বিদেশে শ্রমিক নিয়োগে সংকট, প্রবাসী আয় কমে আসছে

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2016.03.16
BD-worker প্রবাসে শ্রমিক রপ্তানি নিয়ে এক ধরনের সংকটে পড়েছে বাংলাদেশ।
অনলাইন

বড় বড় শ্রম বাজারগুলো উন্মুক্ত না হওয়া, রেমিটেন্সের প্রবাহ কমে আসা এবং তারই সঙ্গে হঠাৎ করে মালয়েশিয়া ১৫ লাখ শ্রমিক নেওয়ার চুক্তি বাতিল করায় শ্রমিক রপ্তানি নিয়ে এক ধরনের শঙ্কায় পড়েছে বাংলাদেশ। এ সংকট উত্তোরনের পথ খুঁজতে কিছুটা নাজেহাল অবস্থায় পড়েছে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়।

যদিও বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমাকেই রেমিটেন্স কমে আসার কারণ বলে ব্যাখ্যা করছে সরকার। তবে বিশ্লেষকরা একইসঙ্গে দক্ষ শ্রমিকের অভাব ও বৈধ শ্রম বাজার কমে আসাকেও দায়ী করছেন। এমন পরিস্থিতি বাংলাদেশ শ্রম রপ্তানির জন্য ‘সংকটময়’ বলে অভিহিত করেছেন অনেকেই।


খোলেনি বড় বাজারগুলো

সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বাংলাদেশের বৃহত্তম শ্রমবাজারগুলো বৃহৎ আকারে উন্মুক্ত হয়নি। ২০০৮ সাল থেকে ব্যাপকভাবে বাংলাদেশি শ্রমিক নেওয়া বন্ধ করে সৌদি সরকার। তবে বছর খানেক আগে শুধু মাত্র নারী শ্রমিক নেওয়ার আগ্রহ দেখায় দেশটি। সৌদির চাহিদামত না পারলেও নারী শ্রমিক পাঠাচ্ছে বাংলাদেশ। এরই সঙ্গে পুরুষ শ্রমিক নেওয়ার দাবি তোলে বাংলাদেশ। তাই খানিকটা বাধ্য হয়েই প্রতিটি নারী শ্রমিকের সঙ্গে তার একজন পুরুষ আত্মীয়কে নিতে সম্মত হয় সৌদি। তবে ব্যাপক হারে নারী পাঠাতে না পারায় সেটিও কার্যকর হচ্ছে না।

অন্যদিকে ২০১২ সাল থেকে বন্ধ রয়েছে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রম বাজার সংযুক্ত আরব আমিরাত। নানা কূটনৈতিক চেষ্টার পরেও খোলেনি বাজারটি। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশটি সফর করার পরেও বাংলাদেশি শ্রমিকদের বিষয়ে নরম হয়নি আমিরাত সরকার। দিন দিন যেন তাদের কঠোরতা বেড়েই চলেছে। বর্তমানে বাংলোদেশিদের জন্য আমিরাতের শ্রমিক ভিসাসহ ব্যবসা, টুরিস্ট এমনকি ট্রানজিট ভিসাও বন্ধ রয়েছে।

তবে বর্তমানে মধ্যপাচ্যের দেশ ওমানই বাংলাদেশের শ্রমিক টানছে।  ২০১৫ সালে দেশটিতে গিয়েছে এক লক্ষ ২৯ হাজার ৮৫৯ জন বাংলাদেশি শ্রমিক। এটাই এ বছরের একক কোনো দেশে যাওয়া সর্বোচ্চ সংখ্যা।

এছাড়া কাতারেও শ্রমিক যাওয়া অব্যাহত রয়েছে। তবে বাজারটিতে আরো বেশি শ্রমিক পাঠানোর বিষয়ে কূটনৈতিক আলোচনা চলছে। শিঘ্রই দুদেশের মধ্যে ভিভিআইপি সফরও হতে পারে বলে জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র।


হঠাৎ চুক্তি বাতিল মালয়েশিয়ার, হতাশ বাংলাদেশ

আগামী তিন বছরে বাংলাদেশ থেকে ১৫ লাখ শ্রমিক নেওয়ার যে ঘোষণা অনুযায়ী বাংলাদেশের সঙ্গে সরকারি-বেসরকারিভাবে শ্রমিক নেওয়ার চুক্তি হয়, চলতি মাসে হঠাৎ করেই সে চুক্তি বাতিল করে দেশটি। শ্রমিক পাঠানোর প্রস্তুতি যখন প্রায় শেষ পর্যায়ে তখন মালয়েশিয়ার এ ধরনের সিদ্ধান্তে খানিকটা হতাশ হয়ে পড়ে বাংলাদেশ।

গত শনিবার মালয়েশিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রী আহমদ জাহিদ হামিদিকে উদ্ধৃত করে দেশটির রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা বারনামা জানায়, মালয়েশিয়া বিদেশি শ্রমিক নেওয়া বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে তিনি বিদেশি শ্রমিক নিয়োগ দিতে আগ্রহীদের দেশে থাকা অবৈধ বিদেশি শ্রমিকদের কাজে নেওয়ার নির্দেশনা দেন।

জাহিদ হামিদি সাংবাদিকদের বলেন, “তারা (নিয়োগকর্তা) সিক্স-পি কর্মসূচির (অবৈধ অভিবাসীদের পুনর্বাসনে নেওয়া সমন্বিত কর্মসূচি) আওতায় নিবন্ধিত নয়, এমন শ্রমিকদেরও নিয়োগ দিতে পারবেন।”

এই কর্মসূচির আওতায় আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত বিদেশি শ্রমিকদের কাজে নিতে নিবন্ধনের জন্য সুযোগ দিয়েছে মালয়েশিয়া সরকার। এই সময়ের পর যে সকল নিয়োগকর্তা অবৈধ শ্রমিকদের আশ্রয় দেবেন তাদের বিরুদ্ধে কড়াকড়িভাবে আইন প্রয়োগ করার হুশিয়ারিও দেন তিনি।

এর আগে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ থেকে সম্ভাব্য ১৫ লাখ শ্রমিক নিতে সমঝোতা স্মারকে সই করে দুইদেশ। পাঁচটি খাতে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের সমন্বয়ে শ্রমিক নেওয়ার এ পদ্ধতি ‘জিটুজি প্লাস’ নামে পরিচিতি পায়। তবে এর পরদিনই দেশটির উপ প্রধানমন্ত্রী বিদেশি কর্মী নেওয়া বন্ধের ঘোষণা করেন।

এদিকে দীর্ঘদিন পরে মালয়েশিয়ার বাজার উন্মুক্ত হওয়ার খবরে বিদেশ গমনেচ্ছুকরা যেন হাফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন। এবার আবারও বাজারটি বন্ধ হওয়ায় হতাশ হয়ে পড়েন তারা। অনেকেই বিভিন্ন রিক্রুটিং এজেন্সির কাছে টাকা জমা দিয়েছেন। অনেক এজেন্সি আবার  মালয়েশিয়ার বিভিন্ন রিক্রুটিং এজেন্সির সঙ্গেও শ্রমিক নেওয়ার বিষয়ে লেনদেন করেছেন। এসব অর্থ ফেরত পাওয়া বা ব্যবসা নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছেন তারা।

বাগেরহাটের ইলিয়াস হোসেন এমনই একজন। তিনি বেনারকে বলেন, “মালয়েশিয়ার বাজার খোলার খবর পেয়ে স্থানীয় এক দালালের কাছে তিন লাখ টাকা জমা দেই। প্রথম দলেই দেশটিতে যাওয়ার বিষয়ে আশ্বাস পেয়েছিলাম। আরও দেড়লাখ টাকা যাওয়ার আগে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলাম। তবে কয়েকদিন হল শুনছি মালয়েশিয়া চুক্তি বাতিল করেছে। এরপর থেকে ওই দালালকে আর খুজে পাচ্ছি না। তার ফোনও বন্ধ পাচ্ছি। এমন পরিস্থিতিতে আমার সম্পদ বিক্রি করে তাকে দেওয়া টাকা ফেরত পাব কিনা সে বিষয়ে দুঃচিন্তায় রয়েছি। এখন আমি শুধু টাকা ফেরত চাই।”


কমেছে রেমিটেন্স

এদিকে হঠাৎ করেই দেশে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের পরিমাণ কমছে।  বিশ্ববাজারে তেলের দর পতন আর মার্কিন ডলারের বিপরীতে অন্যান্য মুদ্রার মান কমাকে এর কারণ বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পাওয়া পরিসংখ্যাণে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের  (২০১৫-২০১৬) প্রথম আট মাসে অর্থাৎ জুলাই-ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত  প্রবাসী আয় আসে  ৯৭৭ কোটি ডলার। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১ দশমিক ৫২ শতাংশ কম। এছাড়া সর্বশেষ ফেব্রুয়ারি মাসে তার আগের বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের তুলনায় ৪ শতাংশ রেমিটেন্স কম আসে।

এর কারণ ব্যাখ্যা করে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের মহাব্যবস্থাপক কাজী ছাইদুর রহমান বলেন, “বিশ্ব বাজারে তেলের দাম কমায় ডলারে মূল্যও কমেছে। আর এ কারনে অনেকেই অর্থ পাঠাননি। তবে আগামী রোজার ঈদ সামনে রেখে প্রবাসীরা বেশি রেমিটেন্স দেশে পাঠাবেন। আর সে কারণেই মে-জুন মাসে রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়বে”।


চুক্তি বাতিলের বিষয় আনুষ্ঠানিকভাবে জানেনা বাংলাদেশ

মালয়েশিয়ার উপ প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেওয়ার বিষয়ক চুক্তি বাতিলের ঘোষণা দিলেও এ বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি বলে দাবি করছে বাংলাদেশ।

এ বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব বেগম শামছুন্নাহার বেনারকে বলেন, “এখন পর্যন্ত মালয়েশিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে চুক্তি বাতিলের বিষয়টি বাংলাদেশকে জানায়নি। বিষয়টি জানার পরেই গণমাধ্যমকে বিস্তারতি জানানো হবে।”

তবে জনশক্তি রপ্তানিকারকরা বলছেন, দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরের পরেও একটি দেশ হঠাৎ করেই চুক্তি বাতিল করল, আর সেটি অপর পক্ষ (বাংলাদেশ) জানতেই পারল না, এটা মেনে নেওয়া কঠিন। এটা অদক্ষ কূটনীতির প্রমাণ।


‘সংকট চলছে’

বড় বাজার না খোলা, হঠাৎ মালয়েশিয়ার চুক্তি বাতিলসহ শ্রম বাজারের বর্তমান চিত্রকে সংকট বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ সংকট কাটাতে সকলকে একসঙ্গে কাজ করার উদ্যোগ নিতে হবে, পরামর্শ তাদের।

এ বিষয়ে বেসরকারিভাবে জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বায়রা’র সিনিয়র সহসভাপতি বেনারকে বলেন, “এটা সত্যি একটা সংকট চলছে। তবে এটা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এর জন্য সকলকে একসঙ্গে দেশের স্বার্থে কাজ করতে হবে। বড় বাজারগুলো খোলার বিষয়ে উদ্যোগী হতে হবে।”

মালয়েশিয়ার চুক্তির বিষয়ে খুব বেশি মন্তব্য করতে না চেয়ে তিনি বলেন, “হঠাৎ করে চুক্তি বাতিল নিঃসন্দেহে হতাশার বিষয়। তবে ওই চুক্তিটির মধ্যে কিছুটা ধোঁয়াশা ছিল।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।