ফাঁসি দুই-একদিনের মধ্যেই, হাসিনার সফর বাতিল, খালেদা দেশে ফিরছেন
2015.11.19
ফাঁসির রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন খারিজের পরদিন গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ের অনুলিপি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌঁছেছে। এই কারাগারেই কনডেমড সেলে বন্দী আছেন মানবতাবিরোধী অপরাধী সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ।
দিনভর গুঞ্জন ছিল বৃহস্পতিবার রাতেই ফাঁসি কার্যকর হবে। কিন্তু রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত তা হয়নি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সাংবাদিকদের রাতেই জানান বৃহস্পতিবার ফাঁসি হচ্ছে না।
তবে শুক্রবার জুম্মার নামাজের দিন ফাঁসি সাধারনত দেয়া হয় না, সেক্ষেত্রে শনিবারের আগে ফাঁসি কার্যকরের সম্ভাবনা নেই মনে করা হচ্ছে।
জামায়াতের হরতাল, জনগনের প্রত্যাখান
মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর হওয়ার আগে জামায়াতের ডাকা হরতাল ঢিলেঢালাভাবে পালিত হয়েছে। গতকাল দেশের কোথাও, কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। জীবনযাত্রা ছিল অনেকটাই স্বাভাবিক।
“সাম্প্রদায়িক শক্তির হরতাল প্রত্যাখ্যান থেকে প্রমাণ হয়, জনগণ তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে,” সাংবাদিকদের জানান তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু।
জামায়াতে ইসলামীর ডাকা হরতাল প্রত্যাখ্যান করে গতকাল হরতালবিরোধী বিক্ষোভ মিছিল করে গণজাগরণ মঞ্চ। এ সময় মঞ্চের কর্মী-সংগঠকেরা জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানান।
দেশজুড়ে চাপা উত্তেজনা
রাজনৈতিক চাপ সামলে উঠলেও দুই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি কার্যকরের আগেভাগে দেশজুড়ে অন্যরকম পরিস্থিতি ও চাপা উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। কখন, কী ঘটে—সেই আশঙ্কায় সতর্ক অবস্থান নিয়েছে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
প্যারিসে হামলার পর ইউরোপের পরিস্থিতি এবং দেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফ্রান্সের দুটি ও মাল্টা সফর বাতিল করেছেন। অন্যদিকে বিএনপির চেয়ারপারসন কাল ২১ নভেম্বর ঢাকায় ফেরার কথা জানিয়েছেন।
বিএনপির পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে দলের মুখপাত্র আসাদুজ্জামান রিপন গতকাল বলেন, খালেদা জিয়ার চিকিৎসা এখনো শেষ হয়নি। কিন্তু দেশের ক্রান্তিকাল ও সংকট বিবেচনায় তিনি চিকিৎসা শেষ না করে দেশে ফিরছেন।
এদিকে চাঞ্চল্যকর হামলা ও কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় নাশকতার আশঙ্কা রয়েছে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। এই আশঙ্কা থেকেই সব বিমানবন্দরে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। একইভাবে কারাগারগুলোতেও নেওয়া হয়েছে বাড়তি নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা। প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। বেড়েছে নিরাপত্তা তল্লাশি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, একের পর এক রোমহর্ষক ঘটনায় সরকারের ভেতর-বাইরে অস্থিরতা যেমন আছে, তেমনি আছে এর চেয়ে বড় কিছু ঘটতে পারে-এমন ভীতিও। কিন্তু দুর্বৃত্তদের ঠেকানো যে সম্ভব হচ্ছে না, তার প্রমাণ গত প্রায় দুই মাসের রোমহর্ষক ও নৃশংস সব ঘটনা।
সরকারের একাধিক শীর্ষস্থানীয় নেতা ও মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা থাকলেও তাঁরা মনে করছেন, পরিস্থিতি এখন পর্যন্ত সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে নয়। তবে সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় সরকার অতি মাত্রায় সতর্ক। এর প্রভাব জনমনে পড়লেও তা সহসাই কেটে যাবে বলে মনে করছেন তাঁরা।
“আসলে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। কিন্তু সরকারও বসে নেই, দুষ্কৃতকারীদের গ্রেপ্তার ও বিচার চলছে,” বেনারকে জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, যিনি ১৪ দলের সমন্বয়ক।
তাঁর মতে, দেশে এখন ওই অর্থে সংকট নেই। অর্থনীতির সব সূচকে অগ্রগতি রয়েছে।
পরিবারের দেখা, প্রাণভিক্ষার অপেক্ষা
গতকাল সকালে দুই বন্দীর পরিবারের সদস্যরা কারাগারে গিয়ে দুই ফাঁসির আসামির সঙ্গে দেখা করেন। রায় কার্যকরের আগে তাঁদের রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার সুযোগ আছে। তবে তাঁরা প্রাণভিক্ষা চাইবেন কি না—এ বিষয়ে পরিবারের সদস্যরা সুনির্দিষ্ট করে কিছু গণমাধ্যমকে জানাননি।
কারাগার সূত্র জানিয়েছে, সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদ—দুজনকেই পাশাপাশি দুটো কনডেমড (রজনীগন্ধা) সেলে রাখা হয়েছে। ওই সেলের অন্য সব বন্দীকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
“দণ্ড কীভাবে কার্যকর হবে, তা সরকারের সিদ্ধান্ত,” সাংবাদিকদের জানান অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।প্রাণভিক্ষার আবেদন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ আবেদন আসামিকে নিজ হাতে লিখতে হয়। এখানে আইনজীবীদের কোনো কাজ নেই।
গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সাকা চৌধুরীর স্ত্রী ফারহাত কাদের চৌধুরী, বড় ছেলে ফজলুল কাদের চৌধুরী, ছোট ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী, মেয়ে ফারজিন কাদের চৌধুরী, ভাই গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামালউদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ পরিবারের ২২ জন সদস্য কারাগারে যান।
সাক্ষাৎ শেষে বেলা দেড়টার দিকে সাকা চৌধুরীর পরিবারের সদস্যরা কারাগার থেকে বের হন। এ সময় গণমাধ্যমকর্মীরা সাকা চৌধুরীর পরিবারের সদস্যদের মুখোমুখি হলেও তাঁরা কিছু বলতে রাজি হননি।
কারাগার সূত্র জানায়, সাক্ষাতের সময় সাকা চৌধুরী ছিলেন ভাবলেশহীন। তবে ওই সময় তাঁর পরিবারের এক নারী সদস্য অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। অন্যরা তাঁর শুশ্রূষা করেন।
সাকা চৌধুরী প্রাণভিক্ষার আবেদন করবেন কি না—জানতে চাইলে গতকাল রাতে মুঠোফোনে হুম্মাম কাদের চৌধুরী বেনারকে বলেন, “এ বিষয়ে পরিবারের সঙ্গে তাঁর কোনো কথা হয়নি। বিষয়টি নিয়ে তিনি আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলবেন।”
সাকা চৌধুরীর পরিবার চলে যাওয়ার পর বেলা একটা ৫০ মিনিটে কারাগারে যান মুজাহিদের পরিবারের সদস্যরা। মুজাহিদের স্ত্রী তামান্না ই জাহান, ছেলে আলী আহমেদ তাজদীদ, আলী আহমেদ তাহকীক ও আলী আহমেদ মাবরুর, মেয়ে তামান্না বিনতে জান্নাতসহ ১২ জন সদস্য কারাগারে যান।
সাক্ষাৎ শেষে মুজাহিদের মেজো ছেলে আলী আহমেদ মাবরুর সাংবাদিকদের বলেন, “এটা নিয়মিত সাক্ষাৎ ছিল। তিনি স্বাভাবিক রয়েছেন। তিনি দৃঢ়ভাবে বলেছেন, তিনি নির্দোষ।”
মুজাহিদ রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবেন কি না—জানতে চাইলে মাবরুর বলেন, “এ বিষয়ে তিনি (মুজাহিদ) কিছু বলেননি। তিনি রাষ্ট্রপতিকে দেশের সাংবিধানিক অভিভাবক মনে করেন। সে জন্য আইনজীবীদের সঙ্গে পরামর্শ করে তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে একটি বিষয়ে আবেদন করতে চান।”
প্রধানমন্ত্রীর সফর বাতিল
প্যারিসের হামলার পর ইউরোপের পরিস্থিতি এবং দেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতিকে বিবেচনায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মাল্টা ও ফ্রান্স সফর বাতিল করা হয়েছে। কমনওয়েলথ সরকার প্রধানদের সম্মেলনে যোগ দিতে ২৭ নভেম্বর থেকে প্যারিস এবং জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে ৩০ নভেম্বর শেখ হাসিনার প্যারিস যাওয়ার কথা ছিল।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, প্রধানমন্ত্রীর পরিবর্তে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী কমনওয়েলথ সরকার প্রধানদের বৈঠকে বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেবেন। অন্যদিকে, পরিবেশ মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেবেন।
ইউনেস্কোর সাধারণ সম্মেলনে যোগ দিতে গত ১৬ ও ১৭ নভেম্বরের প্যারিস সফর সহ চলতি মাসে প্রধানমন্ত্রীর তিনটি ইউরোপ সফরই বাতিল করা হলো।
সরকারের একাধিক সূত্র জানায়, ইউরোপের পরিস্থিতির চেয়ে মাল্টা সফর বাতিলের ক্ষেত্রে দেশের পরিস্থিতি বিশেষ করে ফাঁসির আদেশ বহালকে কেন্দ্র করে জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপি কি ধরনের তৎপরতা চালাবে সেটি বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।
তা ছাড়া গত বুধবার দিনাজপুরে ইতালির ধর্মযাজকের ওপর হামলার পর বিদেশিদের ওপর হামলার সঙ্গে মানবতাবিরোধী বিচারের যোগসূত্র দেখছে সরকার। সব মিলিয়ে এ মুহূর্তে মাল্টা যাওয়া সমীচীন হবে না মেনে সফরটি বাতিল করা হয়েছে।
সাকার পক্ষে বিএনপির সাফাই
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী ন্যায়বিচার পাননি বলে মনে করে বিএনপি। দলটির দাবি, সাকা চৌধুরীর পক্ষে আদালতে যেসব দালিলিক প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়েছিল, সেগুলো বিবেচনায় নিলে হয়তো তাঁর ফাঁসির আদেশ হতো না। সাকা চৌধুরী রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে ‘পারসিকিউশনের’ শিকার হয়েছেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন দলটির মুখপাত্র আসাদুজ্জামান রিপন।
সাকা চৌধুরীর বিচারের ক্ষেত্রে অপরাধের চেয়ে রাজনৈতিক পরিচয় প্রাধান্য পেয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের ছয়বার সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন; তাঁর এলাকার মানুষ তাঁকে জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে সংসদে পাঠিয়েছিলেন। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের জন্য তাঁর কমিটমেন্ট ছিল।”
এক প্রশ্নের জবাবে আসাদুজ্জামান বলেন, “আপিল বিভাগে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রায়ের পর বিএনপির যে অবস্থান ছিল, এখনো বিএনপির একই অবস্থান বহাল রয়েছে। আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম, তিনি ন্যায়বিচার পাবেন, কিন্তু আইনজীবীরা বলেছেন, তিনি ন্যায়বিচার পাননি।”
এর আগে গত ২৯ জুলাই আপিল বিভাগের রায়ের পর বিএনপি বলেছিল, তারা মনে করে সাকা চৌধুরী ন্যায়বিচার পাননি। রায়ে তারা হতাশ, বিস্মিত হয়েছে। তাদের আশা ছিল, রায় পুনর্বিবেচনায় তিনি ন্যায়বিচার পাবেন।
খালেদা ফিরছেন
প্রায় দুই মাস পর বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া লন্ডন থেকে আগামীকাল শনিবার বিকেলে দেশে ফিরবেন। চোখের চিকিৎসার জন্য গত ১৫ সেপ্টেম্বর লন্ডনের উদ্দেশে ঢাকা ছেড়েছিলেন। সেখানে তিন সপ্তাহ অবস্থান শেষে তাঁর দেশে ফেরার কথা থাকলেও ইতিমধ্যে তা কয়েক দফা পেছানো হয়।
ব্যক্তিগত এই সফরে খালেদা জিয়া তাঁর বড় ছেলে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বাসায় অবস্থান করছেন। ছোট ছেলে প্রয়াত আরাফাত রহমানের স্ত্রী ও দুই মেয়েও সেখানে রয়েছেন।
দীর্ঘ দুই মাস অবস্থানকালে খালেদা জিয়া একান্ত পারিবারিকভাবেই সময় পার করেছেন। এ সময়ে তিনি তাঁর এক চোখের ছানি অপারেশন এবং হাঁটুর চিকিৎসা করিয়েছেন।