গুলি করে হত্যা করা যাবে রাজাকার হাসান আলীকে

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2015.06.09
BD-warcrimes মঙ্গলবার হাসান আলীর রায় ঘোষণার দিন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের আশে-পাশে ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়। ৯ জুন,২০১৫
বেনার নিউজ

মুক্তিযুদ্ধকালে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এই প্রথম একজন রাজাকারকে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে ফাঁসির বিকল্প হিসেবে গুলি করে হত্যার আদেশ দিয়েছেন। কিশোরগঞ্জের তাড়াইলের ওই রাজাকার সৈয়দ মো. হাসান আলী অবশ্য পলাতক আছেন।

পলাতক হাসান আলীকে খুঁজে বের করে সাজা কার্যকর করার জন্য স্বরাষ্ট্রসচিব ও পুলিশের মহাপরিদর্শককে নির্দেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।

“এর আগে শুধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলায় বিচারিক আদালত আসামিদের ফাঁসি অথবা গুলি করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের রায় দিয়েছিলেন। তবে উচ্চ আদালত গুলির বিষয়টি বাদ দিয়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আদেশ বহাল রাখেন,” বেনারকে জানান মানবতাবিরোধী অপরাধ তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক আবদুল হান্নান খান।

তবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার এই নতুন বিধান নিয়ে দেশজুড়ে গতকাল আলোচনা হয়েছে। রাস্তায় নেমে মিছিল করে মিষ্টি বিলিয়ে আনন্দ প্রকাশ করেছে কিশোরগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধারা। একাত্তরে ওই এলাকাতেই খুন, অপহরণ, লুটপাট চালিয়েছিলেন এই যুদ্ধাপরাধী।

“এতোদিন মনে মনে তাঁর বিচার দাবি করে আসছি। আমার বাবাসহ ১০ জনকে দলবল নিয়ে হত্যা করেছিল ওই রাজাকার। তাঁকে (হাসান আলী) গ্রেপ্তার করে ফাঁসি কার্যকর করা হলে আমার বাবার আত্মা শান্তি পাবে,” রায় ঘোষণার পর টেলিফোনে এক প্রতিক্রিয়ায় বেনারকে জানান জেলার তাড়াইল উপজেলার শিমুলহাটি গ্রামের শহীদ অক্কুর চন্দ্র পালের ছেলে সুনীল চন্দ্র পাল (৬৫)।

আড়াইউড়া গ্রামের শহীদ কামিনী ঘোষের ছেলে নীপেন্দ্র চন্দ্র ঘোষ বলেন, “ফাঁসির আদেশ হলেই হবে না। হাসান আলীকে গ্রেপ্তার করে ফাঁসি কার্যকর করতে হবে।”
ট্রাইব্যুনালের আগের রায়গুলোর মতো ৯ জুনও রাজধানীর শাহবাগে আনন্দ মিছিল করে সন্তোষ প্রকাশ করে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চ।
“সরকারের দায়িত্ব এই পলাতক যুদ্ধাপরাধীকে যেকোনো মূল্যে খুঁজে বের করে তার শাস্তি কার্যকর করা,” বেনারকে জানান মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার।
সাজা ঘোষণার সময় ট্রাইব্যুনাল বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনে মৃত্যুদণ্ড কীভাবে কার্যকর করা হবে এ নিয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু বলা নেই। ফৌজদারি কার্যবিধিতে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার কথা বলা আছে।

আর ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে বলা হয়েছে, ওই আইনের অধীনে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে অথবা গুলি করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা যাবে। এ জন্য ট্রাইব্যুনাল মনে করেন, ফাঁসিতে ঝুলিয়ে বা গুলি করে—সরকার যেভাবে চাইবে সেভাবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে পারবে।

বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১ গতকাল ৯ জুন  এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। এ ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি আনোয়ারুল হক।

এ নিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৯টি মামলার রায় ঘোষণা করা হলো। এর মধ্যে নয়টি মামলার রায় ঘোষণা করলেন ট্রাইব্যুনাল-১। বাকি ১০টি মামলার রায় দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল-২।

গতকাল হাসান আলীর বিরুদ্ধে মামলার রায়ে ট্রাইব্যুনাল-১ বলেন, আসামির বিরুদ্ধে গঠন করা ছয়টি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে তৃতীয় ও চতুর্থ অভিযোগ গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে হাসান আলীকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়।

এ ছাড়া দ্বিতীয়, পঞ্চম ও ষষ্ঠ অভিযোগে তাঁকে আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। প্রমাণিত না হওয়ায় প্রথম অভিযোগ থেকে তিনি খালাস পান।

পলাতক থাকায় আসামির অনুপস্থিতিতে এই বিচার করতে হয়েছে বলে রায় ঘোষণার আগে ট্রাইব্যুনাল হতাশা প্রকাশ করেন। ট্রাইব্যুনাল বলেন, ট্রাইব্যুনাল শুধু গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি বা পলাতক আসামিকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের মতো আইনি দায়িত্ব পালন করতে পারেন।

কিন্তু পুলিশ আসামিকে গ্রেপ্তার করতে ব্যর্থ হয়েছে। আসামিদের গ্রেপ্তার করতে না পারায় ট্রাইব্যুনাল তাঁর উৎকণ্ঠাও জানিয়েছেন। আসামি উপস্থিত থাকলে তিনি যেমন আত্মপক্ষ সমর্থন করতে পারতেন, তেমনি বিচারের গ্রহণযোগ্যতা আরও বেশি হতো। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য রাষ্ট্রপক্ষ, তদন্ত সংস্থাসহ সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ব রয়েছে।

দুই ট্রাইব্যুনাল এ পর্যন্ত মানবতাবিরোধী অপরাধের যে ১৯টি মামলার রায় দিয়েছেন, এর মধ্যে পাঁচটি মামলায় ছয়জন আসামির পলাতক অবস্থায় বিচার হয়েছে। এর মধ্যে ট্রাইব্যুনাল-১ তিনটি ও ট্রাইব্যুনাল-২ দুটি মামলার রায় দিয়েছেন পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে। পলাতক ওই ছয় আসামির কাউকেই এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার বা খুঁজে বের করতে পারেনি পুলিশ।

তৃতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর হাসান আলী, রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনারা তাড়াইল থানার শিমুলহাটি গ্রামের পালপাড়ার অক্রুর পালসহ ১২ জনকে হত্যা করে ঘরবাড়িতে আগুন দেয়।

চতুর্থ অভিযোগ অনুসারে, ২৭ সেপ্টেম্বর বড়গাঁও গ্রামের মরকান বিলে বেলংকা রোডে সতিশ ঘোষসহ আটজনকে হত্যা করে হাসান আলী ও সহযোগী রাজাকাররা। এ দুটি অভিযোগে হাসান আলীর বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন ও সহযোগিতার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেন।

দ্বিতীয়, পঞ্চম ও ষষ্ঠ অভিযোগে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে হাসান আলীকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়। দ্বিতীয় অভিযোগ অনুসারে, একাত্তরের ২৩ আগস্ট হাসান আলী, রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনারা কোনাভাওয়াল গ্রামের তফাজ্জল হোসেন ভূঁইয়াকে হত্যা করে দুটি ঘর লুট ও দুজনকে অপহরণ করে।

পঞ্চম অভিযোগ, ৮ অক্টোবর হাসান আলী, রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনারা আড়াইউড়া গ্রামের কামিনী কুমার ঘোষ ও জীবন ঠাকুরকে হত্যা করে ঘরবাড়ি লুট করে।

ষষ্ঠ অভিযোগ, ১১ ডিসেম্বর হাসান আলী ৩০-৪০ জন রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে নিয়ে সাচাইল গ্রামের শতাধিক ঘরে অগ্নিসংযোগ করে এবং গ্রামের আবদুর রশিদকে হত্যা করে।

রায়ে বলা হয়, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সদর উপজেলার মাছিহাতা গ্রামে ১৯৪৭ সালে হাসান আলীর জন্ম হয়। তাঁর বাবা সৈয়দ মোসলেম উদ্দিন একাত্তরে পূর্ব পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান ও কিশোরগঞ্জ মহকুমা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন।

বাবার মুক্তিযুদ্ধবিরোধী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে হাসান আলী রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেন এবং কিশোরগঞ্জের তাড়াইল থানার রাজাকার কমান্ডার হন। তিনি নিজেকে তাড়াইল থানার ‘দারোগা’ হিসেবে পরিচয় দিতেন।

গত বছরের ৩ এপ্রিল তাঁকে গ্রেপ্তারের জন্য ট্রাইব্যুনাল পরোয়ানা জারি করেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাঁকে গ্রেপ্তার করতে না পারায় পলাতক ঘোষণা করে তাঁর বিচার শুরু হয়। তাঁর পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী হিসেবে নিয়োগ পান আবদুস শুকুর খান।

গত বছরের ১১ নভেম্বর তাঁর বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের ছয়টি অভিযোগ গঠন করা হয়। ৮ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তাসহ রাষ্ট্রপক্ষে ২৬ জন সাক্ষ্য দেন।

“হাসান আলীর আত্মসমর্পণ করে আপিল করা উচিত। আপিল করলে রায় তাঁর পক্ষে যাবে বলে আমার বিশ্বাস,” সাংবাদিকদের জানান আসামিপক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আবদুস শুকুর খান।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।