জাকাতের কাপড় নিতে গিয়ে পদপিষ্ট হয়ে মারা গেলেন ২৭ নারী-শিশু
2015.07.10

ভোরের আলো ফোটার আগেই কিছু দুঃস্থ ও হতদরিদ্র মানুষ ছুটে গিয়েছিল জাকাতের কাপড়ের আশায়। কিন্তু আলো ফুটতেই তাদের ভাগ্যে জুটেছে কাফনের কাপড়।
শুক্রবার ভোর ৫টার দিকে বাংলাদেশের ময়মনসিংহ পৌরসভা কার্যালয়ের কাছে অতুল চক্রবর্তী রোডে নূরানী জর্দা কারখানার ফটকে জাকাতের কাপড় নিতে এসে লাশ হয়ে ফিরেছেন ২৭ জন নারী ও শিশু এবং আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক। কোতয়ালী থানার ওসি কামরুল ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
স্থানীয়রা জানান, নূরানী জর্দা কারখানার মালিক শামীম তালুকদার প্রতি বছরই জাকাত দেন। এবারও সেজন্য গত কয়েক দিন এলাকায় মাইকিং করা হয়। জাকাত নিতে আসার জন্য এক ধরনের কার্ডও বিতরণ হয়েছিল। সে অনুযায়ী কাপড় সংগ্রহ করতে মধ্যরাত থেকেই শামীমের চারতলা কারখানা ও বাসার সামনে ভীড় জমান আশেপাশের বস্তির হাজারো দুস্থ বাসিন্দা। কিন্তু সেহেরির পরপর নূরানী কারখানার বন্ধ ফটকে বাড়তে থাকে অস্থিরতা। ভিড়ের চাপে অতিষ্ট হয়ে অনেকেই চিৎকার করে গেইট খুলে দিতে বলেন।
শেষ পর্যন্ত বড় ফটকের সঙ্গে লাগোয়া ছোট ফটক খুলে দিতেই সবাই হুড়মুড় করে ঢোকার চেষ্টা করেন। এই হুড়োহুড়ি সামাল দিতে না পেরে ফটকের ভেতরে লাঠিপেটা শুরু করেন কারখানার কর্মচারীরা। ধাক্কাধাক্কিতে কয়েকজন পড়ে গেলে তাদের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েন আরও অনেকে। পদপিষ্ট হয়ে ঘটনাস্থলেই প্রাণ যায় বয়ষ্ক নারী ও শিশুর।
ওসি কামরুল বলেন, “অতিরিক্ত মানুষের ভিড়ের কারণে সেহরির পর কারখানার গেইট খোলার সঙ্গে সঙ্গে বহু নারী-পুরুষ একসঙ্গে ঢোকার চেষ্টা করে। এতে ধাক্কাধাক্কি শুরু হয় এবং এক পর্যায়ে পদদলিত হয়ে হতাহতের ঘটনা ঘটে।”
শুক্রবার ভোরে ওই বাড়িতে জাকাতের কাপড় আনতে যাওয়াদের একজন আনোয়ারা বেগম বেনারকে বলেন, “ভোর হওয়ার আগেই ওই বাড়ির সামনে তিনটি লাইনে মানুষের ভিড় জমে যায়। একপর্যায়ে ওই বাড়ির দারোয়ান এসে দুই পাশ থেকে বাঁশ বেঁধে দেন। তারা কাপড় নিতে আসা ব্যক্তিদের একটি লাইনে আসতে বলেন। ভোর পাঁচটার দিকে ওই বাড়ির প্রবেশ ফটক খুলে দেওয়া হয়। এ সময় হুড়োহুড়ি করে বাড়ির ভেতর ঢুকতে গিয়ে অনেকে পড়ে গেলে এই পদদলিত হওয়ার ঘটনা ঘটে।”
ভোরের আলো ফুটতে ফুটতেই রিকশা ও ভ্যানে করে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছাতে থাকে লাশের পর লাশ। ময়মনসিংহ মেডিকেলের চিকিৎসক ফাহাদ হোসেন জানান, হাসপাতালে নেওয়া লাশগুলোর মৃত্যু হয়েছে ভিড়ের চাপে শ্বাসরোধ হয়ে।
ইসলামে জাকাত দেওয়া ফরজ হলেও এভাবে আগে থেকে মাইকিং করে জাকাত দেওয়া সঠিক নয় বলে মন্তব্য করেছেন ইসলামী চিন্তাবিদরা। এ বিষয়ে মাওলানা মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ বেনারকে বলেন, “জাকাত দিতে হবে জাকাতের হকদার ব্যক্তির কাছে গিয়ে। কারণ, ইসলামে দান করার উপর যেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে তেমন সে বিষয়টি যথাসম্ভব গোপনে করার কথাও বলা আছে।”
হত্যা মামলা, গ্রেপ্তার ৮
এদিকে অকারণে প্রাণের অপচয়ের এ ঘটনায় ফুঁসে উঠেছেন ময়মনসিংহবাসী। জাকাতদাতা নূরানী জর্দা কারখানার মালিক শামীম তালুকদারকেই এ ঘটনায় দায়ী করছেন সবাই। একই সঙ্গে নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকা ও জাকাতপ্রার্থীদের হুড়োহুড়িকেও দায়ী করেন অনেকে। ঘটনার পরপরই নূরানী জর্দা কারখানার মালিক ও তার ছেলে হেদায়েত হোসেন তালুকদারসহ আটজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সন্ধ্যায় কোতোয়ালি মডেল থানায় তাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করা হয় বলে ওসি কামরুল ইসলাম জানান।
আটকৃত অন্যান্যরা হলেন কারখানার ম্যানেজার ইকবাল হোসেন, শামীমের আত্মীয় আরমান হোসেন, আলমগীর হোসেন, কারখানার কর্মচারী শামসুল ইসলাম আবদুল হমিদ ও গাড়ি চালক পারভেজ।
ওসি কামরুল বেনারকে বলেন, “আসামিদের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে মামলার এজাহারে।
ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোস্তাকিম বিল্লাহ ফারুকী জানান, “কার্ড বিলি করে জাকাত দেয়ার খবর পুলিশ প্রশাসন বা জনপ্রতিনিধিদের জানাননি মালিক। পুরো ঘটনা খতিয়ে দেখে যথাযথ ব্যবস্তা নেয়া হবে।”
তদন্ত কমিটি
এদিকে এ ঘটনার কারণ খতিয়ে দেখতে পুলিশ সদর দপ্তর ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে।
ঢাকা জেলার অতিরিক্ত ডিআইজি শফিকুল ইসলামকে প্রধান করে গঠিত পুলিশ সদর দপ্তরের তিন সদস্যের কমিটিকে পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
আর ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসনের ১ সদস্যের তদন্ত কমিটির দায়িত্ব পেয়েছেন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মল্লিকা খাতুন। তাকে তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে হবে।
ইতোমধ্যে পুলিশের তদন্ত কমিটির সদস্যরা ময়মনসিংহে পৌঁছে কাজ শুরু করেছেন। তারা দুপুরে ঘটনাস্থলে গিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের বক্তব্যও শুনেছেন।
নিহত যারা
নিহতদের মধ্যে ২২ জনের পরিচয় জানা গেছে। এরা হলেন- ময়মনসিংহ শহরের চরপাড়ার হায়দার আলীর স্ত্রী হালিমা বেগম (৪৫), আকুয়া মোড়লপাড়ার জালাল উদ্দিনের স্ত্রী নাজমা বেগম (৫০),আব্দুস সালামের স্ত্রী ফাতেমা বেগম (৫৫) ও ইসমাইলের স্ত্রী জোহরা খাতুন (৪০), কাঠগোলা বাজারের আব্দুল মজিদের স্ত্রী রেজিয়া আক্তার (৪০), আকুয়া দক্ষিণপাড়ার রবি হোসেনের স্ত্রী ফাতেমা বেগম (৪২), চরঈশ্বরদিয়ার লাল মিয়ার স্ত্রী সুফিয়া বেগম (৬০), থানাঘাটের আব্দুস সালেকের স্ত্রী খোদেজা বেগম (৫০), ব্রহ্মপুত্র বাস্তুহারা বিহারি ক্যাম্পের সিরাজুল ইসলামের ছেলে সিদ্দিক (১২), সখিনা বেগম (৪০), মেয়ে লামিয়া (৫), আব্দুল বারেকের স্ত্রী সামু বেগম (৬০), কাচারিঘাটের মাহতাব উদ্দিনের স্ত্রী ফজিলা বেগম (৭৫), পাটগুদাম বিহারি ক্যাম্পের লালু মিয়ার স্ত্রী হাজেরা বেগম (৭০), শহরের মৃত্যুঞ্জয় স্কুলরোড বসাকপট্টির গোবিন্দ বসাকের স্ত্রী মেঘনা বসাক (৩৫), তারাকান্দা উপজেলার মালিডাঙ্গা গ্রামের মোসলেমের স্ত্রী মরিয়ম (৫০), শহরের ধোপাখলার মৃত সুলতানের স্ত্রী জামিনা খাতুন (৬৫), গরেন্দ্রের স্ত্রী রিনা রানী (৬০), নারায়ণ চন্দ্র সরকারের স্ত্রী সুধা রানী সরকার, নাজমা আক্তার (৬০), সদর উপজেলার খাদিজা খাতুন (৫৫) ও বৃষ্টি রানী (১২)।
জাকাতে পুলিশের সাহায্য নেওয়ার আহবান
এদিকে জাকাত দেওয়ার সময় যেকোনো দুর্ঘটনা এড়াতে প্রয়োজনে স্থানীয় পুলিশের সহযোগিতা নিতে জাকাত দাতাদের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়।
দুর্ঘটনায় লোক হতাহতের ঘটনা মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টিগোচর হয়েছে জানিয়ে শুক্রবার ওই বিবৃতিতে বলা হয়, এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে স্থানীয় পুলিশের সহযোগিতা নিতে হবে। পুলিশ প্রশাসনকেও এ ধরনের বিতরণ কাজে সহযোগিতা করার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করা হয়েছে।
এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে জাকাত দেওয়া বা বড় জনসমাবেশের কমপক্ষে একদিন আগে পুলিশকে তথ্য দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন আইজিপি একেএম শহীদুল হক।
ময়মনসিংহের এ ঘটনায় রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।
এর আগে ২০১২ সালে রাজধানীর ফকিরেরপুলে সাবেক এক আওয়ামী লীগ নেতার মার্কেট ও আবাসিক হোটেলের সামনে জাকাতের কাপড় নিতে গিয়ে পদদলতি চার নারীর মৃত্যু হয়।