পৌর নির্বাচনে সরকারি দলের একচেটিয়া বিজয়
2015.12.30
দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত পৌরসভা নির্বাচনে নৌকা ও ধানের শীষের মধ্যে সেই অর্থে প্রতিযোগিতা হয়নি। গতকাল বুধবার অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনে সরকারি দল আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ জয় পেয়েছে, বিরোধী দল বিএনপি শোচনীয়ভাবে হেরেছে।
এই প্রথম দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত পৌর নির্বাচনে বিজয়ী ও পরাজিত প্রার্থীদের মধ্যে ভোটের অস্বাভাবিক ব্যবধান লক্ষ্য করা গেছে।
বিএনপি বলেছে, এটি প্রহসনের নির্বাচন। দলটির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, প্রশাসনের ছত্র ছায়ায়, পুলিশ ও যৌথ বাহিনীর পাহারায় সরকার দলীয় নেতা-কর্মীরা কেন্দ্র দখল ও ভোট কারচুপির উৎসবে নেমেছিল।
“আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বদলে যায়নি। মারপিটের সংস্কৃতি রয়ে গেছে,” নির্বাচনের পর সাংবাদিকদের বলেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিব উদ্দিন আহমদ।
তবে তিনি আশা প্রকাশ করেন, ভবিষ্যতে এ সংস্কৃতি বদলাবে, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে উঠবে।
বিএনপি ১৫৭টি পৌরসভার দেড় সহস্রাধিক কেন্দ্রে দখল, কারচুপি ও নির্বাচনী এজেন্টদের বের করে দেওয়ার কথা জানিয়েছে। এ প্রসঙ্গে সিইসি জানান, যেখানে সমস্যা হয়েছে, সেখানেই কমিশন ব্যবস্থা নিয়েছে।
নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ বলেছে, নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে।দলটি নির্বাচনের আগে দুই শতাধিক পৌরসভায় বিজয়ী হওয়ার হিসাব দিয়েছিল। যদিও পুলিশের গোপন জরিপ বলেছিল, আওয়ামী লীগ ১২৮ এবং বিএনপি ৪৯টিতে জিততে পারে।
বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত স্থগিত দুটি বাদে রাত ১২ টায় শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ৩৩২ টি পৌরসভার মধ্যে ৩১২টির ফল গণণা শেষ হয়েছে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৭০টি, আওয়ামী লীগের বিদ্রাহী প্রার্থীরা ১৬টি, বিএনপির প্রার্থীরা ১৮টি, বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী দুটি, জাতীয় পার্টির প্রার্থী একটি এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা পাঁচটিতে জয়ী হয়েছেন। একই সঙ্গে সরকার ও বিরোধী দলে থাকা জাতীয় পার্টির একজন মেয়র প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন চারজন।
এ প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত ভোট গণনা চলতে থাকা পৌরসভাগুলোতেও এগিয়ে আছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা।
১৪ দলে থাকা সরকারের শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদসহ নির্বাচনে অংশ নেওয়া বাকি ১৭ টি রাজনৈতিক দল থেকে কোনো মেয়র প্রার্থী বিজয়ী হতে পারেননি। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৪০টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ২০টি এই নির্বাচনে অংশ নেয়।
২৩৪টি পৌরসভায় মেয়র পদে আওয়ামী লীগ সবকটিতে, বিএনপি ২২৩টি, জাতীয় পার্টি ৭৪টি, জাসদ ২১টি, ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ ৫৭টি এবং ওয়ার্কার্স পার্টি ৮টি পৌরসভায় প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছিল।
“দৃশ্যত নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে, কিন্তু ভেতরে কিছু ঘটেছে কিনা, তা খতিয়ে দেখতে হবে,” বেনারকে জানান সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার।
তিনি বলেন, গত জাতীয় সংসদ নির্বাচন, উপজেলা নির্বাচন এবং তিনি সিটি নির্বাচনের চেয়ে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। কিন্তু দুই দলের প্রার্থীদের ভোটের ব্যবধান অবিশ্বাস্য।
নিহত এক
নির্বাচনের ভোট গ্রহণ পর্বে সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটেছে চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায়। দুই প্রতিদ্বন্দ্বী কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের গোলাগুলির মধ্যে পড়ে সেখানে নুরুল আমিন নামে তৃতীয় এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন।
যে সব পৌরসভার নির্বাচনে অবাঞ্ছিত ঘটনা বেশি ঘটেছে তার মধ্যে চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় নুরুল আমিন নিহত হন। পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী আবদুল হালিম ও মোজাম্মেল হকের সমর্থকদের গোলাগুলির মধ্যে পড়ে তিনি নিহত হন। এ সময় তিনি ভোট দিতে যাচ্ছিলেন।
স্থানীয় বিএনপি নুরুল আমিনকে তাঁদের কর্মী বলে দাবি করেছে। আর আওয়ামী লীগ বলেছে, তিনি কোনো দলের কর্মী নন।
আহত শতাধিক
দেশের বিভিন্ন এলাকায় শতাধিক আহত হয়েছেন। নির্বাচন চলাকালে ভোটকেন্দ্র দখল ও দখলের চেষ্টা ছিল। ব্যালট পেপারে সিল মারা হয়েছে বিভিন্ন এলাকায়। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ, ককটেল বিস্ফোরণ, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া সবই হয়েছে।
বরগুনা সদর পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর সমর্থকেরা দিনভর বিভিন্ন ভোটকেন্দ্র দখলের চেষ্টা চালায়। এই নিয়ে পুলিশের সঙ্গে তাদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। এতে বরগুনা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও একজন সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তাসহ ৩০ জন আহত হয়েছেন। প্রশাসনের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ এনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী কামরুল আহসান ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন এবং শহরে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন।
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএনপির মেয়র প্রার্থী সৈয়দ আবুল মনসুরের ওপর প্রতিপক্ষ হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাঁকে প্রথমে স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ও পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চট্টগ্রাম জেলার ১০টি পৌরসভায়ই পুনরায় ভোট গ্রহণের দাবি জানিয়েছে বিএনপি। বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মীর মোহাম্মদ নাছিরউদ্দিন গতকাল বিকেলে চট্টগ্রামে তাঁর বাসভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে এই দাবি জানান।
লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে ব্যাপক জালভোট দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সেখানকার বিএনপির মেয়র প্রার্থী এবিএম জিলানী অভিযোগ করেছেন, লক্ষ্মীপুর পৌরসভার মেয়র আবু তাহেরের কয়েকশ’ ক্যাডার আগের রাতেই রায়পুরে অবস্থান নেয়। সকালে তাঁরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে কেন্দ্রগুলো দখল করে ব্যালটে সিল মারে। বেলা ১১টার মধ্যে ব্যালট বাক্স ভরে যায়। এ ছাড়া বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয় বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
মুন্সিগঞ্জে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও একই দলের বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে গোলাগুলি ও সংঘর্ষে আটজন গুলিবিদ্ধ ও কমপক্ষে ২৫ জন আহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যে দুজন সাংবাদিকও রয়েছেন। এ ছাড়া মুন্সিগঞ্জের মীরকাদিম পৌরসভার নির্বাচনেও সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে।
বগুড়ার আটটি কেন্দ্রে ককটেল বিস্ফোরণ, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, প্রতিপক্ষের অফিস ভাঙচুরসহ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। বগুড়ায় পুলিশ ৪/৫ রাউন্ড গুলিবর্ষণ করেছে। একজন কাউন্সিলর প্রার্থীর নির্বাচনী এজেন্ট ছুরিকাহত হয়েছেন।
নড়াইলের কালিয়ায় কেন্দ্র দখল করে নৌকা মার্কায় সিল দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। সেখানে বিএনপি নির্বাচন বর্জন করেছে। একটি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত রাখা হয়েছে। ভ্রাম্যমাণ আদালত নড়াইল ও কালিয়ায় মোট আটজনকে ছয় মাস করে কারাদণ্ড দিয়েছেন।
কুমিল্লার বরুড়ায় বহিরাগতরা গভীর রাতে ভোটকেন্দ্রে ঢুকে ব্যালটে সিল মারায় একটি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ স্থগিত করা হয়। লাকসামে ২০টি কেন্দ্রের আটটিতেই অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে প্রশাসন ছিল কঠোর অবস্থানে। সকালে দেশি অস্ত্রসহ আওয়ামী লীগ নেতা ও উত্তরদা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গোলাম রব্বানী মজুমদারসহ লাকসামের বিভিন্ন জায়গা থেকে আটজনকে আটক করে র্যাব। পরে সংক্ষিপ্ত ট্রায়ালে এদের চারজনকে সাত মাসের জেল দেন আদালত। তবে সতর্ক করে ছেড়ে দেওয়া হয় আটককৃত ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানসহ চারজনকে। উত্তরকূল কেন্দ্রে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ নয় রাউন্ড গুলি ছোড়ে।
মৌলভীবাজার পৌরসভার ১৪টি কেন্দ্রের মধ্যে ৮ টিতেই গোলযোগ হয়েছে। জাল ভোট দেওয়াকে কেন্দ্র করে বাজার আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে সৃষ্ট গোলযোগ নিয়ন্ত্রণে পুলিশ তিনটি ফাঁকা গুলি করে। কিছুক্ষণ নির্বাচন বন্ধ রাখা হয়। এ সব ঘটনায় কর্তব্যরত পাঁচজন সাংবাদিক লাঞ্ছিত হয়েছেন।
নির্বাচন বর্জন ও স্থগিত
পরিস্থিতির কারণে সাতটি পৌরসভায় বিএনপির মেয়র প্রার্থীরা এবং একটিতে (বরগুনা) আওয়ামী লীগের প্রার্থী নির্বাচন বর্জন করেন। অবশ্য ভোট গ্রহণ চলাকালে বিএনপির পক্ষ থেকে বিভিন্ন পৌরসভার ৯৪টি কেন্দ্রে, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ১৮টি পৌরসভার একাধিক কেন্দ্রে এবং জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে ১৭৪টি কেন্দ্রে অনিয়ম হয়েছে বলে নির্বাচন কমিশনের কাছে অভিযোগ করা হয়।
গতকাল যে ২৩৪টি পৌরসভার নির্বাচন হয়েছে সেগুলোতে মোট ভোটকেন্দ্র ছিল তিন হাজার ৫৫৫ টি।
তবে যে সব এলাকায় এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে তার প্রায় সবগুলোতেই নির্বাচন কমিশন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছে। এই ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে নরসিংদীর মাধবদী পৌরসভার নির্বাচন স্থগিত ঘোষণা।
এ ছাড়া ১৮টি পৌরসভার ৩৮টি কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে। কয়েকজন প্রার্থী ও কিছু কর্মীকে আটক এবং পাঁচজন পুলিশ কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
“নির্বাচন সার্বিকভাবে সুষ্ঠু হয়েছে। ছোটখাট যে সব ঘটনা ঘটেছে তাতে পৌর নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না,” নির্বাচন সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম সাংবাদিকদের এ কথা বলেন।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিব উদ্দিন আহমদ বলেছেন, বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ছাড়া শান্তিপূর্ণ ভোটগ্রহণ হয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অভিযোগ সম্পর্কে সিইসি বলেন, ‘যেসব অভিযোগ এসেছে, তার বেশির ভাগ এসেছে বিএনপির কাছ থেকে। কমিশন সব রাজনৈতিক দলের অভিযোগ তাৎক্ষণিকভাবে গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিয়ে ব্যবস্থা নিয়েছে।
বুধবারের নির্বাচনে মেয়রের পদ ৯৪৩, সাধারণ কাউন্সিলরের ২ হাজার ১৯৩টি পদের জন্য ৮ হাজার ৭৪৬ জন এবং সংরক্ষিত কাউন্সিলরের ৭৩১টি পদের জন্য ২ হাজার ৪৮০ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।