পৌর নির্বাচনে উৎসবের আমেজ ও উৎকন্ঠা, জঙ্গি হামলার শঙ্কা
2015.12.29
স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ইতিহাসে এই প্রথম দলীয় প্রতীকে পৌরসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যা সারা দেশে রাজনৈতিক উত্তাপ ছড়িয়ে দিয়েছে। এই নির্বাচন ঘিরে একদিকে আছে উৎসবের আমেজ, অন্যদিকে আছে উদ্বেগ–উৎকন্ঠা।
এরই মধ্যে গোয়েন্দা প্রতিবেদন বলছে, রাজশাহী ও রংপুরের পৌরসভাগুলোতে জঙ্গি হামলার আশঙ্কা রয়েছে। গত পাঁচ মাসে ওই দুটি জেলায় জঙ্গি হামলার বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে।
আজ বুধবার সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত একটানা দেশের ২৩৪টি পৌরসভায় এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও ভোটারদের শঙ্কা রয়েছে।
সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল বিএনপি—উভয়ই প্রায় সব পৌরসভায় বিজয়ী হওয়ার আশা প্রকাশ করেছে। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে ২০০ থেকে ২২০টি পৌরসভায় জেতার কথা বলছে। যদিও পুলিশের গোপন জরিপ বলছে, আওয়ামী লীগ ১২৮ এবং বিএনপি ৪৯টিতে জিততে পারে।
বিএনপি সুনির্দিষ্ট সংখ্যা না বললেও দলটির পক্ষ থেকে দুই ধরনের বক্তব্য আছে। একটি হচ্ছে, নির্বাচন সুষ্ঠু হলে ৮০ শতাংশ পৌরসভায় দলটির মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা বিজয়ী হবে। অপর বক্তব্য হচ্ছে, নির্বাচন যদি অর্ধেক সুষ্ঠু হয়, তাহলে দলটি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে।
গত সোমবার মধ্যরাতের পর নির্বাচনী সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ হয়েছে। কিন্তু মঙ্গলবারও দেশের বিভিন্ন স্থানে বিরোধী পক্ষের ওপর বিক্ষিপ্ত হামলা হয়েছে।
বিএনপি অভিযোগ করেছে, গ্রেপ্তার এড়াতে বিএনপি কর্মী-সমর্থকের কয়েকজন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। ভয়ভীতি দেখিয়ে প্রার্থীকে এলাকা ছাড়া করা হয়েছে অথবা ঘর থেকে বের হতে দেওয়া হচ্ছে না।
“একেক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একেক কৌশল অবলম্বন করে। এবার আশঙ্কা করছি, নির্বাচন শুরুর আগেই ব্যালট বাক্স ভরে রাখা হতে পারে,” বেনারকে জানান বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী।
তিনি বলেন, ২৩৪টির মধ্যে প্রায় ২০০ পৌরসভায় বিএনপি–সমর্থক প্রার্থী ও দলের নেতা-কর্মীদের মারধর করা ও ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে।
তবে সরকার ও নির্বাচন কমিশন বলছে, পরিস্থিতি এখন পর্যন্ত সহনশীল। বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ হলেও নির্বাচনী প্রচার শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত সহিংসতায় একজনের মৃত্যু হয়েছে।
“নির্বাচন সুষ্ঠু ও উৎসবমুখর হবে। কমিশন ইতিমধ্যে সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে,” গতকাল রাতে বেনারকে জানান প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিব উদ্দীন আহমদ।
নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৪০টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ২০টি দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। এসব দলের মেয়র পদের প্রার্থী সংখ্যা ৬৬০ জন। বাকি ২৮৫ জন স্বতন্ত্র হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
২৩৪টি পৌরসভায় মেয়র পদে আওয়ামী লীগ সবকটিতে, বিএনপি ২২৩টি, জাতীয় পার্টি ৭৪টি, জাসদ ২১টি, ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ ৫৭টি এবং ওয়ার্কার্স পার্টি ৮টি পৌরসভায় প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছে। বাকিরা অন্যান্য দলের।
নির্বাচন কেমন হবে-এই প্রশ্নে আওয়ামী লীগ বলছে, নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হবে। বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচনে ভোট কারচুপির আশঙ্কা প্রকাশ করলেও নির্বাচনের মাঠে থাকার ঘোষণা দিয়েছে।
“দলের নেতা-কর্মীদের সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন করতে এবং নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করতে বলা হয়েছে, বেনারকে জানান দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
তিনি আরও বলেন, নির্বাচনে হেরে গেলেও সরকারের ওপর আকাশ ভেঙে পড়বে না, সরকারের পতনও হবে না।
নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, পাঁচ বছর আগে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছিল। নির্বাচন সুষ্ঠু করতে তখন সেনা মোতায়েন করা হয়েছিল। এবার বিএনপি সেনা মোতায়েনের দাবি করলেও এর কোনো প্রয়োজন নেই বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
তবে গত সপ্তাহ দু-এক ধরে আধিপত্য বিস্তার ও সহিংসতার ঘটনাগুলো যেভাবে ঘটছে, তাতে নির্বাচন কতটা শান্তিপূর্ণ হবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে নানা মহলে।
“নির্বাচন-পূর্ব ব্যাপক সহিংসতা ও আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনায় নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হওয়া নিয়ে নাগরিকদের মধ্যে একধরনের সংশয় তৈরি হয়েছে,” বেনারকে জানান সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার।
নির্বাচনের কেন্দ্র ও কর্মকর্তা
২৩৪টি পৌরসভায় মোট ভোটকেন্দ্র ৩ হাজার ৫৫৫টি ও ভোটকক্ষ ২১ হাজার ৭১টি। পৌরসভাগুলোতে সাধারণ ওয়ার্ড ২ হাজার ১৯৩টি এবং নারীদের জন্য সংরক্ষিত ওয়ার্ড ৭৩১টি।
প্রিসাইডিং, সহকারী প্রিসাইডিং ও পোলিং কর্মকর্তা মিলিয়ে এবারের নির্বাচন মোট ৬৬ হাজার ৭৬৮ জন কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করবেন।
নির্বাচনে মেয়রের পদ ৯৪৩, সাধারণ কাউন্সিলরের ২ হাজার ১৯৩টি পদের জন্য ৮ হাজার ৭৪৬ জন এবং সংরক্ষিত কাউন্সিলরের ৭৩১টি পদের জন্য ২ হাজার ৪৮০ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
কোথায়, কত ভোট
এবার ২৩৪টি পৌরসভায় মোট ভোটার ৭০ লাখ ৯৯ হাজার ১৪৪। এর মধ্যে পুরুষ ৩৫ লাখ ৫২ হাজার ২৮৪ এবং ৩৫ লাখ ৪৬ হাজার ৮৬০ জন। সর্বাধিক ২ লাখ ১৬ হাজার ৪৫১ জন ভোটার বগুড়া পৌরসভায়।
এ ছাড়া ১ লাখের বেশি ভোটার আছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সাভার, দিনাজপুর, যশোর, কুষ্টিয়া, নওগাঁও, পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও টাঙ্গাইল পৌরসভায়। সবচেয়ে কম ৬ হাজার ১৫৯ ভোটার রয়েছে শরিয়তপুরের ভেদরগঞ্জে।
এ ছাড়া ১০ হাজারের কম ভোটার রয়েছে বরগুনার বেতাগীতে ৭ হাজার ৭১১, বগুড়ার ধুনটে ৯ হাজার ৯২৮ ও কাহালুতে ৯ হাজার ৮২৮, চট্টগ্রামের বারইয়ারহাটে ৭ হাজার ৫১২, ফরিদপুরের নগরকান্দায় ৭ হাজার ৫৩৬, যশোরের বাঘারপাড়া ৬ হাজার ২৮৩, নাটোরের নলডাঙ্গা ৭ হাজার ৬২৩ ও পটুয়াখালীর কুয়াকাটা ৬ হাজার ৮৪১।
পুলিশ–আনসার ছাড়াও বিজিবি মোতায়েন
পৌরসভা নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের জন্য ২২৯টি পৌরসভায় বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। এর বাইরে মুলাদি, মেহেন্দীগঞ্জ, পাথরঘাটা, রামগতি ও হাতিয়া পৌরসভার প্রতিটিতে এক প্লাটুন করে কোস্ট গার্ড দায়িত্ব পালন করবে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী পৌরসভায় ভোটার সংখ্যা যেখানে এক লাখের বেশি সেখানে দুই প্লাটুন বিজিবি, ভোটার সংখ্যা যেখানে এক লাখের কম বা ৫০ হাজারের বেশি সেখানে এক প্লাটুনের বেশি, ভোটার সংখ্যা যেখানে ৫০ হাজারের কম বা ১০ হাজারের বেশি সেখানে এক প্লাটুন এবং ভোটার সংখ্যা যেখানে ১০ হাজারের কম সেখানে এক প্লাটুনের কম বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের খসড়া পরিপত্রে বলা হয়েছে, প্রতিটি কেন্দ্রে ৫ জন অস্ত্রধারী পুলিশ, ২ জন আনসার (অস্ত্রসহ) এবং আনসার ও ভিডিপির ১২ সদস্য মিলিয়ে মোট ১৯ সদস্যের বাহিনী আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালন করবে। তবে ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে অতিরিক্ত একজন অস্ত্রধারী পুলিশসহ ২০ জন দায়িত্ব পালন করবেন।
পরিপত্রে আরও বলা হয়েছে, প্রতিটি পৌরসভায় পুলিশ, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন ও ব্যাটালিয়ন আনসারের সমন্বয়ে গঠিত একটি করে ভ্রাম্যমাণ ও অপেক্ষমাণ দল দায়িত্ব পালন করবে। র্যাবের একটি করে দল ভ্রাম্যমাণ এবং ৮১টি দল অপেক্ষমাণ বাহিনী হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে।
সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা
দেশের বিভিন্ন স্থানে বিরোধী দলের প্রার্থীরা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তাদের আশঙ্কা ভোট গ্রহণ শুরুর আগেই ব্যালটে সিল মেরে বাক্স ভর্তি করে রাখা হবে।
নাটোর ও জেলার সিংড়ায় বিএনপির প্রার্থীরা সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, তাঁদের এজেন্টদের কেন্দ্রে না যাওয়ার হুমকি দেওয়া হয়েছে।
বিএনপি প্রার্থীদের ওপর যেমন হামলা হয়েছে, তেমনি কিছু জায়গায় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের ওপর হামলা হয়েছে।
কুয়াকাটায় বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সংঘর্ষে ৫ জন আহত হয়েছেন। গতকাল সীতাকুণ্ডে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী সফিউল আলম ভয়ে এলাকা ছেড়েছেন।
পাবনার ভাঙ্গুরায় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী আজাদ খান অভিযোগ করেছেন, তার বাড়ির আশপাশে বহিরাগতরা পাহারা দিচ্ছে।গতকাল মিরকাদিমে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর ক্যাম্প জালিয়ে দেওয়া হয়েছে।
“যেহেতু নৌকা ও ধানের শীষের নির্বাচন, সেহেতু টুকটাক সমস্যা হতে পারে। এগুলো যাতে না হয়, সে জন্য নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সবাই যার যার মতো দায়িত্ব পালন করবে বলে আশা করছি,” জানান ওবায়দুল কাদের।