ইউপি নির্বাচনে নৌকা-ধানের শীষের ভোটের লড়াই
2016.02.12
পৌরসভার পর এবার তৃণমূলের সবচেয়ে বড় নির্বাচন, ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি। শুক্রবার দলটির পক্ষ থেকে এ ঘোষণা এসেছে। প্রথমবারের মত দলীয় প্রতিকে ইউপি নির্বাচন অনুষ্ঠানের ফলে এবার মাঠপর্যায়েও পাওয়া যাবে জাতীয় নির্বাচনের আমেজ। জমে এবার উঠবে নৌকা-ধানের শীষের ভোটের লড়াই।
বিএনপির নির্বাচনে অংশ নেওয়াকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা। তবে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে পূর্ববর্তি নির্বাচনগুলোতে সুষ্ঠু নির্বাচনি পরিবেশ তৈরি করতে না পারা, সকল দলের প্রার্থীকে সমান সুযোগ না দেওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগ থাকলেও সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন এবার অন্তত সেই দূর্বলতা কাটিয়ে উঠবে সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠানটি।
২২ মার্চ নির্বাচন শুরু
আগামী ২২ মার্চ বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে সারা দেশে ইউপি নির্বাচন শুরু হচ্ছে বলে ঘোষণা দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। ২০১৬ সালের ৪ জুন পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে মোট ছয় ধাপে ৪ হাজার ২৭৫টি ইউনিয়ন পরিষদে ভোট গ্রহণ করা হবে। প্রথম ধাপের ভোট গ্রহণ হবে ২২ মার্চ । এ ধাপে মোট ৭৫২টি ইউপিতে ভোট গ্রহণ করা হবে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন বৃহস্পতিবার এই ছয়টি ধাপের ভোটের তারিখ চূড়ান্ত করে স্থানীয় রিটার্নিং কর্মকর্তাদের বিস্তারিত তফসিল ঘোষণার দায়িত্ব দিয়েছে।
নির্বাচনি তফসিল অনুযায়ী, আগামী ২২ ফেব্রুয়ারি প্রথম ধাপের ৭৫২টি ইউপিতে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ সময়। জমা দেওয়া মনোনয়নপত্র বাছাই করা হবে ২৩ ও ২৪ ফেব্রুয়ারি। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ সময় ২ মার্চ এবং প্রতীক বরাদ্দ হবে ৩ মার্চ।
দ্বিতীয় ধাপে মোট ৭১০টি ইউনিয়ন পরিষদে ভোট গ্রহণ করা হবে আগামী ৩১ মার্চ। এসব ইউপিতে প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন ২ মার্চ।
তৃতীয় ধাপে আগামী ২৩ এপ্রিল ৭১১টি ইউপিতে ভোট গ্রহণ করা হবে। এসব ইউপিতে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ সময় ২৭ মার্চ। আগামী ৭ মে চতুর্থ ধাপে ভোট গ্রহণ করা হবে ৭২৮টি ইউপিতে। এসব ইউনিয়ন পরিষদে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ সময় ৭ এপ্রিল। পঞ্চম ধাপে ২৮ মে ৭১৪টি ইউপিতে ভোট গ্রহণ করা হবে। এসব ইউপিতে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ সময় ২ মে। আর সবশেষে ষষ্ঠ ধাপে ৬৬০টি ইউপিতে ভোট গ্রহণ করা হবে ৪ জুন। এসব ইউনিয়ন পরিষদে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ সময় ৯ মে।
কেন বিএনপি নির্বাচনে যাচ্ছে
রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ইউপি নির্বাচনে বিএনপির যোগদানের ঘোষণা দেন।
বর্তমান নির্বাচন কমিশনের (ইসি) অধীন আগে কয়েকটি নির্বাচনে অংশ নেওয়া দলটির নানা আপত্তি রয়েছে ইসির বিরুদ্ধে। তারপরেও একই ইসির নেতৃত্বে ইউপি নির্বাচনে যোগ দেওয়ার কারণ ব্যাখ্যায় রিজভী বলেন, ‘ভয়াবহ দমন-পীড়ন ও ভোটারদের ভোট দেওয়ার অধিকার কেড়ে নেওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও সেই ক্ষুদ্র পরিসর সম্প্রসারিত করার আন্দোলন হিসেবে বিএনপি আসন্ন ইউপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে।
এদিকে আগামী ১৯ মার্চ বিএনপির ষষ্ঠ কাউন্সিলের তারিখ নির্ধারন হয়েছে। রিজভী অভিযোগ করেন, কাউন্সিল বাধাগ্রস্ত করতেই এর একদিন আগে পৌরসভা ও দু’দিন পর ইউপি নির্বাচনের তারিখ স্থির করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘একটি বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত করা এক ব্যাপক কর্মযজ্ঞের বিষয়। নির্বাচন পরিচালনাও এক ব্যাপক কর্মকাণ্ড। উভয় বিষয়ে দলের নেতাকর্মীরা ব্যাপকভাবে ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু ২০ মার্চ ১০ পৌরসভায় ও ২২ মার্চ ৭৫২ ইউপি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বিএনপির কাউন্সিলের পরপরই হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত এই নির্বাচনের তারিখ চূড়ান্ত করা হয়েছে। বিএনপির জাতীয় কাউন্সিলকে জনমনে বিভ্রান্ত করার জন্যই অশুভ উদ্দেশ্য নিয়েই নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণা করেছে।’
এ প্রসঙ্গে রুহুল কবীর রিজভী বলেন, ‘সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, বিশ্বাসযোগ্য ইনক্লুসিভ নির্বাচন চিরায়ত গণতন্ত্রের অঙ্গ। যদিও এখন এদেশে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নির্বাসনে, ভোটারদের ভোটধিকার নিরুদ্দেশ, তথাপিও গণতন্ত্রের এ দুঃসময়ে সরকারের নানামুখী জুলুম, ভোট জালিয়াতির সম্ভাবনার মধ্যেও এই ইউপি নির্বাচনে অংশ নিয়ে গণতন্ত্রের সংকুচিত পরিসরকে সম্প্রসারিত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে।’
তৃণমূল নেতাদের প্রাধান্য
মাঠ পর্যায়ের এই নির্বাচনে নিজ দলের তৃণমূলের নেতাদের প্রাধান্য দিচ্ছে চায় প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো। ইতিমধ্যে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদের জন্য দলীয় প্রার্থীর নাম পাঠাতে বলেছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি।
ইউপি চেয়ারম্যান পদে প্রার্থীতার জন্য আওয়ামী লীগের প্রার্থী বাছাই করবেন দলটির জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়নের নেতারা। আর বিএনপি তার উপজেলা ও ইউনিয়নের নেতাদের এসব প্রার্থী বাছাইয়ের দায়িত্ব দিয়েছে।
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দলটির দপ্তর সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে শুক্রবার জানানো হয়েছে, ১৫ ফেব্রুয়ারি সোমবারের মধ্যে জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকদের সমন্বয়ে গঠিত নির্বাচনী বোর্ডকে প্রার্থীর নাম চূড়ান্ত করে দলীয় সভানেত্রীর ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে পাঠাতে হবে।
ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, মনোনীত প্রার্থীর নাম (ভোটার নম্বর ১২ ডিজিট) এবং নির্বাচনী আইন, নীতিমালা ও বিধিমালা অনুযায়ী সব তথ্য প্রার্থীর নামের সঙ্গে পাঠাতে হবে। প্রার্থীর ভোটার আইডির ফটোকপি অবশ্যই পাঠাতে হবে, যা বাধ্যতামূলক। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মনোনয়নের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) মনোনয়ন বোর্ড চেয়ারম্যান প্রার্থীর নাম ও প্রতীক বরাদ্দ করবে।
এদিকে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী জানিয়েছেন, চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনের জন্য প্রত্যেক ইউনিয়ন পরিষদ থেকে একজন করে প্রার্থীর নাম সুপারিশ করে কেন্দ্রে পাঠাতে হবে। সংশ্লিষ্ট উপজেলার বিএনপির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদক এই পাঁচজন চেয়ারম্যান প্রার্থীর নাম অনুমোদন করে কেন্দ্রে পাঠাবেন। তবে আওয়ামী লীগের মত নাম পাঠানোর জন্য নির্দিষ্ট তারিখ জানায়নি বিএনপি।
‘রাজনৈতিক সংঘাত ছড়াবে’
এদিকে বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে দলীয় প্রতিকে নিরবাচনকে ভালভাবে দেখছেনা বিএনপি। দলীয় প্রতিকের যেকোন স্থানীয় সরকার নির্বাচন তৃণমুলে সামাজিক বন্ধন বিনষ্ট করবে দাবি করে রিজভী বলেন, ‘বিএনপি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে দলীয় প্রতীকে ইউনিয়ন পরিষদসহ পরিবার, গ্রাম, পাড়া-মহল্লায় সর্বত্র দলীয় রাজনীতির সংঘাত ছড়িয়ে পড়বে। গণতন্ত্রের পথ চলাকে বিপথে চালিত করার জন্যই সরকারের মদদে নির্বাচন কমিশন এই অযৌক্তিক ও অসময়োচিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।’
‘নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ’
এদিকে ইউপি নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণকে ইতিবাচক বললেও বর্তমান নির্বাচন কমিশনের নিরপক্ষেতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশ্লেষকরা। এমনকি প্রতিষ্ঠানটির সক্ষমতা নিয়েও সন্দিহান তারা।
এ বিষয়ে সু-শাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)'র সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বেনারকে বলেন, ‘ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ নির্বাচনকে প্রতিযোগিতামূলক করবে। আর প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনই তো হওয়া দরকার। অন্যথায় একতরফা নির্বাচন ভালো হলেও এর মাধ্যমে নির্বাচনের যথার্থতা (লেজিটিমেসি) নিশ্চিত হয়না। সুতরাং বিএনপির নির্বাচনে অংশ নেওয়াটা ইতিবাচক।
তবে বর্তমান নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে এই নির্বাচন কমিশনের পক্ষে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করা নিয়ে আশাবাদি হওয়া দূরহ ব্যাপার। এই নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা ও সক্ষমতা উভয়ই প্রশ্নবিদ্ধ। তবে আশা করব সাংবিধানিক সংস্থাটি নিজেদের দূর্বলতা কাটিয়ে একটি সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও গ্রণযোগ্য নির্বাচন জাতিকে উপহার দেবে।’