উখিয়ার মাদারবুনিয়া এলাকা থেকে আব্দুল জলিল (৩০) নামের এক মানবপাচারকারিকে গ্রেফতার করা হয়। তার বিরুদ্ধে উখিয়া থানায় মানবপাচার আইনে একাধিক মামলা রয়েছে।
মহেশখালি থানার ভারপ্রাপ্ত (ওসি) আলমগীর হোসেন জানান, শুক্রবার সকাল ১০টার দিকে কুতুবজোম ইউনিয়নের খোন্দকার পাড়া থেকে হোসেনে আরা বেগম রেশমী (৩৩) নামে এক নারী মানবপাচারকারীকে আটক করা হয়েছে। ওসি জানান, তার বিরুদ্ধে মানব পাচারে অভিযোগ রয়েছে।
রামুর থানার ভারপ্রাপ্ত (ওসি) মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ জানান, রামুতে মানবপাচারকারি চক্রের দুই সদস্যকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে রামুর জিয়াউর রহমান নামের এক যুবককে অবৈধভাবে সাগরপথে মালয়েশিয়ায় পাচার করে একটি চক্র। জিয়াউর এখনো নিখোঁজ রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে মানবপাচার আইনে নিয়মিত মামলা দায়ের করা হবে।
চট্টগ্রামে মানবপাচারকারী গ্রেপ্তার:
গ্রেপ্তার আব্দুল হক (৩১) চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার টেলিপাড়ার বাসিন্দা।
তিনি ‘পুলিশের তালিকাভুক্ত একজন মানবপাচারকারী’ বলে র্যাব-৭ এর মিডিয়া অফিসার এসএসপি সোহেল মাহমুদ জানান।
শুক্রবার দুপুরে চান্দগাঁও থানার বহদ্দারহাট বাস টার্মিনাল এলাকা থেকে হককে গ্রেপ্তার করেন র্যাব সদস্যরা।
সোহেল মাহমুদ বলেন, “আব্দুল হকের বিরুদ্ধে আনোয়ারা থানায় মানবপাচার আইনে দুটি মামলা আছে। এর একটিতে তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করেছে আদালত। অন্য মামলাটি সিআইডি তদন্ত করছে।”
সাম্প্রতিক সময়ে মানবপাচার ঠেকাতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় আব্দুল হক আত্মগোপনে যান বলে র্যাব কর্মকর্তা জানান।
রাজধানীতে আটক একজন
শুক্রবার দুপুরে মিরপুরের পীরেরবাগের এক বাসা থেকে তানিম ইসলাম চৌধুরী কিরণ (৪০) নামের ওই ব্যক্তিকে আটক করা হয়।
র্যাব–৩ এর অপারেশন অফিসার সাইফুল ইসলাম বলেন, “কিরণ মানবপাচারকারী চক্রের সদস্য। তার কাছ থেকে ১৭টি বাংলাদেশি পাসপোর্ট ও ৯ কোটি টাকার চেক জব্দ করা হয়েছে। এছাড়া কিছু ডাক্তারি কাগজপত্র পাওয়া গেছে যা থেকে মনে হয় সে মেডিকেল চেকআপের নামে লোক পাচার করত।”
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে কিরণ মানবপাচারে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে বলে র্যাব কর্মকর্তা জানান।