স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ৩৩ শতাংশ নারী প্রার্থী দেওয়ার প্রস্তাব
2015.11.05
সামাজিক নানা বাধা পেরিয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগিয়ে গেলেও রাজনৈতিক কর্মকান্ডে উল্লেখযোগ্য হারে বাড়েনি বাংলাদেশের নারীদের অংশগ্রহণ। আর এর জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছার অভাবকেই দায়ী করছে সংশ্লিষ্টরা।
তারা বলছে, এদেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে বিরোধী দলীয় নেতা, স্পিকার, সংসদ উপনেতা সকল পদে নারী অধিষ্ঠিত হলেও রাজনৈতিক দলগুলোতে নারীরা এখনো বৈষম্যের শিকার। এখনো রাজনৈতিক দলের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে নারীদের তেমন অংশগ্রহণ নেই। ইউনিয়ন থেকে জেলা পর্যায় পর্যন্ত প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যনির্বাহী কমিটিগুলোতে নারী আছেন মাত্র ১ থেকে ২ শতাংশ ।
অথচ নির্বাচন কমিশনের গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী, ২০২০ সালের মধ্যে দলের সব কমিটিতে কমপক্ষে ৩৩ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। সে লক্ষ্যে পৌঁছুতে তাই এখনই স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে চেয়ারম্যান ও সাধারণ আসনে ৩৩ শতাংশ নারী প্রার্থী মনোনয়নের দাবি তুলেছে বিভিন্ন সংগঠন ও নারী নেত্রীরা।
রাজধানীতে আয়োজিত সুইস এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কো-অপারেশনের (এসডিসি) সহায়তায় পরিচালিত অপরাজিতা কার্যক্রমের অভিজ্ঞতা বিনিময় এবং নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন: জেন্ডার সংবেদনশীল গভর্নেন্স এবং সার্ভিসেস বিষয়ক জাতীয় সেমিনারে এমন দাবি উঠে আসে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে ইতিবাচক মত দেন সরকারের মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রী।
সেমিনারে বলা হয়, নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেলে স্থানীয় সরকার এবং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের শাসন প্রক্রিয়া এবং সেবাসমূহ হয়ে ওঠে জেন্ডার সংবেদনশীল ও গণমুখী। তাই আগামী স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে চেয়ারম্যান ও সাধারণ আসনে অন্তত ৩৩ শতাংশ নারী প্রার্থী মনোনয়ন নিশ্চিত করতে রাজনৈতিক দলগুলোর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
প্রধান বাধা রাজনৈতিক দলগুলো
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের শহরে নারীরাই শুধু নয়, গ্রামের নারীরাও অগ্রসর হয়েছে কয়েকগুন। শিক্ষিত তরুণীরা এখন চ্যালেঞ্জিং কাজে আগ্রহ প্রকাশ করছে। রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহনের জন্যও এগিয়ে আসছে। কিন্তু সেখানে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি।
এ বিষয়ে নারী নেত্রী মালেকা বানু বেনারকে বলেন, নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন তার মানবিক অধিকার। এই অধিকার প্রতিষ্ঠায় রূপান্তর ঘটাতে হবে। এজন্য সংখ্যাগত নয় গুণগত পরিবর্তন করতে হবে। তবে নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বাড়াতে প্রধান বাধা দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি। দেশের প্রধানমন্ত্রী নারী হলেও এদেশের রাজনীতির সিস্টেম পুরুষ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। সব ক্ষেত্রে পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। কিন্তু নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন এখন সময়ের দাবি।
তাঁর মতে, তাই নির্বাচন কমশিনের আরপিও অনুযায়ী, প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলকে তাদের এক তৃতীয়াংশ আসন নারীদের জন্য বরাদ্দ করতে হবে। সংরক্ষিত আসনে নয়, সাধারণ আসনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসুক নারীরা। এজন্য রাজনৈতিক দলগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি ঠিক করতে হবে।
রাজনৈতিক বাধার পাশাপাশি নারীদের অর্থনৈতিক বাধা আছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। আর ধর্মীয় বাধা থাকলেও বাংলাদেশের নারীরা সে বাধা জয় করছে বলে মনে করেন মালেকা বেগম।
তবে এ বিষয়ে বাংলাদেশ আ.লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির মহিলা বিষয়ক সম্পাদক ও সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাংসদ ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা বলেন, নারীর ক্ষমতায়ন শুধু একটা দলের কাজ নয় অথবা একটি দলের পক্ষেও সম্ভব নয়। নারীর প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে।
আর সরকার দলীয় সংসদ সদস্য ছবি বিশ্বাস বলেন, নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন, রাজনৈতিকভাবেই অর্জন করতে হবে।
নারী নেত্রীরাও ভূমিকা রাখতে পারছে না
মালেকা বানু বলেন, নারীরা সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসীন হলে সংবিধানের কাছে তাদের জবাবদিহিতা থাকবে। সংরক্ষিত আসনে মনোনীত হলে তাদের দায়বদ্ধতা থাকে দলের প্রতি। এখন যেমন সংরক্ষিত আসনে থাকা নারী নেত্রীরা নারী ইস্যুতেও দলের বিরুদ্ধে কোন কথা বলতে পারেন না।
আশা করেছিলাম, সংসদে থাকা নারীরা এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবেন, কিন্তু তাদের কাছ থেকে আশানুরুপ সাড়া আমরা পাইনি। তবে তৃণমূলের নারীরা এখন সাধারণ আসনে মনোনয়ন পেতে প্রস্তুত। সংরক্ষিত আসনে মনোনীতরাও সরাসরি নির্বাচিত হয়ে আসতে চাইছেন। তাদের সাহসের অভাব নেই, প্রয়োজন শুধু সিস্টেমের। সেটা করতে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যমত প্রয়োজন।
নারীকে পেছাতে ‘শব্দ সন্ত্রাস’
আরেক সংরক্ষিত আসনের নারী সাংসদ অ্যাডভোকেট ফজিলাতুন্নেছা বাপ্পি বেনারকে বলেন, তৃণমূল থেকেই নারীরা যোগ্যতার স্বাক্ষর দিয়ে উঠে আসছে। তবে সেইসঙ্গে নারী নেতৃত্বকে মেনে নেওয়ার মত মানসিকতা সমাজে তৈরি হতে হবে।
নারীকে অগ্রসরতাকে টেনে ধরতে সমাজে এক ধরনের শব্দ সন্ত্রাসও চলছে বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, যখন দুজন নারীর কোন বিষয়ে তর্কে জড়িয়ে পড়ে তখন সেটাকে ‘চুলোচুলি’ বলে সংজ্ঞায়িত করা হয়। অথচ একই বিষয়ে দুজন পুরুষের তর্ককে স্বাভাবিকভাবেই দেখছে সমাজ। এটা নারীর বিরুদ্ধে শব্দ সন্ত্রাস। এধরনের নানা শব্দ ব্যবহার করে নারীকে পিছিয়ে দেওয়া হয়।
৩৩ শতাংশ আসনের সঙ্গে একমত সরকারের প্রতিমন্ত্রী
এদিকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে চেয়ারম্যান ও সাধারণ আসনে অন্ততঃ ৩৩ শতাংশ নারী প্রার্থী মনোনয়নের দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন নারী ও মহিলা বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি। তবে এ বিষয়ে তিনি বিশেষ কোন অঙ্গীকার তিনি করেননি।
চুমকি বলেন, নারী ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে নারীকে রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতা দিতে হবে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধি মনোনয়ন দেওয়ার বিষয়ে সরকার রাজনৈতিক দল এবং বেসরকারি সংস্থাসহ সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।
নারীর অগ্রগতির কথা তুলে ধরে চুমকি বলেন, “যে দেশে মুক্তমনাদের হত্যা করা হয় সে দেশে নারীর ক্ষমতায়ণের বর্তমান অগ্রগতি একটি বিস্ময়। বাধার দেয়াল ভেঙে বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ণের ট্রেন এগিয়ে যাচ্ছে। শিগগিরই তা গন্তব্যে পৌঁছুবে"।