ইইউ থেকে যুক্তরাজ্যের বিচ্ছেদ বাংলাদেশের ব্যবসা–বাণিজ্যে প্রভাব ফেলবে
2016.06.24

ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্য বের হওয়ার পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে এর কোনো প্রভাব পড়বে না। কিন্তু এই বিচ্ছেদ বাংলাদেশের ব্যবসা–বাণিজ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের তৃতীয় শীর্ষ রপ্তানি গন্তব্য যুক্তরাজ্য। বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ওই দেশটিতে রপ্তানির পরিমাণ ছিল দুই দশমিক দুই বিলিয়ন পাউন্ড।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, ইইউ থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে তেমন কোনও প্রভাব পড়বে না। কিন্তু অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে প্রভাবটা বেশ বড় হতে পারে।
পাউন্ডের সঙ্গে টাকার দরও পড়ে যাবে, এটা প্রায় অবধারিত। এতে ব্রিটেনে প্রবাসী বাংলাদেশিরা একটা বড় সময়ের জন্য মন্দাবস্থার মুখোমুখি হবেন। ফলে, বাংলাদেশে রেমিট্যান্সের ওপরও তার কিছুটা প্রভাব পড়তে বাধ্য।
“ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরিবর্তে আবার যুক্তরাজ্যের সঙ্গে আলাদাভাবে সম্পর্ক করতে হবে। যুক্তরাজ্যের বাজারে কোটা সুবিধা নিয়ে প্রবেশাধিকারসহ যেসব সুবিধা আমরা পাই, সেগুলো হয়ত আপাতত বজায় থাকবে, তবে সেগুলোও পুনঃআলোচনার প্রয়োজন হবে,” বাংলাদেশের ওপর ব্রেক্সিট গণভোটের সম্ভাব্য প্রভাব সম্পর্কে জানতে চাইলে বেনারকে জানান সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর।
তিনি আরও বলেন, ব্রিটেনে বসবাসরত বৈধ বাংলাদেশি অভিবাসীদের ক্ষেত্রে সমস্যা না হলেও অবৈধরা সমস্যায় পড়তে পারেন। আবার যারা ইউরোপের অন্যান্য দেশ থেকে যুক্তরাজ্যে যেতে চায়, তাঁরাও সমস্যায় পড়বেন।
“মূলত: ব্যবসা, বাণিজ্য, অভিবাসন, শিক্ষার্থীদের যাওয়া, নিরাপত্তার বিষয়গুলো নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে এবং পদ্ধতিগতভাবে আলাপ–আলোচনা চালাতে হবে,” জানান ওই কূটনীতিক।
সরকারের একাধিক সূত্র বেনারকে জানিয়েছে, এখনই সেখানে বাংলাদেশের বাজার সুবিধা হারানোর সম্ভাবনা কম। কারণ নতুন পর্যায়ে যেতে যুক্তরাজ্যের আরো দুই বছর সময় লাগবে।
নতুন পরিস্থিতিতে ব্যবসার খরচ বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের পণ্য প্রতিযোগিতামূলক বাজারে সক্ষমতা হারাতে পারে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ঢাকা থেকে প্রায় সব পণ্য যায় লন্ডন হয়ে। কিন্তু এখন ইউরোপের প্রতিটি দেশে আলাদাভাবে পণ্য পাঠাতে হবে, এতে খরচ বাড়বে।
সাবেক ও বর্তমান কূটনীতিকেরা মনে করেন, ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের রাজনৈতিক সম্পর্ক বেশ ঘনিষ্ঠ। ফলে ইউরোপের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ নিয়ে যুক্তরাজ্য সব সময় উচ্চকন্ঠ থেকেছে। এই প্রেক্ষাপটে ইইউ থেকে যুক্তরাজ্যের বের হয়ে যাওয়াটা বাংলাদেশের জন্য কিছুটা ক্ষতির কারণ হবে।
কূটনৈতিক বিভিন্ন সূত্র বলছে, লিসবন চুক্তির আওতায় নতুন পর্যায়ে যেতে যুক্তরাজ্যের দুই বছর সময় লাগবে। অন্তর্বর্তীকালীন এ সময়ে যুক্তরাজ্যে ইইউর আওতায় পাওয়া বাজার সুবিধা বাংলাদেশের জন্য বজায় থাকবে।
তবে দুই বছর পর স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে ‘অস্ত্র ছাড়া সবকিছু বা ইবিএ কর্মসূচির’ আওতায় ইউরোপের দেশগুলোতে বাংলাদেশ যে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা পায়, তা বজায় রাখতে নতুন আলোচনা ও চুক্তির প্রয়োজন হবে।
“যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের বাজার সুবিধা নষ্ট হবে না। তবে এই সিদ্ধান্তের ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য ছাড়াও বৈদেশিক সাহায্য, মুদ্রা বিনিময়, পরিবহন সেবা নানা ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলবে,” বেনারকে জানান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সাম্মানিক ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
তাঁর মতে, সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়বে মুদ্রা বাজারে, ইউরোর দরপতনের মধ্য দিয়ে এর ফল দেখা যেতে শুরু করেছে। এতে করে ব্যবসার খরচ বাড়বে। আর বাংলাদেশের পণ্য যুক্তরাজ্যের বাজারে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে সক্ষমতা হারাবে।
রেস্তোরাঁ ব্যবসার সঙ্গে জড়িতরা ইইউ থেকে যুক্তরাজ্যের বের হওয়ার বিষয়টি সমর্থন করছেন। বাংলাদেশ ক্যাটারার্স অ্যাসোসিয়েশন, ইউকের সভাপতি পাশা খন্দকারকে উদ্ধৃত করে ডেইলি মেইল সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, যুক্তরাজ্যের অভিবাসন নীতির কারণে প্রতি সপ্তাহে একাধিক রেস্তোরাঁ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিকেরা মনে করছেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অভিবাসন নীতি শিথিল হবে। এতে করে আরও বেশি সংখ্যক বাংলাদেশের নাগরিকদের কাজের সুযোগ তৈরি হবে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের কারি শিল্প সে দেশের অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রাখছে। এ মুহূর্তে বাংলাদেশি-বংশোদ্ভূত তিনজন ব্রিটিশ এমপি আছেন। ব্রিটিশ এমপিদের নিয়ে কারিশিল্পের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা যদি সফলভাবে দর কষাকষি করতে পারলে বাংলাদেশের লোকজনের জন্য সেখানে কাজের সুযোগ তৈরি হতে পারে।
এদিকে ঢাকায় একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে যোগ দিতে আসা ব্রিটেনের নাগরিক রিচার্ড চার্কিন শুক্রবার বেনারকে বলেন, ইইউ থেকে ব্রিটেনের বের হওয়ার সিদ্ধান্তটি খুব বাজে হয়েছে। এতে ব্রিটেন নিজেই ভুগবে।
ইন্টারন্যাশনাল পাবলিশার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রিচার্ড চার্কিন আরও বলেন, ব্রিটেনে প্রচুর বাঙালি রয়েছেন। এতোবড় ঝড়ে প্রত্যেকে কিছুটা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে লাভ–ক্ষতি পর্যালোচনা করতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে।