প্রাণভিক্ষার প্রশ্নে সময়ক্ষেপন, শনিবার রাতেই ফাইনাল
2015.11.20
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসির আদেশপ্রাপ্ত বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী ও জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রাণভিক্ষার আবেদন না করে সময় চেয়েছেন।
আইনজীবীরা ওই দুই আসামির সঙ্গে দেখা করতে চাইলেও কারা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এটা নিয়মের মধ্যে পড়ে না। কারা কর্তৃপক্ষের যুক্তি হচ্ছে, আইনি প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে বিধায় আইনজীবীর ভূমিকা আর নেই। এখন আসামিরা প্রাণভিক্ষা চাইতে পারেন, এ জন্য নিজেকে আবেদন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কারও সহায়তা দরকার নেই।
এই যুক্তিতে গতকাল শুক্রবার দিনে সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদের সঙ্গে তাঁর আইনজীবীদের সাক্ষাতের অনুমতি দেয়নি কারা কর্তৃপক্ষ।
শুক্রবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে সাকা চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আবার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে যান তাঁর দুই ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী ও ফায়াজ কাদের চৌধুরী। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন দুই আইনজীবী। তবে তাঁদেরও দেখা করতে দেওয়া হয়নি সাকা চৌধুরীর সঙ্গে।
কারা সূত্র বলছে, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে জেলকোড প্রযোজ্য হবে না, যেখানে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার সময় সাত থেকে ২১ দিন নির্দিষ্ট করে দেওয়া আছে। এর আগে এ ধরনের মামলার রায় কার্যকরে যৌক্তিক সময় দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন আদালত।
এদিকে কারা সূত্রগুলো জানিয়েছে, গতকাল ছুটির দিনেও কারাগারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আইন মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছেন। ফাঁসি কার্যকরের আগে নিয়ম–কানুন ও প্রস্তুতির বিষয়গুলো তাঁরা খুঁটিয়ে দেখছেন।
আজ শনিবার রাতে তাদের ফাঁসি কার্যকর হতে পারে বলে সরকারের বিভিন্ন সূত্রে আভাস পাওয়া গেছে।
বিএনপি ও জামায়াতের প্রভাবশালী এই দুই নেতার ফাঁসি সামনে রেখে দেশজুড়ে এক ধরনের উদ্বেগ–উৎকন্ঠা ও চাপা উত্তেজনা আছে। রাজধানী ঢাকার নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবার শহর ছিল অনেকটাই ফাঁকা।
“সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর করা নিয়ে দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি বা নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই,” জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, যিনি গতকাল সকালে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন।
তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের রায় কার্যকর করা নিয়ে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি অবনতি হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। সর্বোচ্চ আদালত যে রায় দিয়েছেন, সেই রায় অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
কারাগারের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা গতকাল জানান, বৃহস্পতিবার রাতেই সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদকে রায় পড়ে শোনানো হয়েছে। তাঁরা প্রাণভিক্ষার আবেদন করবেন কি না, সে ব্যাপারে জানতে চাইলে তাৎক্ষণিক কোনো সিদ্ধান্ত দেননি, সময় নিয়েছেন।
এরপর গতকাল শুক্রবার দুপুরের আগে তাদের কাছে আরও একবার এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। তখনো তাঁরা কোনো সিদ্ধান্ত দেননি।
দুই যুদ্ধাপরাধী প্রাণভিক্ষা চাইবেন কি না, সে প্রশ্নের কোনো জবাব এখনও পাননি বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল । এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে শুক্রবার একাধিক গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, “এখনও আমার কাছে কিছু আসেনি ।”
মুজাহিদ ও সালাউদ্দিনের রিভিউ আবেদন খারিজের রায় বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌঁছানোর পর থেকে সেখানে ভিড় করে আছেন সাংবাদিকরা।
“ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত দুজনের কেউই প্রাণভিক্ষার আবেদন করবেন কি না, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেননি,” সাংবাদিকদের জানান কারা উপ মহাপরিদর্শক গোলাম হায়দার।
গত বুধবার সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদের করা ফাঁসির রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন খারিজ করে দেন সর্বোচ্চ আদালত। বৃহস্পতিবার সেই রায়ের অনুলিপি কারাগারে পৌঁছে।
কারা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ফাঁসি কার্যকরের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন। ফাঁসির মঞ্চ, দড়ি, জল্লাদ, চিকিৎসক সবই তৈরি।
রাষ্ট্রপতির কাছে করা আবেদনের সিদ্ধান্ত কারাগারে আসার পরে যে কেনো সময় ফাঁসি কার্যকর করা যাবে। তবে তাঁরা রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন না করার সিদ্ধান্ত দিলে সেই সিদ্ধান্ত কারা কর্তৃপক্ষ জানার পরে যেকোনো সময়ই ফাঁসি কার্যকর করতে পারে।
কারাগারের সামনে আইনজীবী
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে সাকা চৌধুরীর দুই আইনজীবী গতকাল আবেদনপত্র হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ওই আবেদনপত্রে তাঁরা সাকা চৌধুরীর সঙ্গে সাতজন আইনজীবীর সাক্ষাতের অনুমতি চান।
দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কারাগারের সামনে দাঁড়িয়ে থেকেও আবেদনপত্র জমাই দিতে পারেননি তাঁরা।
“সারা দিনে তিনবার সাকা চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে দেখা করার জন্য আবেদন নিয়ে কারাগারে গিয়েছি। প্রত্যেকবার আমাদের জানানো হয়েছে, কোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নেই, জানান আইনজীবী হুজ্জাতুল ইসলাম খান।
“আমরা গত বৃহস্পতিবারই দেখা করার জন্য আবেদন দিয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের দেখা করতে দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি। কেন দেওয়া হলো না, তার কোনো কারণও উল্লেখ করেনি কারা কর্তৃপক্ষ,” সাংবাদিকদের জানান মুজাহিদের আইনজীবী সাইফুর রহমান।
নুরেমবার্গ ট্রায়াল নিয়ে আলোচনা
দুই যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি কার্যকর হওয়ার আগেভাগে গতকাল শুক্রবার ঢাকায় একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে এই ট্রায়াল নিয়ে সেমিনার আয়োজন করে।
এ সময় বলা হয়, নুরেমবার্গ ট্রায়াল হলো মানবতার সবচেয়ে বড় প্রতীক। প্যালেস অব জাসটিস হল বিচারহীনতার সংস্কৃতি দূর করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার অনুপ্রেরণা। বাংলাদেশসহ দেশে দেশে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নুরেমবার্গ ট্রায়ালের কাছে ঋণী হয়ে থাকবে।
নুরেমবার্গ ট্রায়ালের ৭০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এক সেমিনারে গতকাল শুক্রবার বক্তারা এ কথা বলেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে জার্মানির বাভারিয়া অঙ্গরাজ্যের নুরেমবার্গ শহরে ইতিহাসের অন্যতম যুদ্ধাপরাধের বিচার অনুষ্ঠিত হয়। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সমন্বয়ে মিত্র বাহিনী জার্মানির নাৎসি বাহিনীর নেতাদের বিচার করে। নুরেমবার্গের প্যালেস অব জাসটিসে প্রতিষ্ঠিত ওই আদালতে বিচার শুরু হয় ১৯৪৫ সালের ১৯ নভেম্বর।
সেমিনারের মূল বক্তা আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অব জুরিস্ট, কানাডা চ্যাপ্টারের সাবেক প্রেসিডেন্ট অ্যাটর্নি উইলিয়াম পি স্লোয়ান বলেন, “বিচারহীনতার সংস্কৃতি যত দিন থাকবে, তত দিন গণতন্ত্র অর্থবহ হবে না। নুরেমবার্গ ট্রায়াল বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে দূর করার অন্যতম দৃষ্টান্ত। বাংলাদেশ বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।”
সেমিনারের প্রধান অতিথি জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরিন শারমিন চৌধুরী বলেন, “নুরেমবার্গ ট্রায়াল ছিল মানবতার সবচেয়ে বড় পথপ্রদর্শক। যখন ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন সংসদে বিল আকারে উত্থাপন করা হয়েছিল, তখন প্রখ্যাত আইনজীবী সিরাজুল হক বলেছিলেন, এ আইন নুরেমবার্গ ট্রায়ালের চেয়েও একধাপ এগিয়ে। ন্যুরেমবার্গে আপিলের সুযোগ ছিল না, এখানে সে সুযোগ রাখা হয়েছে।”
“১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন নুরেমবার্গ ট্রায়ালের অনুপ্রেরণা থেকেই এসেছে। ওই বিচারকে সামনে রেখে বাংলাদেশের বিচার আরও শক্তিশালী রূপ পেয়েছে,” সেমিনারে জানান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।