যুদ্ধাপরাধের দায়ে ‘কসাই’ সিরাজের মৃত্যুদন্ড, আকরামের আমৃত্যু কারাদন্ড

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2015.08.11
BD-warcrimes সিরাজ মাস্টারকে মৃত্যুদণ্ড(বামে) এবং খান আকরাম হোসেনকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া হয়। ১১ আগষ্ট,২০১৫
বেনার নিউজ

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত আরো দু’জনকে শাস্তি দিয়েছে যুদ্ধাপরাধের বিচারে গঠিত বাংলাদেশের বিশেষ আদালত।
মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম বাগেরহাটের রাজাকার নেতা শেখ সিরাজুল হক ওরফে সিরাজ মাস্টারকে মৃত্যুদণ্ড এবং খান আকরাম হোসেনকে আমৃত্যু কারাদণ্ডের রায় ঘোষণা করেন।

এ ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি মো. আনোয়ারুল হকও এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

মামলার বিবরণ থেকে জানা যায়, একাত্তর সালে যখন স্বাধীনতার জন্য বাঙালিরা দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ছিল, তখন পাক বাহিনীকে সহযোগিতা করার উদ্দেশ্যে গঠিত রাজাকার বাহিনীতে এ মামলার আসামিরা যোগ দেন। খুলনার আনসার ক্যাম্পে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে তারা অন্যান্য রাজাকার সদস্যদের সঙ্গে বাগেরহাটের সদর, কচুয়া, মোড়েলগঞ্জ ও রামপাল থানার বিভিন্ন গ্রামে মানবতাবিরোধী অপরাধ চালান।

সিরাজ মাস্টারকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে, অথবা গুলি করে দণ্ড কার্যকর করতে বলা হয়েছে। আর আকরামকে স্বাভাবিক মৃত্যুর আগ পর্যন্ত জেলখানাতেই থাকতে হবে।

রায় ঘোষণার সময় দুই আসামিকেই আদালতে ভাবলেশহীন দেখা যায়।

একই মামলায় এই দুই আসামির সঙ্গে আব্দুল লতিফ তালুকদার (৭৫) নামে আরেক রাজাকার সদস্য অভিযুক্ত হন। কিন্তু রায়ের আগেই কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় গত ২৭ জুলাই তিনি মারা গেলে মামলা থেকে তার নাম বাদ দেওয়া হয়।

সিরাজসহ এ পর্যন্ত ২১টি মামলার ২৪ আসামির মধ্যে ১৬জন যুদ্ধাপরাদীকে সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হল।

এ মামলার মোট সাতটি অভিযোগের মধ্যে সিরাজের বিরুদ্ধে হত্যা, গণহত্যা, লুটপাট ও অগ্নি সংযোগের মতো পাঁচটি অভিযোগ প্রমাণিত হয়। আর আকরামের বিরুদ্ধে তিনটি অভিযোগের মধ্যে দুটিতে ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত না হওয়ায় আদালত তাকে খালাস দেয়। তবে সর্বশেষ অভিযোগে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়ায় তাকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।


রাষ্ট্রপক্ষ খুশি, সংক্ষুব্ধ আসামিপক্ষ

সিরাজ মাস্টারকে মৃত্যুদণ্ড ও আকরাম হোসেনকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়ার আদেশে রাষ্ট্রপক্ষ খুশি হলেও সংক্ষুব্ধ হয়েছেন আসামিপক্ষ। তারা আপিল করবেন বলে জানিয়েছেন। সরকার পক্ষের কৌঁসুলি সাইয়েদুল হক সুমন বেনারকে বলেন, “কসাই সিরাজ মাস্টারের বিরুদ্ধে যথাযথ রায় হয়েছে। তিনি ১৯৭১ সালে প্রতিদিন একজন করে মানুষ হত্যা করতেন। শিক্ষক হয়েও তিনি কত নিচে নেমেছিলেন তা ভাবনার অতীত।”

আর দণ্ডপ্রাপ্ত শেখ সিরাজুল ইসলামের আইনজীবী আবুল হাসান বলেন, “এ রায়ে আমরা সংক্ষুব্ধ। রাজাকার ডেপুটি কমান্ডারের অভিযোগের পক্ষে কোনো দলিল দেখাতে পারেনি রাষ্ট্রপক্ষ। আমরা এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করব।”

খান আকরামের আইনজীবী সারোয়ার হোসেন বলেন, “আমরা ন্যায় বিচার পাইনি। আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে। আপিলের প্রস্তুতি নেওয়া হবে এখন।”


সুশীল সমাজে স্বস্তি

এদিকে বড় বড় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পাশাপাশি আঞ্চলিক ছোট-খাট রাজাকারদেরও বিচার চলমান থাকায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।

এবিষয়ে একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির আন্তজার্তিক সম্পর্ক বিষয়ক সম্পাদক সাব্বির খান বেনারকে বলেন, “বাগেরহাটের রাজাকার নেতা শেখ সিরাজুল হক ওরফে সিরাজ মাস্টারকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার বিষয়টি অবশ্যই ইতিবাচক এবং সুবিচার পাওয়ার জন্য স্বস্তি প্রকাশ করছি। অপর যুদ্ধাপরাধী আকরাম হোসেনেরও একই শাস্তি পাওয়া উচিত ছিল। শুরু থেকেই আমরা যুদ্ধাপরাধীদের সর্বনিম্ন সাজা ফাঁসিই চেয়ে আসছি।”

তিনি আরো বলেন, “ব্যক্তি উদ্যোগে করা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মামলাগুলো শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধীদের মতই প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে, যা অবশ্যই ট্রাইব্যুনালের প্রাজ্ঞতা ও সক্ষমতারই সাক্ষ্য বহন করে। এটা খুবই ইতিবাচক এবং সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।”

ট্রাইব্যুনালের দেওয়া রায়গুলোর তড়িৎ কার্যকর করাসহ সাক্ষীদের নিরাপত্তা এবং সুরক্ষার বিষয় এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচার দাবি করেন তিনি।


যেভাবে সিরাজ ‘মাস্টার’ থেকে ‘কসাই’

গোটাপাড়া বাগেরহাট সদরের একটি গ্রাম। সেই গ্রামের হারেজউদ্দিন শেখ ও সালেহা বেগমের ছেলে শেখ সিরাজুল হক, যার জন্ম ১৯৪২ সালে। বিএ পাস করার পর তিনি বাগেরহাটের সায়েড়া মধুদিয়া কলেজিয়েট স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। পরে তিনি খুলনার মাল্টিলেটারাল হাই স্কুলে যোগ দেন এবং মুক্তিযুদ্ধের আগ পর্যন্ত সেখানেই চাকরি করেন।

মুসলীম লীগের ছাত্র সংগঠন ন্যাশনাল স্টুডেন্ট ফেডারেশন বা এনএসএফ-এর মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে আসা সিরাজ পরে মূল দলেও সক্রিয় হন বলে মামলার নথিতে পাওয়া যায়।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেন। পরে বাগেরহাট অঞ্চলের রাজাকার উপ প্রধানের দায়িত্ব পেয়ে জেলার বিভিন্ন স্থানে রাজাকার বাহিনীর সঙ্গে বিভিন্ন যুদ্ধাপরাধে অংশ নেন তিনি। সে সময়ে বন্দুকের বেয়নেট দিয়ে গলা কেটে বহু মানুষকে হত্যা করেন সিরাজ। সেই থকে তার নাম হয় ‘কসাই সিরাজ’।

এই ‘কসাই সিরাজ’ রাজাকার বাহিনীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির একেএম ইউসুফের ‘বাঁ হাত’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ইউসুফ সম্প্রতি যুদ্ধাপরাধের মামলার বিচার চলাকালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ত্রিশ বছর পর ২০০১ সালে সিরাজ যোগ দেন বিএনপিতে। ২০০৬ সাল পর্যন্ত তিনি বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন।


কৈশোরেই যুদ্ধাপরাধী আকরাম

জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য থেকে জানা যায়, ১৯৫৫ সালের ৩ ডিসেম্বর বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জের দৈবজ্ঞহাটি গ্রামে খান আকরাম হোসেনের জন্ম। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পাস করেন আকরাম। এরপর ভোল পাল্টে সরকারি চাকরিও জুটিয়ে ফেলেন। কিশোর বয়সে যুদ্ধাপরাধে অংশ নেওয়া আকরাম কৃষি বিভাগের মেকানিক হিসেবে ২০১১ সালে অবসরে যান।

সিরাজ মাস্টারের মত আকরামও একাত্তরে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেন এবং বাগেরহাট অঞ্চলে পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগিতায় নানা ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধে অংশ নেন।

যে তিনটি ঘটনায় আকরামকে ট্রাইব্যুনালে অভিযুক্ত করা হয়, তার প্রতিটি ঘটনাতেই সঙ্গে ছিলেন বাগেরহাটের আরেক রাজাকার সদস্য লতিফ তালুকদার।


মামলার আদ্যোপান্ত

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাগেরহাটের কচুয়ার শাঁখারীকাঠি বাজারে ৪২ জনকে গণহত্যা, ধর্ষণ ও বাড়িতে অগ্নিসংযোগসহ ছয়টি অভিযোগে ২০০৯ সালে সিরাজ মাস্টারসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়।

ওই গণহত্যায় নিহত রঘুদত্তকাঠি গ্রামের শহীদ জিতেন্দ্র নাথ দাসের ছেলে নিমাই চন্দ্র দাস কচুয়া থানায় মামলাটি দায়ের করেন। মামলাটি পরে ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়।

গতবছর ১০ জুন ট্রাইব্যুনাল তিন আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলে পরদিন লতিফ তালুকদারকে গ্রেপ্তার করে কচুয়া থানা পুলিশ। এরপর ১৯ জুন আকরাম হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয় রাজশাহী থেকে। ২০ জুলাই গ্রেপ্তার হন সিরাজ মাস্টার।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।