টার্গেট দরিদ্ররা, আন্তর্জাতিক মানব পাচারকারী চক্র আটক

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2015.10.05
BD-trafficking র‍্যাবের প্রধান কার্যালয়ে গ্রেপ্তারকৃত ৮ মানব পাচারকারীকে তাদের জাল ভিসার কাগজপত্র সহ দেখা যাচ্ছে। ৫ অক্টোবর,২০১৫
বেনার নিউজ

দেশের দরিদ্র ও নিম্নবিত্তদের টার্গেট করছে মানব পাচারকারীরা। বেশি আয়ের লোভ দেখিয়ে পাচারের ফাঁদে ফেলার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে তারা। তবে পাচারকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গত কয়েক দিনে আন্তর্জাতিক পাচারকারী চক্রের বেশ কিছু সদস্য আটক হয়েছে বলে দাবি করেছে তারা। এসব পাচারকারী চক্রের সঙ্গে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের বিমানবন্দরের কর্মকর্তারাও জড়িত থাকতে পারেন বলে জানিয়েছে র‍্যাব।

সোমবার রাজধানী ঢাকার কমলাপুর ও নয়া পল্টন এলাকায় অভিযান চালিয়ে আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারী চক্রের ৮ সদস্যকে আটক করেছে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব)। এর  দুদিন আগে কক্সবাজারের টেকনাফে মডেল থানা পুলিশের অভিযানে আটক হয়  আবুল হাশেম ওরফে পোয়া মাঝি (৪৬) নামে আরও এক আন্তর্জাতিক শীর্ষ মানব পাচারকারী।

সোমবার আটকৃতরা হলেন- মো. মতিন মিয়া (৪৭), মো. জাহাঙ্গীর আলম বাবু (৪৫), আবুল হোসেন (৮১), নুরুল ইসলাম (৩০), রেজাউল করিম সোহেল (৩১), মো. তৈয়ব আলী (৪৮), বেল্লাল হোসেন (৩৬) এবং আবুল হোসেন (৩৬)।

রোববার সন্ধ্যা থেকে সোমবার ভোর পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করা হয় বলে বেনারকে জানান র‍্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের উপ-পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান এ তথ্য জানান।


পাসপোর্ট ও জাল ভিসা উদ্ধার

আটকৃতদের নিকট থেকে ৬৩৫টি পাসপোর্ট, ১৮টি দেশের দুই হাজার ২৬৫টি জাল ভিসা, ৯২৯টি জাল ভিসার স্টিকার বা হলোগ্রাম, ৫১টি লিবিয়ার ভিসা হলোগ্রাম, ৪১১টি বাংলাদেশি পাসপোর্টের ভিসার পাতা, ১২টি ভিসা এনডোর্সমেন্ট, ৮৭টি এনডোর্সমেন্ট ব্লাঙ্ক, ৪টি নেপালের ট্যুরিস্ট জাল ভিসা, ৫২টি বিভিন্ন দেশের ভিসার টেস্ট পেপার, ২৫ বান্ডেল ভিসা তৈরির পেপার, ২ পাতা মোজাম্বিকের ভিসার হলোগ্রাম, লেমেনেটিং মেশিন, ল্যাপটপ, স্ক্যানার, সিপিইউ, প্রিন্টারসহ ভিসা তৈরির বিভিন্ন সরঞ্জাম জব্দ করা হয়। এছাড়া নগদ এক লাখ ২৮ হাজার টাকা ও একটি লাল রঙের প্রাইভেটকারও (চট্র মেট্রো-ঘ-১১-১৮৮০) উদ্ধার করে র‍্যাব।

আটক এই ৮ জন পাচারকারীকে সোমবার র‍্যাব সদর দফতরে সংবাদ সম্মেলনে হাজির করা হয়। সেখানে জানানো হয়, রাজধানীর মতিঝিল এলাকায় উত্তর কমলাপুর ইনসাফ হোটেলের একটি কক্ষে দু’জন আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারী চক্রের সদস্য অবস্থান করছেন এমন গোপন সংবাদের ভিত্তিতে রোববার সন্ধ্যায় সেখানে অভিযান চালানো হয়।

এসময় বিভিন্ন দেশের ৫১টি জাল ভিসাসহ আটক হয় এ চক্রের সক্রিয় সদস্য মো. মতিন মিয়া (৪৭) ও মো. জাহাঙ্গীর আলম বাবু (৪৫)। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা পল্টনে অবস্থানকারী মানবপাচারকারী চক্রের আরেক সদস্য মো. আবুল হোসেনের কাছ থেকে সেসব জাল ভিসা সংগ্রহ করার কথা জানায়।

সে তথ্যানুযায়ী, আবুল হোসেনসহ তার সহযোগী মো. নূর ইসলামকে ৩০টি লিবিয়ার জাল ভিসাসহ আটক করা হয়। দ্বিতীয় দফায় আটকৃতরা জাল ভিসা তৈরি ও আন্তর্জাতিক মানবপাচারের সঙ্গে রেজাউল করিম সোহেল ও তৈয়ব আলী জড়িত বলে স্বীকারোক্তি দেয়।

এছাড়া সোহেলের বাড়ি ও অফিসে জাল ভিসা তৈরির বিপুল পরিমাণ সরঞ্জাম রয়েছে বলেও জানায় তারা। এ তথ্যের ভিত্তিতে ‘ল্যাবিব এয়ার ইন্টারন্যাশনাল’ অফিসে অভিযান চালিয়ে মো. বেল্লাল হোসেন, মো. আবুল হোসেনকে বিভিন্ন ব্যক্তির ৫৯৫টি পাসপোর্টসহ গ্রেফতার করে র‍্যাব।


টার্গেট নিম্নবিত্ত ও দরিদ্ররা

মুফতি মাহমুদ খান বেনারকে বলেন, “দেশের প্রান্তিক এলাকা থেকে গরিব লোকজনই তাদের মূল টার্গেট। দালালের মাধ্যমে বিভিন্ন কৌশলে প্রভাবিত করে প্রবাসে উন্নত জীবন-যাপনের আশ্বাস দিয়ে তাদের পাসপোর্ট সংগ্রহ করে জাল ভিসা সরবরাহ করে এই চক্র। এরপর মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে তাদের অবৈধপথে বিদেশে পাঠায়”।

সংবাদ সম্মেলনে মুফতি মাহমুদ খান বলেন, দীর্ঘদিন ধরে জাল ভিসা তৈরি করে অবৈধভাবে বিভিন্ন দেশে মানুষ পাচার করে আসছে এ আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারী চক্রটি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও  লিবিয়ায় লোক পাঠিয়ে থাকে। কেউ কেউ আবার স্থলপথে ভারত ও নেপাল হয়ে মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও লোক পাঠায়।

আর এ কাজে বিমানবন্দরের কিছু অসাধু কর্মকর্তা জড়িত রয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।


ভিন্ন পরিচয়ের আড়ালে পাচারকারী

সংবাদ সম্মেলনে র‍্যাব জানায়, পাচারকারীরা ভিন্ন ভিন্ন পরিচয়ের আড়ালে মানুষ পাচার করে থাকে। যেমন আটক আসামি সোহেল পেশায় মূলত পল্টনের ‘পায়েল কম্পিউটার অ্যান্ড গ্রাফিক্স’র দোকানের ডিজাইনার। তিনি কৌশলে বিভিন্ন দেশের আসল ভিসা সংগ্রহ করে মালয়েশিয়া, লিবিয়া, ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়াসহ বিভিন্ন দেশের ভিসা জাল করে দালালের মাধ্যমে বিক্রি করতেন।

তার বরাত দিয়ে র‍্যাবের এ কর্মকর্তা জানান, একটি জাল ভিসা তৈরিতে এক থেকে দেড় হাজার টাকা খরচ পড়ে। দালালরা সেটা ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করত।

একই অভিযোগে সোহেলকে ২০১০ সালে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ গ্রেফতার করে। এরপর জামিনে বের হয়ে সে আবার একই কাজে লিপ্ত হয় বলে জানায় র‍্যাব।


সাগর পথের শীর্ষ পাচারকারীদের একজন

টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ আতাউর রহমান খোন্দকার জানান, শনিবার অভিযান চালিয়ে আবুল হাশেম ওরফে পোয়া মাঝিকে আটক করা হয়। তিনি সাগর পথে মানব পাচারকারীদের শীর্ষ একজন। তার বিরুদ্ধে টেকনাফ থানাসহ বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে।

প্রশাসনের হাত থেকে রক্ষা পেতে শাহপরীর দ্বীপ এলাকা ছেড়ে সাবরাং প্যান্ডল পাড়ায় নতুন বাড়ি নির্মাণ করছিলেন। দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থাকার পর অবশেষে সে বাড়ি থেকে পুলিশের হাতে আটক হয়েছেন। তবে তার অপর সহযোগী  ফিরোজ, কালাম্মা, হামিদসহ অনেকেই এখনো ধরাছোয়ার বাইরে রয়ে গেছে।


অভিযান অব্যাহত রাখার আহবান

মানব পাচার রোধে আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর এ অভিযান অব্যাহত রাখার আহবান জানিয়েছে অভিবাসন সংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে বাংলাদেশে বেসরকারিভাবে বিদেশে জনশক্তি পাঠানোর এজেন্সিগুলোর সংগঠন বায়রার সিনিয়র সহ সভাপতি আলী হায়দার চৌধুরি বেনারকে বলেন, “আমরা যারা বৈধভাবে জনশক্তি রফতানি করি, তারা আন্তরিকভাবেই চাই দেশে একজন মানুষও পাচারের শিকার না হোন। পাচারকারীদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অব্যাহত অভিযান খানিকটা স্বস্তির খবর দেয়। তাদের বিরুদ্ধে এ তৎপরতা অব্যাহত না থাকলে তারা কিছুদিন আত্মগোপনে থেকে আবারও পাচার কাজ শুরু করবে। বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখতে মানব পাচার বন্ধ করতে হবে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।