সফরে আসছেন চীনের প্রেসিডেন্ট, সম্পর্কের নতুন দ্বার উন্মোচনের প্রত্যাশা
2016.10.11

আগামী ১৪ অক্টোবর বাংলাদেশ সফরে আসছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। তাঁর এ সফরে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে সহযোগিতার নতুন দ্বার উন্মোচন করতে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি সই হবে। সরকারের বিভিন্ন সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
গত তিন দশকে কোনো চীনা প্রেসিডেন্টের এটাই প্রথম ঢাকা সফর। তাঁর এই সফর ঘিরে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এখন কর্মব্যস্ত সময় পার করছে। ইতোমধ্যে প্রস্তাবিত চুক্তির খসড়াগুলো চূড়ান্ত করেছে বাংলাদেশ।
এসব চুক্তির পাশাপাশি বিদ্যুৎ, জ্বালানিসহ অবকাঠামো খাতের বিভিন্ন প্রকল্পে বিনিয়োগে নতুন করে অর্থায়নে প্রতিশ্রুতি চাইবে ঢাকা। চীনের অর্থমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রীসহ বেশ কয়েকজন মন্ত্রী প্রেসিডেন্টের সফরসঙ্গী হিসেবে আসবেন।
তারিখ হিসেবে দুইদিনের হলেও ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের এই সফরের মাধ্যমে দুদেশের সম্পর্ক অনন্য এক উচ্চতায় পৌঁছাবে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা। এর আগে ২০১৪ সালে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঢাকা সফর করেছিলেন শি জিনপিং। ওই বছর ৬ থেকে ১১ জুন পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন সফর করেন।
চীনা প্রেসিডেন্টের ঢাকা সফরে দেশটির কাছ থেকে বড় সহযোগিতার প্রত্যাশা করছে ঢাকা। এ সফরকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে চীনও।
চীনের সরকারি পত্রিকা দৈনিক গ্লোবাল টাইমসের খবর অনুসারে, গত সোমবার বেইজিংয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে চীনের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী কং জুয়া নিউ প্রেসিডেন্টের ঢাকা সফরকে দুদেশের সম্পর্ক উন্নয়নের মাইলফলক বলে উল্লেখ করেন।
হতে পারে ৭৫ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি
চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সফরে মোটা অঙ্কের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি হতে পারে বলে নিশ্চিত করেছে কূটনৈতিক সূত্রগুলো। প্রস্তাবিত চুক্তিগুলোর খসড়াও প্রায় চূড়ান্ত। স্বাক্ষরিত হবে কয়েকটি সমঝোতা স্মারকও। এসবের পাশাপাশি বিদ্যুৎ, জ্বালানিসহ অবকাঠামোর বিভিন্ন খাতে অর্থায়নের বিষয়টি তাদের নজরে আনা হবে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এর মাধ্যমে দুদেশের সম্পর্ক আরও জোরদার করতে চায় চীন।
তবে চুক্তির সংখ্যা আর অর্থের পরিমাণ নিয়ে কোনও পক্ষ থেকেই নির্দিষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। তবে বাংলাদেশের গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, চীনের বিনিয়োগের অঙ্কটা হতে পারে প্রায় ৭৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। চুক্তি হতে পারে ২৫টি।
বাংলাদেশের অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্না্ন বেনারকে বলেন, “আশা করছি চীনের প্রেসিডেন্টের সফরে রেকর্ড পরিমাণ ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হবে।”
সরকারি সূত্রগুলো জানায়, চীনকে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগের প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে রেল খাতে। এখানে প্রকল্পের সংখ্যা পাঁচ, আর বিনিয়োগের প্রস্তাবের অঙ্ক ৫ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সাতটি প্রকল্পে ৫ দশমিক ২১ বিলিয়ন, সড়ক ও সেতু খাতের চারটি প্রকল্পে ৫ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
রপ্তানি বৃদ্ধি ও বিনিয়োগ আকর্ষণের মোক্ষম সুযোগ
বাংলাদেশের বাজারে প্রায় ১৪শ কোটি মার্কিন ডলারের চীনা পণ্য প্রবেশ করে। কিন্তু বাংলাদেশ রপ্তানি করে মাত্র ৮০ কোটি ডলার। অথচ চীনে বাংলাদেশের রয়েছে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা। সক্ষমতার অভাবই এ জন্য দায়ী বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডির অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক গোলাম মোয়াজ্জেম বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশে চীনের শীর্ষ ২০ রপ্তানি পণ্যের শেয়ার কমছে, নতুন নতুন পণ্য বাংলাদেশের বাজারে ঢুকছে। কিন্তু আমরা তা করতে পারিনি।”
সক্ষমতার এই অভাবের বিষয়টি স্বীকার করেছেন বানিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ।
তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা সকল প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠব। আগামী দুবছরে চীনে রপ্তানির পরিমাণ দুই বিলিয়ন ডলার ছাড়াবে।”
চীনের মতো বিরাট অর্থনীতির দেশের বিনিয়োগ আকর্ষণেও বাংলাদেশ যথেষ্ট সফল নয় বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। সরকারি হিসেব বলছে, গত বছর চীনের বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১১০ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে মাত্র ২৭ কোটি ডলার বাংলাদেশে এসেছে।
এ প্রসঙ্গে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশের অবকাঠামোগত সমস্যার কারণে চীন বিনিয়োগে উৎসাহী ছিল না। আলাদা ইকোনমিক জোন হলে বিনিয়োগ উৎসাহিত হবে। তবে এটা মধ্য মেয়াদি সমাধান।”
গত সোমবার চীনের প্রেসিডেন্টের সফর নিয়ে আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে বাণিজ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, “বিনিয়োগ আকর্ষণে চীনের জন্য আলাদা অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির পাশাপাশি অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও দেওয়া হবে।”
একই অনুষ্ঠানে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ভাইস চেয়ারম্যান ড. সাদিক আহমেদ বলেন, “চীনের ইমপোর্ট, ইনভেস্টমেন্ট ও ইনফ্রাস্ট্রাকচার মার্কেট থেকে কীভাবে আমরা আমাদের দেশে নিয়ে আসব, তার করণীয় গুরুত্ব দিয়ে ঠিক করতে হবে।”
সুদের হার নিয়ে প্রশ্ন
চীনের সহায়তা জরুরি হলেও ঋণের সুদের হার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতিবিদরা। এ ছাড়া বিরাট অঙ্কের মেগা প্রকল্পগুলোতে স্বচ্ছতা থাকাও খুবই জরুরি বলে মনে করেন তাঁরা।
তাঁদের মতে, ঋণের টাকা ফেরত দিতে হবে। সুতরাং প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীর গতি হলে এবং সুদের হার বেশি হলে সরকারকে ভুগতে হবে।
সিপিডির ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ওই বৈঠকে বলেন, “যেহেতু এখানে দেনা পরিশোধের বিষয় আছে, সে জন্য ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা খুব জরুরি।”