কুষ্টিয়ায় বাউল ভক্ত হোমিও চিকিৎসককে কুপিয়ে হত্যা
2016.05.20

এবার কুষ্টিয়ায় বাউল অনুসারী হোমিও চিকিৎসক মীর সানাউর রহমানকে (৫৫) কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এ সময় দুর্বৃত্তরা ওই চিকিৎসকের সঙ্গে থাকা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাইফুজ্জামানকে কোপালেও তিনি প্রাণে বেঁচে যান।
কুষ্টিয়া সদর উপজেলার শিশিরপাড়া মাঠের কাছে শুক্রবার এই ঘটনা ঘটে। পুলিশ বলছে, সাম্প্রতিক সময়ের অন্যান্য হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে এই হত্যাকাণ্ডের মিল রয়েছে।
এ বছরের জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত একই ধরনের ১৩টি ঘটনায় ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন; রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রেজাউল করিম, সমকামীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা জুলহাজ মান্নান ও তাঁর বন্ধু মাহবুব তনয়, রাজশাহীর স্থানীয় পীর শহীদুল্লাহ, টাঙ্গাইলের হিন্দু দর্জি নিখিল জোয়ারদার, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাজিমুদ্দিন, বান্দরবানের বৌদ্ধভিক্ষু দাম্মা ওয়াং চা প্রমুখ।
এঁদের প্রায় সবাইকে জবাই করে হত্যা করা হয় এবং প্রতিটি ঘটনায় আইএস বা অন্য জঙ্গি গোষ্ঠীর নামে দায় স্বীকার করা হয়। যদিও সরকার বলে আসছে দেশে আইএসের অস্তিত্ব নেই। শুক্রবার হোমিও চিকিৎসক হত্যার দায় কোনো জঙ্গিগোষ্ঠী রাত পর্যন্ত স্বীকার করেনি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্য বলেছেন, “বিচ্ছিন্ন যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, সেগুলো পরিকল্পিত। যুদ্ধাপরাধীর বিচার বানচালের ষড়যন্ত্রেই এসব ঘটানো হচ্ছে।”
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, যারা এ ধরনের কর্মকাণ্ড ঘটিয়েছে, তাদের এরই মধ্যে গ্রেপ্তার শুরু হয়েছে। তাদের অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি করা হবে। গত বৃহস্পতিবার রাতে বুলগেরিয়ায় বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ অবশ্য ব্লগার ও লেখক খুনের ঘটনায় নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সন্দেহভাজন ছয় সদস্যকে চিহ্নিত করে তাঁদের গ্রেপ্তারে তথ্য পেতে পুরস্কার ঘোষণা করেছে।
পুলিশ ও বিভিন্ন সংস্থার তথ্য, গত দুই বছরে পীর,বাউল, ব্লগার, শিক্ষক ও প্রকাশকসহ প্রায় দুই ডজন মানুষ হত্যা করা হয়েছে। সর্বশেষ কুষ্টিয়ার এই হত্যাকাণ্ডেও জঙ্গিদের হাত থাকতে পারে।
নিহত সানাউরের বাড়ি কুষ্টিয়া শহরের পূর্ব মজমপুরে। শিশিরপাড়া মাঠের কাছে তাঁর একটি বাংলো বাড়ি আছে। সেখানে দীর্ঘ ১০ বছর ধরে তিনি প্রতি শুক্রবার বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা দিয়ে আসছিলেন।
শিক্ষক সাইফুজ্জামান তাঁর বন্ধু। আশঙ্কাজনক অবস্থায় এই শিক্ষককে প্রথমে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে ও পরে দুপুরে হেলিকপ্টারে করে তাঁকে ঢাকায় নেওয়া হয়।
“দুর্বৃত্তের অস্ত্রের কোপে ছিন্ন হওয়া শিক্ষকের হাতের দুটি আঙুল ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে,” স্থানীয় সাংবাদিকদের জানান কুষ্টিয়া মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহাবুদ্দিন চৌধুরী।
সহকর্মীরা জানান, কুষ্টিয়া শহরের কালিশংকরপুরের এক বাসায় ভাড়া থাকতেন সাইফুজ্জামান। তিনি লেখাপড়া করেছেন বিশ্বভারতীতে।
হতাহত ব্যক্তিদের স্বজনেরা জানান, সানাউর ও সাইফুজ্জামান বাউল তত্ত্বের অনুসারী। বিনা মূল্যে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য মোটরসাইকেলে করে সানাউর ও সাইফুজ্জামান শিশিরপাড়া মাঠের কাছে সানাউরের বাংলো বাড়িতে যাচ্ছিলেন।
তাঁরা ওই বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছালে সকাল নয়টার দিকে মোটরসাইকেল আরোহী তিন ব্যক্তি তাঁদের পেছন থেকে কুপিয়ে জখম করে। সানাউর ঘটনাস্থলে মারা যান। সাইফুজ্জামানকে হাসপাতালে নেওয়া হয়।
“সানাউরের ঘাড়ের ওপরে ও মাথার পেছনে চার থেকে পাঁচটি আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। তাতেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে,” সাংবাদিকদের জানান কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের মর্গে ময়নাতদন্ত করা চিকিৎসক অরবিন্দ পাল।
“প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে যে পূর্ব শত্রুতার জেরে সানাউরকে হত্যা করা হতে পারে। তবে অন্য কোনো কারণ আছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে,” টেলিফোনে বেনারকে জানান কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার প্রলয় চিসিম।
“স্বাধীনতার পর থেকে এত কঠিন সময় আর আসেনি। দেশে এখন নিরাপত্তা নেই, ধর্মীয় সহিংসতা চলছে। বিভিন্ন ধর্মের ও মতাদর্শের মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে,” বেনারকে জানান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান।
তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল গণতন্ত্র। সে গণতন্ত্র থেকে দেশ দূরে সরে যাওয়ার কারণেই সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অস্থিরতা ও জঙ্গিবাদের উত্থান হচ্ছে।
অবশ্য শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু মনে করেন, দেশে পূর্ণ গণতান্ত্রিক শাসন রয়েছে। বেনারকে মন্ত্রী বলেন, “অশিক্ষিতরা ধর্মের নামে বিপথগামী হয়। তাদের দিয়ে জঙ্গিবাদ সৃষ্টি করা যায়। সবাইকে এ ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে।”